<p>বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান জাতির ইতিহাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। নতুন সরকারের মাধ্যমে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট সংস্কার করার সুযোগ এখন তৈরি হয়েছে। এই পুনর্গঠনের মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রেমিট্যান্স খাত। বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় রেমিট্যান্সের ভূমিকা শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণই আর্থিক উৎসই নয়, বরং নতুন বাংলাদেশ গঠনে এই খাতের অবদান অপরিহার্য হয়ে উঠবে।</p> <p><strong>বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা</strong><br /> কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য রেমিট্যান্স একটি ভিত্তি হয়ে উঠেছে। দেশের আয়ের একটি স্থিতিশীল উৎস হিসেবে এবং জিডিপিতে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেয়েছে এবং বিশ্বে রেমিট্যান্স উপার্জনে বাংলাদেশ এখন অষ্টম অবস্থানে। দেশের দারিদ্র্য হ্রাস, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স থেকে আসা বিশাল পরিমাণের অর্থ।</p> <p>সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দার সময়, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব অথবা আর্থিক সংকট মোকাবেলা করতে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। যেমন, ২০০৮-২০০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়, যখন অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, তখন বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ চলমান ছিল। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিও তখন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছে। এ ছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা চলমান রাখতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রেমিট্যান্স খাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবাসন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত হওয়ায় বহু বাংলাদেশির সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।</p> <p><strong>সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান এবং রেমিট্যান্সের প্রভাব</strong><br /> বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হওয়া রেমিট্যান্স খাতের ওপর এর প্রভাব ফেলে। দেশের আন্দোলনে সমর্থন জানাতে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে অর্থ পাঠানো বন্ধ করার আহ্বান জানান। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা তখন মনে করেছিলেন, তাদের পরিবারের কাছে অর্থ পাঠানো জরুরি হলেও সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা এবং নীতিগুলোর কারণে রেমিট্যান্সের অর্থ অপব্যবহার হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ দেশে সেই সময় রেমিট্যান্স প্রবাহ সাময়িকভাবে হ্রাস পেতে দেখা যায়।</p> <p>পূর্ববর্তী শাসনের পতন এবং একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আশা করা হচ্ছে যে বৃহত্তর অর্থনীতির সুবিধার জন্য রেমিট্যান্সকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে। নতুন প্রশাসন ইতিমধ্যে সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়েছে। যার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতার সঙ্গে দেশে রেমিট্যান্সের ব্যবহার করা নিশ্চিত হবে।</p> <p><strong>জাতির পুনর্গঠনের চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স</strong><br /> বাংলাদেশের এই নতুন যাত্রায় কাঠামোগত প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (এসএমই) সহায়তা এবং উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন সরকারকে অবশ্যই রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন।<br /> এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে একটি হলো ‘ট্যাপট্যাপ সেন্ড’-এর মতো ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্ল্যাটফরমের ব্যবহার। দেশে অর্থ পাঠাতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য এমন প্ল্যাটফরমগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। রেমিট্যান্স স্থানান্তরকে দ্রুত এবং আরো নিরাপদ করার পাশাপাশি ট্যাপট্যাপ সেন্ড বিদেশে অর্থ পাঠানোর ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।<br /> লেনদেনের খরচ কমাতে এবং রেমিট্যান্স ট্রান্সফারের গতি ও নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারকে অবশ্যই রেমিট্যান্স চ্যানেলগুলোকে ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে আরো যুক্ত করতে হবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকার রেমিট্যান্স প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ এবং দক্ষ করে তুলতে পারে। এতে দেশে ফেরত পাঠানো প্রতিটি ডলারের হিসাব রাখাও তখন সম্ভবপর হবে।</p> <p><strong>রেমিট্যান্সের সামাজিক প্রভাব</strong><br /> অর্থনৈতিক গুরুত্বের বাইরে, বাংলাদেশের সমাজে রেমিট্যান্স সামাজিকভাবে প্রভাবিত করে। লাখ লাখ পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আবাসন খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগও তাদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে। পুরনো, গতানুগতিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে অর্থ পাঠানোর সময় কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিক পরিমাণে ফি দিতে হতো এবং দেশে অর্থ পৌঁছাতেও বেশি সময় লাগত। ইউজার-ফ্রেন্ডলি প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে ট্যাপট্যাপ সেন্ড পরিষেবা দেওয়ায় পূর্বের এই চ্যালেঞ্জগুলো এখন আর নেই। অনেক দ্রুত এবং কম খরচে এমন প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে প্রবাসীরা এখন অর্থ স্থানান্তর করতে পারছেন, যা সরাসরি প্রেরক এবং প্রাপক উভয়কেই উপকৃত করছে। </p> <p>বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্সের সামাজিক প্রভাব আরো বেড়ে উঠবে। প্রবাসী শ্রমিকদের দ্বারা ফেরত পাঠানো তহবিল শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করবে না, এটি আয়ের বৈষম্য হ্রাস করতে এবং গতিশীলতা বাড়াতে অবদান রাখবে। কমিউনিটির উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে রেমিট্যান্সের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে, সরকার আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে সক্ষম হবে।</p> <p><strong>চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা</strong><br /> বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য রেমিট্যান্স এখন সম্ভাবনার দ্বারস্বরূপ। কিন্তু এই খাতে এখনো উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যার সমাধান করা প্রয়োজন। মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো রেমিট্যান্সপ্রবাহের জন্য তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক দেশের ওপর নির্ভরতা। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের বেশির ভাগ অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের মাত্র কয়েকটি দেশ থেকে আসে। অর্থাৎ এই কয়েকটি বাজারের অবস্থার ওপর আমাদের রেমিট্যান্স নির্ভরশীল, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি হ্রাস করতে, প্রচলিত গন্তব্যের বাইরে সরকারকে অবশ্যই নতুন বৈদেশিক বাজার খুঁজতে হবে এবং আরো বেশিসংখ্যক বাংলাদেশিকে কর্মসংস্থান খুঁজতে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলেই দেশের রেমিট্যান্স উৎসগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য আসবে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স তহবিলগুলো সসুষ্ঠুভাবে এবং টেকসইভাবে বিনিয়োগ খাতে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে রেমিট্যান্স প্রাপকদের আর্থিক সাক্ষরতা উন্নত করতে হবে।</p> <p>সরকারকে অবশ্যই রেমিট্যান্স ট্রান্সফারের উচ্চ ব্যয়ের বিষয়টিও সমাধান করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের বিশাল অংশ খরচ হয়ে যায়, যা অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের সামগ্রিক প্রভাব হ্রাস করতে পারে। রেমিট্যান্স ট্রান্সফার মার্কেটে প্রতিযোগিতার প্রচার এবং কম খরচে ডিজিটাল ট্রান্সফার সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে সরকার রেমিট্যান্স খাতে সর্বাধিক সহায়তা নিশ্চিত করতে পারে।</p> <p><strong>লেখক :</strong> অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা</p>