<p>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস ও সুন্নত কোরআনে কারিমের পর ইসলামী শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস ও দলিল। এটি মুসলিম উম্মাহর হাজার বছরব্যাপী ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়, এতে কেউ দ্বিমত করেননি। হ্যাঁ, বর্ণনাসূত্রের সবলতা ও দুর্বলতার কারণে তার প্রামাণিকতার স্তর নির্ণিত হয়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত কোনো হাদিস ও সুন্নতের অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মত দেওয়ার কেউ দুঃসাহস করেননি। কেননা হাদিস ও সুন্নতের অস্বীকার প্রকারান্তরে কোরআনের অস্বীকার।</p> <p>কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে গত শতক থেকে কিছু লোক কোনো এক অজানা উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসের অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে আলোচনা ওঠায় এবং শুধু কোরআন মানার স্লোগান ওঠায়। এটি সর্বসম্মতিক্রমে একটি ভ্রান্ত ও কুফরি মতাদর্শ। নিম্নে সংক্ষেপে এর কিছু দলিল-প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ!</p> <p> </p> <p><strong>হাদিস ও সুন্নতের সংজ্ঞা ও অবস্থান</strong></p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত তাঁর কথা, কাজ ও সমর্থনকে ‘হাদিস’ বা ‘সুন্নত’ বলা হয়। তা কোরআনে কারিমের পর ইসলামের দ্বিতীয় প্রামাণ্য উৎস। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) ২৩ বছরব্যাপী নবুয়তি জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে কোরআনের ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আপনার প্রতি নাজিল করেছি কোরআন, যাতে আপনি মানুষকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : নহল, আয়াত: ৪৪)</p> <p>এখন প্রশ্ন হলো—রাসুলুল্লাহ (সা.) তো রক্ত-মাংসবিশিষ্ট একজন মানুষ, তাঁর জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ কিভাবে নির্বিঘ্ন দলিল হতে পারে? এর জবাব বোঝার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থান কী এবং তাঁর ব্যাপারে স্বয়ং কোরআনে কারিমে কী বলা হয়েছে, তা জানতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>কোরআনের ভাষায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থান</strong></p> <p>আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত ২১)</p> <p>অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে।’ (আহজাব, আয়াত : ৭১)</p> <p>ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ তাআলার দরবারে আকুতি জানিয়ে নিম্নের দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেবে আর তাদের পবিত্র করবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৯)</p> <p>এ দোয়ার ফলেই আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পৃথিবীতে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদের পরিশুদ্ধ করে আর তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)</p> <p> </p> <p><strong>সুরা জুমুআর ২ নম্বর আয়াতেও এ মর্মে উল্লেখ রয়েছে।</strong></p> <p>ওই আয়াতসমূহের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দায়িত্ব কেবল আল্লাহর নাজিলকৃত কোরআন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং তাঁর মৌলিক দায়িত্ব চারটি : কোরআনের পাঠ শোনানো, মানবজাতির চরিত্র ও আমল পরিশুদ্ধ করা এবং তাদের কোরআনের ব্যাখ্যা ও হিকমাহ শিক্ষা দেওয়া। যে ব্যক্তি কথা ও কাজের মাধ্যমে আমল পরিশুদ্ধ করবে, ব্যাখ্যা ও হিকমাহ শিক্ষা দেবে, তাঁর সব কথা ও কাজ দলিলযোগ্য হতে হবে, নচেৎ তাঁর দায়িত্ব কিভাবে আদায় হবে? এ জন্যই কোরআনে কারিমের প্রায় অর্ধশত আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের নির্দেশ এবং তাঁর অবাধ্যতার প্রতি নিষেধ করা হয়েছে। অতএব যারা বলবে যে কোরআন মানি কিন্তু হাদিস মানি না, তারা কোরআনে কারিমের প্রায় অর্ধশত সুস্পষ্ট আয়াতের অস্বীকারকারী। আমরা নিম্নে স্বল্প পরিসরে কিছু আয়াত উল্লেখ করছি :</p> <p> </p> <p><strong>রাসুলের আনুগত্য করতে কোরআনের নির্দেশ</strong></p> <p>আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি বলে দিন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩২)</p> <p> </p> <p><strong>সুরা আলে ইমরানের ১৩২ নম্বর আয়াতেও এ মর্মে নির্দেশ রয়েছে।</strong></p> <p>অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হলো, তবে আমি তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)</p> <p>একটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ১)</p> <p>আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দিন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে সে শুধু তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য দায়ী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য করো, তবে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৫৪)</p> <p>এ ছাড়া সুরা আহজাব, আয়াত নম্বর ৭১; সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত নম্বর ৩৩-সহ অনেক আয়াতে এ মর্মে নির্দেশ রয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>রাসুল (সা.)-এর নাফরমানি থেকে সতর্কবাণী</strong></p> <p>আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নাফরমানি করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে জ্বালাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক আজাব।’ (সুরা : নিসা, আয়াত ১৪)</p> <p>অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৬)</p> <p>আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর তা খুবই মন্দ আবাস।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১৫)</p> <p> </p> <p><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব কথা ও কাজ ওহির অন্তর্ভুক্ত</strong></p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের এত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এবং তাঁর অবাধ্যতার প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা এ জন্যই যে আল্লাহ তাআলা একেকজন মানুষকে সরাসরি হুকুম দেন না, বরং নবী-রাসুল পাঠিয়েই তাদের সব কথা ও কাজ সাধারণ মানুষকে ফলো করার নির্দেশ দেন। অতএব নবী-রাসুলের অবাধ্যতা মূলত আল্লাহরই অবাধ্যতা। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য ব্যতীত আল্লাহর আনুগত্য সম্ভব নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)</p> <p>কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুয়তি জীবনে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তাঁর নির্দেশেই বলেছেন ও করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো কেবল ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৩-৪)</p> <p>আয়াতদ্বয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথাকে ওহি বলা হয়েছে। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুয়তি জীবনে দুই ধরনের কথা বলেছেন : এক. কোরআনের আয়াতসমূহ, দুই. কোরআনের আয়াত ছাড়া অন্য কথা। এখানে শুধু কোরআনের আয়াতসমূহকে ওহি বলা হয়নি, বরং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব কথাকেই ওহি বলা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে ওহি দুই প্রকার : এক. কোরআনের আয়াতসমূহ, দুই. কোরআনের আয়াত ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্য কথা। আর এই দ্বিতীয় প্রকারের ওহিকেই হাদিস ও সুন্নাহ বলা হয়, যা আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর ঈমান আনয়নকারী সবার জন্য বিনা দ্বিধায় অনুসরণ করা অপরিহার্য।</p>