<p>রাজশাহীর বাগমারার মজিদপুরে মাসখানেক আগে বিলের মাঝখানে প্রায় দুই শ বিঘা ধানি জমি কেটে খনন করা হয়েছে ছয়টি পুকুর। একইভাবে গত তিন মাসে পুরো বাগমারায় অন্তত ৫০টি বিলের আড়াই হাজার বিঘা ধানি জমি কেটে আড়াই শ পুকুর খনন করা হয়েছে। </p> <p>অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা বেশি লাভের আশায় প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাছ চাষের জন্য এসব পুকুর খনন করছেন। এ নিয়ে বাগমারাজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এসব পুকুর খননে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা জড়িত এবং প্রশাসন চুপ থাকায় এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।</p> <p>মজিদপুরের বিলে ড্রেজার দিয়ে ছয়টি পুকুর খনন করেছেন স্থানীয় যুবলীগ নেতা (পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক) সোহেল রানা। জমির মালিকদের বছরে বিঘাপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার বিনিময়ে (লিজ) এসব পুকুর খনন করেছেন তিনি। আবার এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে, পুকুর খনন করতে অনেক কৃষককে বাধ্য করা হয়েছে।</p> <p>মাছ চাষের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে বর্তমানে ওই পুকুরগুলোতে পাশের গভীর নলকূপ থেকে পানি ফেলা হচ্ছে। এভাবে মাসখানেকের মধ্যে খনন করা পুকুরগুলো মাছ চাষের জন্য উপযোগী করে তোলা হবে।</p> <p>ধানি জমিতে পুকুর খননের ফলে এ বছর আর ওই সব জমিতে ধান চাষ করতে পারেননি কৃষকরা। তবে এসব পুকুরের চারপাশের জমিতে রোপণ করা ধানে বর্তমানে পাক ধরেছে।</p> <p>যেসব জমি কেটে পুকুর খনন করা হয়েছে তাতে আর কখনো ধান কিংবা অন্য ফসল চাষ করা যাবে না। ওই এলাকার কৃষকরা বলছেন, বছরে তাঁরা এসব জমি থেকে তিনটি ফসল ঘরে তুলতে পারতেন। পুকুর খননের ফলে ওই এলাকায় কৃষিজমি হারিয়েছেন অন্তত দুই শ কৃষক। তাঁদের মধ্যে কারো ৫ শতাংশ আবার কারো ছয় থেকে সাত বিঘা পর্যন্ত জমি ছিল।</p> <p>মজিদপুর গ্রামের কৃষক আকবর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জমিতেও পুকুর কাটা হয়েছে। ওই পুকুর আমি কাটিনি, কেটেছেন যুবলীগ নেতা সোহেল রানা। এ কারণে প্রশাসনও বাধা দেয়নি। পুকুর কাটতে জমি বন্ধক দিতে শুরুতে অনেকে রাজি না থাকলেও পরে আবার অনেকে রাজি হয়ে যান। তাই আমিও রাজি হই।’</p> <p>নাম প্রকাশ না করে একই এলাকার আরেক কৃষক বলেন, ‘আমি জমি দিতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আমার জমির পাশের অন্য জমিগুলো যখন কাটা শুরু হয়, তখন বছরে বিঘাপ্রতি ৩৫ হাজার টাকায় লিজ দিতে বাধ্য হই। আমার এসব জমিতে বোরো ধানসহ বছরে তিনটি ফসল হতো। আমাদের বিলে সোহেল রানা পাশাপাশি যে ছয়টি পুকুর কেটেছেন তাতে অন্তত দুই শ বিঘা জমি লেগেছে।’</p> <p>পুকুর খননের বিষয়টি যুবলীগ নেতা সোহেল রানা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব জমি আগে পড়ে থাকত। কৃষকরাই আমাকে বিঘাপ্রতি বছরে ৩৫ হাজার টাকা চুক্তিতে জমি লিজ দিয়ে (বন্ধক) পুকুর কাটার অনুমতি দিয়েছেন। আমি ১১ বছর এই পুকুর ভোগ-দখল করতে পারব। তবে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর কৃষকদের টাকা দিতে হবে। এতে কৃষকরা লাভভান হবেন। ওই কারণেই তাঁরা আমাকে জমি দিয়েছেন। জোর করে কারো কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়নি।’</p> <p>অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাগমারার বিল জশায়ও গত তিন মাসে অন্তত ২৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে। সেখানেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা মাছ চাষের জন্য পুকুরগুলো খনন করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিল জশায় আওয়ামী লীগ কর্মী এরশাদ আলী এসব পুকুর খননের অন্যতম উদ্যোক্তা।</p> <p>তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এরশাদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তো সব পুকুর কাটিনি। কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করে কয়েকটি কেটেছি। কেউ বলতে পারবে না এখানে জোর করে পুকুর কাটা হয়েছে।’</p> <p>উপজেলার বালুপাড়া বিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী জাবের আলীর নেতৃত্বে প্রায় এক শ বিঘা জমিতে বেশ কটি পুকুর খনন করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষক দেরাজ আলী বলেন, ‘আমি তো আমার জমিতে পুকুর কাটতে দিতাম না। কিন্তু অনেকে ভয়ভীতি দেখাইছে। পুকুর কাটতে না দিলে জমিতে ফসল করতে দেবে না বলে হুমকি দিছে। পরে বাধ্য হয়ে পুকুর কাটতে অনুমতি দিছি।’</p> <p>আওয়ামী লীগ কর্মী জাবের আলী বলেন, ‘এসব জমিতে বছরে শুধু একবার ধান হতো। বাকি সময় খালি পড়ে থাকত। এ কারণে পুকুর খননের জন্য কৃষকরা টাকার বিনিময়ে জমি বন্ধক দিয়েছেন। কারো সঙ্গে জোর করা হয়নি।’</p> <p>সরেজমিনে এলাকাবাসী, স্থানীয় কৃষক এবং মাছ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাগমারার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে ১৮টি পুকুর, ঝিকড়া ইউনিয়নের পাঁচ-ছয়টি বিলে অন্তত ২০টি পুকুর, মাড়িয়া বিলে ১১টি, শ্রীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে ১৫টি, গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে ২০-২২টি, আউচপাড়া ইউনিয়নে ১৭-১৮টি, দ্বিপুরে আটটি, বড়বিহানালী বিলে সাতটি, ভবানীগঞ্জ পৌর এলাকার তিনটি বিলে ১৫টি, বাসুপাড়া বিলে ১৮টি, গনিপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে অন্তত ২৫টি, গোয়ালকান্দিতে ১৭টি, খয়রা বিলে ১২টি, তেলিপুকুর-গাঙ্গপাড়া বিলে আটটি, দুবিলা বিলে ৯টি, নাককাটি বিলে তিনটিসহ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ৫০টি বিলের আড়াই হাজার বিঘা জমিতে গত তিন মাসে এসব পুকুর খনন করা হয়েছে।</p> <p>বাগমারার স্থানীয় একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘মাঝখানে কয়েক দিন স্থানীয় প্রশাসন অভিযানও চালিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের চাপে তারা সরে এসেছে। এতে উপজেলার কৃষকরা অন্তত আড়াই হাজার বিঘা কৃষিজমি হারিয়েছেন।’</p> <p>উপজেলার বড়বিহানালী এলাকার মাছ চাষি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এ বছর প্রচুর জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। আমরা যেটুকু জেনেছি, তাতে অন্তত আড়াই-তিন হাজার বিঘা জমি পুকুরের পেটে গেছে। মাছ চাষ করে বেশি লাভের আশায় ধানি জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে।’</p> <p>একই এলাকার মাছ চাষি আমজাদ আলী বলেন, ‘এসব পুকুরের কোনো কোনোটির আয়তন ৭০ থেকে ৮০ বিঘা। ১০ বিঘার নিচে কোনো পুকুর নেই। সেই হিসাবে আড়াই শ পুকুরের পেটে অন্তত আড়াই হাজার বিঘা জমি গেছে।’ </p> <p>এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘পুকুর খননের কারণে অনেক ফসলি জমি আমরা হারাচ্ছি। কিন্তু এতে কী পরিমাণ জমি নষ্ট হয়েছে তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে এ বছর শতাধিক বিঘা জমি পুকুরের পেটে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুকুর খননের অনুমতি দেওয়া না হলেও কৃষিজমিতে পুকুর খনন অব্যাহত আছে। আমাদের কিছু করার নেই।’</p> <p>বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুকুর খনন রোধে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা জরুরি। দুঃখজনক হলো, এই সচেতনতা তাঁদের মধ্যে নেই। ফলে অভিযান চালিয়েও পুকুর খনন বন্ধ করা যায়নি। প্রতিদিনই আমরা অভিযান চালাচ্ছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। রাতারাতি পুকুর কাটা বন্ধ করা কঠিন।’</p> <p>বিষয়টি নিয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুকুর খনন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রশাসন এ নিয়ে কাজ করছে। তার পরও প্রতিদিন রাতের আঁধারে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয়দের সচেতনতা জরুরি। তবেই পুকুর খনন বন্ধ করা সম্ভব।’</p>