<p>১৩০০ হিজরির পড়ন্ত বেলা। মোগল সাম্রাজ্যের সমাপ্তিতে চতুর্দিকে এলোমেলো বিচ্ছিন্ন পরিবেশ। মানবতা সামাজিকতা নিয়ম-নীতির বাঁধ ভেঙে সরে গেছে অনেক আগেই। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ছিল ধর্ম ও শিক্ষাদীক্ষার অঙ্গনে। হিন্দুস্তানজুড়ে তখন বিরাজ করছিল শিরক-বিদআতের ঘন আঁধার অমানিশা। আকিদা-বিশ্বাসে ছিল না সত্যের লেশমাত্র। ধর্ম বলতে ছিল কিছু রুসুমাতের উষ্ণ উদ্যাপন। যা কিছু নামধারী সুফি সাধকের দুই টুকরো রুটির জোগান।</p> <p>এরই মধ্যে ইংরেজ শাসনের অধঃপতনের আরেক দুয়ার উন্মুক্ত করল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোপণ করতে লাগল লর্ড মাইকেলের বিদ্বিষ্ট চিন্তাধারা। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে নিজেদের গাদ্দারি আর স্ববিরোধী কারসাজি ভারতের হুকুমত একরকম ইংরেজদের হাতে তুলে দিল। শুরু হলো নির্মম পাশবিকতার করুণ ইতিহাস। গাছে গাছে ঝুলেছে লাশের সারি। তোপ, কামান আর গোলার আঘাতে ভস্ম হয়ে গেছে কত শত পরিবার। বুলেটের তপ্ত সিসা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে কত বুক। আর জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের অথৈ জলে কত যে দেহ নির্বাসিত করা হয়েছে, কে দেবে তার সাক্ষী?</p> <p>ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে যে পাশবিকতার আচরণ করা হয়েছে তার বিবরণ কোনো চক্ষু সংবরণ করতে পারবে না। গাছে ঝুলিয়ে, পানিতে চুবিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হতো না তাদের পাশবিক চিত্ত। বরং লাশগুলো টুকরো টুকরো করে পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো হতো। এককথায় বলতে গেলে, ১৮৫৭ সালের পরাজয়ের পর দৃঢ়ভাবে এ আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে ইসলামের নাম-নিশানা চিরতরে এ মাটি থেকে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহপাকের ইচ্ছা ছিল এর ব্যতিক্রম। সেই যেমন ফেরাউনের অত্যাচারে নিষ্পেষিত বনি ইসরাইলরা, আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে তাঁদের জগতের ইমাম বানানোর প্রতিশ্রুতির ঘটনা পৃথিবীতে আরেকবার ঘটল।</p> <p>জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে দিকভ্রান্ত মুসলিম উম্মাহকে এক পতাকাতলে সমবেত করার মহান উদ্দেশ্য সামনে রেখে ১৮৬৬ সালে ইউপির অন্তর্গত দেওবন্দ নামক পল্লীতে সাত্তা মসজিদকেন্দ্রিক ‘দারুল উলুম দেওবন্দের’  স্থাপনা রাখা হয়।</p> <p>কোরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের ব্যাখ্যা ও সংকলন, ইসলামী মূলনীতি, ইসলামী আইন, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুশাসন, ভাষা, সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, শিষ্টাচার, আধ্যাত্মিকতাসহ ধর্মীয় শাস্ত্রচর্চার এমন কোনো বিভাগ নেই দেওবন্দের চার দেয়াল যা পরিবেষ্টন করেনি। বিংশ শতাব্দীর গণ্ডি না পেরোতেই উপমহাদেশসহ বিশ্বের চতুর্দিকে দেওবন্দের সুখ্যাতি ছড়িয়ে  পড়েছে।</p> <p>দেওবন্দের শিক্ষা কারিকুলাম, আদর্শ ও মানসিকতার অনুকরণে পৃথিবীর বহু দেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই এ জাতীয় মাদরাসা রয়েছে ১০ হাজারের বেশি। নিম্নে আন্তর্জাতিক মানের ১০টি প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করা হলো—</p> <p> </p> <p>মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর (ভারত)</p> <p>দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসের মাথায় ১৮৬৬ সালের শেষ নাগাদ মাজাহিরুল উলুমের ভিত্তি রাখা হয়। মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.), শাইখুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.)সহ অন্য সব মনীষীর স্মৃতিবিজড়িত সাহারানপুরের এই পুণ্যভূমি।</p> <p> </p> <p>দারুল উলুম করাচি (পাকিস্তান)</p> <p>মুফতি আজম পাকিস্তান মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)-এর হাতে ১৯৫১ সালে দারুল উলুম করাচির বুনিয়াদ রাখা হয়। যা এখন ১০০ একর বিস্তৃত ইলমের এক সুবিশাল জ্ঞানের নগরী। বিশ্বনন্দিত আলেমে দ্বিন মুফতি তকি উসমানি অত্র মাদরাসার দায়িত্বশীলদের অন্যতম।</p> <p> </p> <p>আল-জামিয়াতুল আহলিইয়া মঈনুল</p> <p>ইসলাম হাটহাজারী (বাংলাদেশ)</p> <p>শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রহ.) কর্তৃক ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারী মাদরাসা, বর্তমান বাংলাদেশের সব দেওবন্দি মাদরাসার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে। প্রায় ১০ সহস্রাধিক ছাত্র ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি মুসলমানদের ধর্মীয় আস্থার প্রতীক। বর্তমানে আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব মাদরাসার প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।</p> <p> </p> <p>দারুল উলুম জাকারিয়া (সাউথ আফ্রিকা)</p> <p>১৯৮১ সালে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্দলবী (রহ.)-এর ঐতিহাসিক সাউথ আফ্রিকা তাবলিগি সফরের মধ্য দিয়ে অত্র মাদরাসার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে ভারতীয় ওলামায়ে কেরামের দ্বারা পরিচালিত হলেও এখন তা বৃহৎ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।</p> <p> </p> <p>জামিয়াতুর রাশাদ (কানাডা)</p> <p>এই মাদরাসাটিও শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্দলবী (রহ.) ১৯৮০ সালে কানাডার কর্নওয়াল সিটিতে স্থাপন করেন। খুব ছোট্ট পরিসরে শুরু হওয়া জামিয়াতুর রাশাদ কানাডাজুড়ে তার অসংখ্য শাখাসহ মজবুত শিকড় গেড়ে অবস্থান গ্রহণ করে আছে। দেওবন্দি কারিকুলামে উর্দু ভাষার বইপত্রের মাধ্যমেই এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করানো হয়। ভারত-পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানেই এগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে।</p> <p> </p> <p>জামিয়াতুল ইলম ওয়াল হুদা ব্ল্যাকবার্ন (ইংল্যান্ড)</p> <p>১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ডের এই মাটিতে জামিয়াতুল ইলম ওয়াল  হুদার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম কর্তৃক পরিচালিত ধর্মীয় ও বৈষয়িক শিক্ষার সমন্বয়ে এটি ইংল্যান্ডের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান।</p> <p> </p> <p>দারুল উলুম নিউ ইয়র্ক (আমেরিকা)</p> <p>১৯৯৭ সালে শুধু শিশুদের জন্য কোরআন শিক্ষার মক্তব আকারে দারুল উলুম নিউ ইয়র্কে যাত্রার সূচনা হয়। যা এখন সম্পূর্ণ দেওবন্দি পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পুরুষ-মহিলা উভয় বিভাগে দাওরায়ে হাদিস ক্লাস পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়েছে। রয়েছে উচ্চতর ইসলামী আইন অনুষদ বা ফতোয়া বিভাগ। মাদরাসার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্যমতে প্রায় সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী এখানে ইলমে দ্বিন শিক্ষা করছে।</p> <p> </p> <p>দারুল উলুম টোবাগো (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)</p> <p>১৯৮৪ সালে দক্ষিণ আমেরিকার ওয়েস্ট ইন্ডিজে ইলমে নববীর এই প্রস্রবণ ধারা জারি হয়। ইংরেজি ভাষাভাষী একটি হিন্দু রাষ্ট্রে থেকেও ইসলাম প্রচারে কতটা ভূমিকা রাখা যায় দারুল উলুম ওয়েস্ট ইন্ডিজ তার আদর্শ নমুনা। মাদরাসার অফিশিয়াল ওয়েবসাইট বলছে, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে মাদরাসার টোটাল ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। যার মধ্যে থেকে ৩৮১ জন দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেছে। এ ছাড়া ইংরেজি ভাষায় মিডিয়াকেন্দ্রিক ইসলাম প্রচারে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছে তাদের। যা সত্যিই ঈর্ষণীয়।</p> <p> </p> <p>মাদরাসাহ আস-সালওয়াতিয়্যাহ (সৌদি আরব)</p> <p>সালওয়াতুন নিসা নামে আল্লাহর এক বান্দী মক্কাতুল মুকাররমায় ১৮৭৪ সালে নিজের নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে আকাবিরে দেওবন্দের মধ্য থেকে মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানবী (রহ.), হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) প্রমুখ দীর্ঘদিন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তা আরব বিশ্বের অন্যতম দ্বিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি।</p> <p> </p> <p>জামিয়া দারুল উলুম জাহিদান (ইরান)</p> <p>শিয়াদের অন্যতম ঘাঁটি ইরানে এত বিশাল দেওবন্দি রীতির চর্চা, বিশ্বজুড়ে দেওবন্দের বিস্ময়কর কৃতিত্বের একটি। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম জাহিদান এখন ইরানের বুকে সুন্নি মুসলমানদের দৃঢ় আস্থার প্রতীক হিসেবে ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। যা হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের উলামায়ে দেওবন্দের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত।</p> <p> </p> <p>লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা</p> <p>ফুলবাড়ী গেট, খুলনা।</p>