ঢাকা, সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫
১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ সফর ১৪৪৭

ঢাকা, সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫
১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ সফর ১৪৪৭

ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

  • ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর মানুষের অনেক আশঙ্কাই বাস্তবে ঘটতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি বাইডেন প্রশাসনের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ বাতিল করে এবং নতুন করে দুই শতাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে নিজের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত শুধু মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যে চারটি সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ট্রাম্পের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি করছে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য। 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গৃহীত প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা। এই চুক্তিটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। চুক্তি থেকে সরে আসার মাধ্যমে ট্রাম্প দেখিয়েছেন যে মার্কিন অর্থনীতির স্বার্থ জলবায়ু সংকট মোকাবেলার চেয়ে তাঁর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সিদ্ধান্তের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ, যে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, এই সিদ্ধান্তের কারণে আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন কমিয়ে দিলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু অভিযোজন এবং পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়তে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

ট্রাম্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বেরিয়ে আসা। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ডব্লিউএইচও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় সংস্থাটির তৎপরতা এবং সহযোগিতা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ডব্লিউএইচও হলো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্তের প্রভাব হবে বিশাল।

উদাহরণস্বরূপ, ডব্লিউএইচও বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচি এবং মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে এসব কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হবে। কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাতে পুনর্গঠনের প্রয়োজন, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রধান দাতা দেশ ডব্লিউএইচও থেকে সরে আসার ফলে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হবে, যা সরাসরি দরিদ্র দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ, যা জনস্বাস্থ্য খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, এই সিদ্ধান্তের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তার পরিমাণ হ্রাস করা ট্রাম্পের আরো একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী মানবিক সহায়তা প্রদানের শীর্ষে ছিল। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটে, বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণে মার্কিন সহায়তার গুরুত্ব অপরিসীম। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সব সময়ই ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে সহায়তার পরিমাণ কমে গেলে কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জন্য মৌলিক সেবা প্রদান আরো কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সহায়তা হ্রাস পেলে বাংলাদেশ, সিরিয়া, ইউক্রেনসহ অনেক দেশকে এককভাবে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে, যা অত্যন্ত কঠিন। এর ফলে মানবিক সংকট আরো প্রকট হবে, যা আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার সিদ্ধান্ত শুধু অভিবাসীদের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী অভিবাসন নীতিতে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। বিপুলসংখ্যক অভিবাসী, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন বা তাঁদের সন্তানরা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পেয়েছে, তারা এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সিদ্ধান্ত অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং ভয় বাড়িয়ে তুলেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীসমাজ এবং তাদের অর্থনৈতিক অবদানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তগুলো শুধু মার্কিন অভ্যন্তরীণ নীতিতে নয়, বিশ্বরাজনীতিতেও একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ধারণাকে দুর্বল করছে এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা এবং ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে যাওয়া ট্রাম্প প্রশাসনের একপক্ষীয়তাবাদকে স্পষ্ট করেছে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন বিশ্বনেতৃত্বে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি প্রতিরোধ এবং মানবিক সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে যেখানে বৈশ্বিক সহযোগিতা অপরিহার্য, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিচ্ছিন্ন নীতি পুরো বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ট্রাম্পের এই নীতিগুলো বাংলাদেশের জন্য দ্বৈত প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে রোহিঙ্গা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে বাংলাদেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে এই নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বরাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং মানবিক সংকটের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাঁর নীতিগুলো বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে, যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, বিকল্প সহযোগিতা খোঁজা এবং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

রাজনীতিতে জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর

    ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শেয়ার
রাজনীতিতে জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো পুরোপুরি ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর যথেষ্ট টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। তা ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

সংগত কারণেই নির্বাচন প্রসঙ্গটি সবার কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে। অথচ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য থেকেই গেছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথভাবে জনগণের কাছে পৌঁছতে পারছে কি না কিংবা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধান কাজ।

বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য মাঝেমধ্যে এই ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে। টানাপড়েন যতই বাড়বে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ততই সামনে আসবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো দেশে একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা এবং লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে সেই পরিবেশ তৈরি করা।
কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। কবে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনএই প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট কোনো উত্তর কেউই দিতে পারছে না।

নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে বিষয়ে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতামত এবং অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিতে তারা এখন বিশেষ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের এই দলটি আলাদা ধরনের গুরুত্ব বহন করছে বলে পরিষ্কার ধারণা করা যায়।

সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এই দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। তারা কখন কিভাবে নির্বাচন চাইবে, কোন সময় চাইবে, কোন শর্তে চাইবে, সংস্কার এবং বিচারের আগে, না পরে ধরনের অনেক বিষয়ের সঙ্গেও সরকারের সদিচ্ছার প্রসঙ্গটি জড়িত বলে অনেকেই মনে করেন।

এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেমন সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি, ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক রোডম্যাপ যথাযথভাবে ঘোষণা করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ভিশন আমাদের সামনে সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপিত হয়নি। এমনকি এনসিপি যে জুলাই পদযাত্রা করছে, সেটি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও কম সময়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে যথাযথ মিথস্ক্রিয়া করতে পারছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এরই মধ্যে জামায়াত একটি জাতীয় সমাবেশ করে আগামী দিনে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। অন্যদিকে বিএনপিও নিজেদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ আমরা জানি, যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ সাধন করা। ক্ষেত্রে জনগণ যেভাবে চায়, ঠিক সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়।

নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা-ও কিন্তু নয়। রাজনীতিতে টানাপড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। কারণে প্রয়োজন একটি উইন-উইন পরিস্থিতির। ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন-উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শতাধিক নিবন্ধনহীন এবং ব্যক্তিনির্ভর দল রয়েছে। যেসব নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলোরই কোনো অফিস নেই, আবার অফিস থাকলেও সভাপতির নিজের বাসার ড্রয়িংরুম অফিসের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। এমনকি বেশির ভাগই প্রাথমিক যোগ্যতা পূরণ করতে পারেনি বলে নির্বাচন কমিশন চিঠি দিয়ে জানিয়েছে।

অনেক দল রয়েছে, যেগুলোর সভাপতির নাম পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের নাম পাওয়া যায় না। ছাড়া বিদ্যমান নিবন্ধিত অনেক দলই সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছাড়া আর কারো তেমন জনসমর্থন নেই। বাকি দলগুলোর তেমন একটা জনসমর্থন না থাকলেও দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড রয়েছে। এদের তৎপরতা দেখা যায় শুধু নির্বাচন মৌসুম এলেই। নির্বাচনের আগে এই দলগুলোর কদর বেড়ে যায়। বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির দর-কষাকষি চলে।

যেকোনো রাজনৈতিক দল বৈধ এবং সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করেও ক্ষমতায় আসে এবং আসার চেষ্টা করে। আমাদের দেশে বিদ্যমান নামসর্বস্ব দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই।

আমরা আশা করব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য কাজ করবে। এমনকি সব দল এবং দলের নেতারা সহনশীল হবেন, সংযত হবেন। অতীত বা বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীর কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, যাতে দেশ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে, যাতে দেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা এবং পারস্পরিক টানাপড়েন যত কমিয়ে আনা যাবে, ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোক মনে রাখতে হবে, ভোটের রাজনীতিতে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো সাংগঠনিক ভিত্তি এবং জনসমর্থন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলে এবং জনসমর্থন না থাকলে সেই দল নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে না। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে নতুন দলগুলোর উচিত সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না। ফলে জনসমর্থনও বাড়ে না, বরং হিংসা-বিদ্বেষ এবং হানাহানির পরিবেশ তৈরি হয়। আর মোটাদাগে ওই সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ফলাফল নেতিবাচক হয়।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

আমরা কি কেবল ভোক্তাই থেকে যাব

    আবু তাহের খান
শেয়ার
আমরা কি কেবল ভোক্তাই থেকে যাব

২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ বিদেশ থেকে মোট ৬৩ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপরীতে সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মোট ৫১ হাজার ১১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আমদানি করা বস্ত্রের হিসাব বাদ দিলে নিট রপ্তানির পরিমাণ আরো কম। অন্যদিকে সময়ে যা কিছু আমদানি হয়েছে, সেখানে শিল্পে ব্যবহার্য মৌলিক যন্ত্রপাতির অংশ মাত্র ৪.১৫ শতাংশ; অর্থাৎ আমদানির বেশির ভাগ জুড়েই রয়েছে ভোগ্যপণ্য।

শিল্পপণ্যের নামে রপ্তানি করা আরএমজি পণ্য আসলে তেমন যন্ত্রনির্ভর পণ্য নয়, এর প্রায় পুরোটাই হচ্ছে দেশের গরিব-দুঃখী নারীর হাতের নিপুণ দক্ষতায় তৈরি অযান্ত্রিক পণ্য। এই অবস্থায় বলা যেতে পারে, আমরা হচ্ছি এমন একটি ভোক্তা জনগোষ্ঠী, যারা সারাক্ষণ অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে হলেও উচ্চমূল্যের ভোগ্যপণ্য আমদানি ও ব্যবহার করে এমন ধারার জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, যেটিকে মহাজনি আমলের দাদন প্রথার সঙ্গেই কেবল তুলনা করা যেতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, জনগণের মধ্যকার এই অভ্যস্ততা বস্তুত রাষ্ট্রই তৈরি করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক মহাজনি দাদন ব্যবস্থার আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বাবদ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার।

আসলে আমাদের বোধ ও চিন্তায় উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের তেমন কোনো আকাঙ্ক্ষাই নেই। উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার বাসনা নেই। আমরা সারাক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকি উন্নত বিশ্বের দিকে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে নিজেদের কপট বাহাদুরি করে যাই।

অন্যের উদ্ভাবিত চিকিৎসা-প্রযুক্তি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ব্যবহার করে আমরা আমাদের আয়ুষ্কালকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা করি, কিন্তু নিজেরা সেসব উদ্ভাবন ও উৎপাদনের কথা ভাবি না। আমরা দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর জন্য আধুনিক রেলপথ নির্মাণের কথা ভাবি, কিন্তু সে পথে কখনো নিজেদের বানানো ট্রেন চালানো নিয়ে চিন্তা করি না। আসলে রাষ্ট্র দেশের জনগণের ভেতকার সামর্থ্য, সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতার বোধগুলোকে তার ভ্রান্ত স্বার্থপর নীতিকাঠামোর আওতায় ভেঙে বিনষ্ট চুরমার করে দিয়েছে।

গত ৫৪ বছরের সরকারগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভ্রান্ত রাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ভোক্তা রাষ্ট্র হিসেবে আটকে রেখেছে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একে উৎপাদক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেয়নি। ১৯৯০-পরবর্তী গত ৩৫ বছরের মধ্যে গঠিত সরকারগুলো দেশে মোট ছয়টি শিল্পনীতি (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১০, ২০১৬ ও ২০২২) প্রণয়ন করেছে।

এই সরকারগুলোর রাজনৈতিক মতদ্বৈততা থাকলেও উপরোক্ত শিল্পনীতিগুলোতে তারা উৎপাদন শিল্পের স্বার্থ বিঘ্নিত করে সেবা খাতকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগিয়ে রাখার ব্যাপারে ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে। আর এটি তারা ঘটিয়েছে মূলত তিনটি কারণে : ১. দ্রুততম সময়ের মধ্যে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা, যা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের একটি বড় ধরনের ভ্রান্তি ছিল বলেই মনে করি। ২. শিল্পনীতিতে উৎপাদন খাতকে উপেক্ষা করে সেবা খাতকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা বস্তুত এমন এক সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে রক্ষা করতে চেয়েছেন, যাঁদের তাঁরা নিজেদের লোক বলে মনে করেছেন। ৩. বাংলাদেশের শিল্পনীতিগুলোর মূল চরিত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সেই ১৯৮০-র দশক থেকেই সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছে, যার মধ্যে দুটি ব্যাংকের নাম এসেছে সবচেয়ে বেশি। এই দুই ব্যাংক ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্প স্থাপনকে নিরুৎসাহ করার নীতি গ্রহণ এবং এর বিপরীতে শুধু আরএমজি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। আর তাদের এরূপ পরামর্শের কারণে দেশে আরএমজির যথেষ্ট বিকাশ ঘটলেও খাতে ব্যবহৃত বস্ত্রের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, যা চীন বা ভিয়েতনামকে করতে হচ্ছে না। অর্থাৎ দাতাদের ভ্রান্ত পরামর্শে (অনেকে অবশ্য এই পরামর্শকে উদ্দেশ্যমূলকও বলেন) বাংলাদেশের শিল্প খাতকে বরাবরই নানা ভ্রান্তির ফাঁদে পা দিতে হয়েছে, যে ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

উল্লিখিত শিল্পনীতিগুলোতে সেবা খাতকে শিল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলকভাবে কঠিনতর, সময়সাপেক্ষ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদন শিল্প ছেড়ে সেবামূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকেছেন। ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে উৎপাদন শিল্পের হিস্যা ক্রমেই আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে। রাষ্ট্রের এরূপ ভ্রান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা ৩৫ বছরে ধরে কিভাবে ঘাটে ঘাটে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন এবং সেবা খাত হয়ে উঠেছে অর্থনীতির সাময়িক কৌশলের মূলধারা।

শুধু ভোক্তাপ্রধান অর্থনীতির দেশ হয়ে না থেকে বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে একটি উদ্ভাবক ও উৎপাদক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে শিল্পনীতি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। তবে ক্ষেত্রে শিল্পনীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি, বাণিজ্যনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার চর্চা এবং সর্বোপরি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতি-কৌশলের বিষয়গুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেশে যদি ব্যাবসায়িক পরিবেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না আসে, তাহলে ভোক্তা থেকে ক্রমান্বয়ে উদ্ভাবক ও উৎপাদক হয়ে ওঠার কাজটি ঘটাবে কারা?

মোটকথা, সৃজনশীল উদ্ভাবক ও উৎপাদক হওয়ার লক্ষ্যে জাতিগত বিকাশ ও এর আত্মমর্যাদার জায়গাটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্র বড়ই উদ্যমহীন। তার পরও আমরা আশাবাদী যে শিগগির না হলেও একসময় রাষ্ট্র অবশ্যই উদ্ভাবক ও উৎপাদকের রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং শুধু ভোক্তা হয়ে থাকার গ্লানি থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে।

 

লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

শিল্প মন্ত্রণালয়

 

মন্তব্য

আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রাম ও ইব্রাহিম ত্রাওরে

    মাহবুব আলম
শেয়ার
আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রাম ও ইব্রাহিম ত্রাওরে

ক্ষুধা, রোগ আর বেকারত্বে জর্জরিত পশ্চিম আফ্রিকার একটি হতদরিদ্র দেশ বুরকিনা ফাসো প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম ত্রাওরের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এক সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে ত্রাওরে ঘোষণা করেন, বুরকিনা ফাসোকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করা হবে। সামাজ্যবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা হবে। সেই সঙ্গে হতদরিদ্র মানুষকে দুমুঠো খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।

নিশ্চিত করা হবে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান আর নারীর ক্ষমতায়ন। আরো বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেন। এসব যে কথার কথা ছিল না, তা তিনি প্রমাণও করছেন। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি তাঁর দেশ থেকে ফরাসি সেনাঘাঁটি বন্ধের ঘোষণা দেন এবং তা কার্যকর করেন।
ফ্রান্সসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের মালিকানাধীন স্বর্ণখনিসহ বিভিন্ন খনি জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। ফরাসি মালিকানাধীন দুটি স্বর্ণখনি জাতীয় করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে জাতীয় স্বর্ণভাণ্ডার গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করেন।

আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রাম ও ইব্রাহিম ত্রাওরে২০২২-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫-এর জুলাই তিন বছরেরও কম সময়ে বুরকিনা ফাসোর দারিদ্র্য কিছুটা হলেও কমেছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে চরম দারিদ্র্য ২ শতাংশ কমেছে।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, রাজস্ব আয়ও বেড়েছে। ইব্রাহিম ত্রাওরে দারিদ্র্য বিমোচন স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে বামপন্থী অর্থনীতি অনুসরণ করে এরই মধ্যে দেশটিতে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু করছেন। ত্রাওরে শুরুতেই কৃষির ওপর জোর দেন। বলেন, নিজেদের খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে।
এই লক্ষ্যে তিনি প্রথমেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দিয়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বিলাসবহুল গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলাম করে দেন। নিলামে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি ৪০০ ট্রাক্টর আমদানি করেন এবং সেগুলো তিনি কৃষকদের মাঝে বণ্টন করেন নামমাত্র মূল্যে। রকম আরো অনেক পদক্ষেপ নেন। ওই দেশে কোনো সেচব্যবস্থা নেই। তাই তিনি ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন শুরু করেন। মাত্র আট মাসে এই খাল খনন সম্পন্ন হয়। অথচ বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, খাল খননে কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় হবে, জন্য সময় লাগবে ১০ বছর। স্বেচ্ছাশ্রমসহ নানা উপায়ে তিনি এমনভাবে কাজ করছেন, যা অনেক বিশেষজ্ঞ ভাবতেও পারেন না। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে এভাবে বহু ধরনের প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে একটি বিপ্লবী চেতনার ছোঁয়া। আর এতে সময় ও অর্থের বিপুল সাশ্রয় হচ্ছে।

ইব্রাহিম ত্রাওরের নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসোর এই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে শক্তিধর ফ্রান্সকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় তিনি বুরকিনা ফাসোসহ সমগ্র আফ্রিকার মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। জয় করেছেন সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষের হৃদয়ও। তাইতো ত্রাওরের সাহসী পদক্ষেপে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারাও তাদের দেশ থেকে একে একে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি উচ্ছেদ করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে মালি ও নাইজার থেকে ফরাসি ও মার্কিন সামরিক ঘাঁটি উচ্ছেদ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ত্রাওরে আফ্রিকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তার শুরু হয় ২০২৩ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে আফ্রিকা-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে এক ভাষণের মধ্য দিয়ে। ওই ভাষণে আফ্রিকার নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার সাম্রাজ্যবাদী নেতাদের ঘোরানো ছড়ির ইশারায় পুতুলের মতো নাচা বন্ধ করুন।তাঁর ওই বক্তব্য রাশিয়ান গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। ত্রাওরেকে আফ্রিকার নেতা হিসেবে তুলে ধরতে ওই প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব ঘটনায় ত্রাওরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক আপসহীন সৈনিক হিসেবে।

ত্রাওরের অনুসারীরা তাঁকে বুরকিনা ফাসোর মার্ক্সবাদী বিপ্লবী আফ্রিকার চে হিসেবে পরিচিত টমাস সানকারার যোগ্য উত্তরসূরি বলে মনে করে। ত্রাওরে নিজেও বলেন, ‘সানকারা আমার নেতা।তাইতো তিনি সানকারার কবরের ওপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য একটি মেগাপ্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনেও ত্রাওরেকে সানকারার উত্তরসূরি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কের এক সিনিয়র গবেষক বেভারলি ওচিং বিবিসিকে বলেছেন, ‘ত্রাওরের প্রভাব অনেক। আমি কেনিয়া থেকেও রাজনীতিক ও লেখকদের বলতে শুনেছি, এইতো সেই মানুষ, যাকে আমরা খুঁজছিলাম।

আফ্রিকার মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এরই মধ্যে তা প্রমাণিত। সর্বশেষ অর্থাৎ অতি সম্প্রতি নিজস্ব মুদ্রানীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তিনি শুধু বুরকিনা ফাসো নয়, পুরো আফ্রিকার মুক্তি চান। চান সত্যিকার স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন, ‘যে দেশের নিজস্ব মুদ্রা নেই, সেই দেশ কিসের স্বাধীন? আমরা আমাদের মুদ্রা ছাপব। আমরা স্বাধীন হব। উল্লেখ্য, পশ্চিম আফ্রিকার সাবেক ১৪টি ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশের নিজস্ব মুদ্রা নেই। তারা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী আমলের চালু করা সিএফএ মুদ্রা ব্যবহার করে। এই মুদ্রা ছাপা হয় প্যারিসে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে। মুদ্রামানও ঠিক করে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, রিজার্ভ জমা থাকে ফ্রান্সের সেন্ট্রাল ব্যাংকে। এখানেই শেষ নয়, পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনও হয় ফ্রান্সের সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে। এই ঔপনিবেশিক অর্থ মুদ্রা ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে বুরকিনা ফাসো নিজস্ব মুদ্রা ছাপাতে শুরু করেছে। এককথায় ত্রাওরে নিজের পথে হাঁটছেন। এই পথে আফ্রিকার দেশগুলোকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করছেন। এমনকি সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোর অভিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছেন। প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন বুরকিনা ফাসো, মালি ও ঘানাকে নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের কাজ। সম্প্রতি তিনি আন্তর্জাতিক লা ফ্রাংকোফোনি থেকেও বুরকিনা ফাসোকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

ইব্রাহিম ত্রাওরে যে দুর্দান্ত সাহসী ও ঠাণ্ডা মাথার তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন তেজোদীপ্ত মানুষ, তার প্রমাণ মেলে একটি  ঘটনায়। ঘটনাটি হলো, ফ্রান্সের মালিকানাধীন দুটি স্বর্ণখনি জাতীয়করণের পর হঠাৎ করে ত্রাওরের ১৪ বছরের ছোট বোন আমানাতার স্কুল থেকে ফেরার পথে উধাও হয়ে যায়। এই ঘটনায় বাকরুদ্ধ ত্রাওরে গোয়েন্দাপ্রধানসহ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে জানতে পারেন আমানাতার আসার পথের সব সিসি ক্যামেরা একসঙ্গে বিকল হয়ে যায়। এতে তার অপহরণের বিষয়টি তিনি নিশ্চিত হন। কিন্তু এই বিষয়টি তিনি চেপে যান। তিনি বুঝতে পারেন, এটি কোনো সাধারণ অপহরণ নয়। প্রেসিডেন্টের বোন, এটি জেনেবুঝেই অপহরণ। তাই তিনি মুক্তিপণের দাবিতে টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আর সেই সঙ্গে তাঁর বাড়ির সব টেলিফোন কল বিশ্লেষণ ও ট্র্যাক করার মতো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেন। যা হোক, তিন দিন পর ফোন আসে। ফোন ধরেন ত্রাওরে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, ‘তোমার বোন সুস্থ আছে, ভালো আছে। বোনকে সুস্থ অবস্থায় পেতে হলে স্বর্ণখনি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে ইউরেনিয়াম চুক্তির আলোচনাও বাতিল করতে হবে। সময় ৭২ ঘণ্টা। এরপর তোমার বোন আর দশজন সুন্দরী তরুণীর মতোই ইউরোপীয় পুরুষদের সেবা দেবে। বয়স কম অনেক দিন সেবা দিতে পারবে। এই কথা বলে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। ফোনকল বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা ধরে নেন কলটি এসেছে আমস্টারডাম থেকে। ত্রাওরে সিদ্ধান্ত নেন তিনি তাঁর বোনসহ আফ্রিকান মেয়েদের উদ্ধারে এক সিক্রেট মিশন চালাবেন আমস্টারডামে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৮ জন গোয়েন্দার এক চৌকস দল পাঠানো হয় পর্যটকের বেশে। সেই সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে পুরো বিশ্বকে জানালেন তাঁর ১৪ বছরের ছোট বোন আমানাতার অপহৃত হয়েছে এবং তিনি জানেন তাকে কোথায় রাখা হয়েছে। এর বেশি আর একটি কথাও নয়। উদ্ধার মিশন সফল হয় মাত্র ছয় দিনে। গোয়েন্দারা আমানাতারসহ ৪৭ জন আফ্রিকান তরুণীকে উদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে বিপুল নথিপত্রসহ ২৩ জন মানব পাচারকারীকে ধরে ফেলেন। এই ঘটনায় ইউরোপে ছি ছি পড়ে যায়। আর আফ্রিকায় ত্রাওরে বিপুল প্রশংসায় ভাসেন। বুরকিনা ফাসোর মতো একটি দরিদ্র দেশ ইউরোপের একটি দেশে সিক্রেট মিশন চালাতে পারে, এটি যেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।

এই হলেন ইব্রাহিম ত্রাওরে। সাম্রাজ্যবাদের ত্রাস তাঁর মজলুম জনতার প্রিয়জন। তাইতো তিনি আফ্রিকার মুক্তিকামী তরুণদের হৃদয় জয় করেছেন। এবার দেখা যাক, তিনি আফ্রিকার মানুষের মুক্তির লড়াইকে কত দূর এগিয়ে নিতে যেতে পারেন। যদি পারনে, তাহলে তিনিই হবেন আফ্রিকার সর্বকালের সেরা নেতা।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

মন্তব্য

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

    ড. কবিরুল বাশার
শেয়ার
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

পৃথিবীর উষ্ণতম অঞ্চলের দেশগুলোতে মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর বড় আঘাতের পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানে রোগীর যে সংখ্যা দেখানো হয়, তা ঢাকার মাত্র ৭৭টি হাসপাতাল এবং অন্যান্য জেলার অল্পকিছু হাসপাতালের তথ্য।

ছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ। আবার অনেকে বাসায় থেকেও চিকিৎসা নেয়। 

পৃথিবীর ১২৯টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও এর ৭০ শতাংশই এশিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এবার ডেঙ্গুঝুঁকিতে থাকবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা সংক্রমিত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় এডিস অ্যালবোপিকটাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। এই প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসেরও বাহক।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরপৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং এর মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।

তবে কোনোভাবেই যেন মশার সঙ্গে পেরে উঠছে না মানুষ। তাই পৃথিবীর বড় বড় গবেষণা সংস্থা নজর দিয়েছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরিতে। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং এই কারণে যে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে এবং চারটি সেরোটাইপই ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক বছর গবেষণা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর বর্তমানে বিশ্বে দুটি ভ্যাকসিন বাজারজাত করা হয়েছে। ছাড়া আরো কয়েকটি ভ্যাকসিন উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
Dengvaxia (CYD-TDV) হলো সানোফি পাস্তুর কম্পানির উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম ডেঙ্গু ভ্যাকসিন, যা ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ফিলিপিন্স ব্রাজিলে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পায়। এটি একটি লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড (live-attenuated) টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন, যা চারটি ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV-1, 2, 3 I 4) টাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। Dengvaxia তিনটি ডোজে দেওয়া হয়, প্রতি ছয় মাস অন্তর করে একটি ডোজ। এটি মূলত ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।

এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে ব্যক্তির পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণের ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে (seropositive), তাদের মধ্যে Dengvaxia প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। তবে যেসব ব্যক্তি আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি, তাদের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রহণের পর গুরুতর ডেঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ Dengvaxia শুধু আগে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। জন্য এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা করতে হয়, যা বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।Qdenga, যার বৈজ্ঞানিক নাম TAK-003, জাপানের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান Takeda Pharmaceutical Company-এর তৈরি একটি নতুন প্রজন্মের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন। এটি Dengvaxia-এর তুলনায় অনেকটাই সহজ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য তুলনামূলকভাবে অধিক উপযোগী।

Qdenga- একটি লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন, তবে এটি দুই ডোজে দেওয়া হয় এবং আগে ডেঙ্গু হোক বা না হোক, সেই বিবেচনা না করেই ব্যবহার করা যায়। এটি হলো এর সবচেয়ে বড় সুবিধা।

Qdenga-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মূলত লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার উচ্চঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে সম্পন্ন হয়। ফেজ-৩ ট্রায়ালে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি প্রথম দুই বছরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, হাসপাতালভিত্তিক গুরুতর ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা ছিল প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। ছাড়া এটি seronegative seropositive উভয় শ্রেণির মানুষের জন্যই নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এটি বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগের উপযোগী। বর্তমানে Qdenga ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে অনুমোদনপ্রাপ্ত। ২০২৪ সালের মে মাসে WHO Qdenga-কে prequalified vaccine হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা এর ক্রয় এবং ব্যবহারের পথ সুগম করে।  Qdenga শিশু কিশোরদের (চার বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী) মধ্যে প্রয়োগযোগ্য। এর কোনো আগে serological পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই, যা বাংলাদেশের মতো দেশে এই ভ্যাকসিনকে বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে DENV-3 DENV-4 টাইপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হতে পারে। তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে আরো পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। ছাড়া ভ্যাকসিনের মূল্য এবং সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে; যেমনভ্যাকসিনগুলোর দাম, প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও সরবরাহ চেইন, সঠিক বয়সভিত্তিক টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ ইত্যাদি। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা না থাকলে সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হবে না। বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ অপরিকল্পিত নগরায়িত এলাকায় শুধু ভ্যাকসিন কার্যক্রম যথেষ্ট নয়, বরং এটি অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পরিপূরক হতে হবে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন আমদানি এবং প্রয়োগ করবে কি না, সেটি নানা মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। একজন পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে আমি মনে করি, এটির আমদানি এবং প্রয়োগের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যারা এটি প্রয়োগ শুরু করেছে, তাদের কাছ থেকে এর ফলাফল এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

সর্বশেষে বলা যায়, ডেঙ্গু ভ্যাকসিন বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে, বিশেষ করে Qdenga যদি দ্রুত অনুমোদিত হয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। তবে এর সফল প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা, লক্ষ্যভিত্তিক প্রয়োগ কৌশল, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি। একই সঙ্গে জোর দিতে হবে মশার বংশবিস্তার রোধ, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা এবং রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। একমাত্র সম্মিলিত প্রয়াসই পারে ডেঙ্গুর মতো জটিল ও ক্রমবর্ধমান রোগকে টেকসইভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে।

লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

professorkabirul@gmail.com

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ