ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। ঘোষিত বাজেটে জনপ্রত্যাশা পূরণের বাস্তবতাসহ অর্থনীতিতে সরকারের সফলতা, ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
বিশেষ সাক্ষাৎকার
বাজেটে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে
- ড. সেলিম রায়হান

কালের কণ্ঠ : ঘোষিত বাজেট ন্যারেটিভে গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কি দেখছেন, নাকি গতানুগতিক ধারাবাহিকতাই চোখে পড়ছে?
সেলিম রায়হান : বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ উপদেষ্টার আন্তরিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁর বাস্তবভিত্তিক বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তিনি দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট—যেমন মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, বিনিয়োগে স্থবিরতা ও বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন এবং সমাধানে আগ্রহী।
কিন্তু বাজেটে এই সমস্যাগুলোর স্বীকৃতি থাকলেও কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো রয়ে গেছে। রাজস্ব সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা, ব্যয়ের অদক্ষতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা—এসব পুরনো সমস্যার বিরুদ্ধে এবারও কোনো দৃশ্যমান সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কালের কণ্ঠ : অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় আপনি কী ধরনের বাজেট প্রত্যাশা করছিলেন?
সেলিম রায়হান : আমরা এখন এক গভীর অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে আছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বন্ধের মতো পরিস্থিতি, কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ—এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের দিকে বাজেটের দৃষ্টি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি, বরাবরের মতোই রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য কিছু চেনা কৌশল, কিছু ভাতা বাড়ানো, খরচের কথা বলা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : নানা কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই বাজেট কী বার্তা দেবে? এই বাজেট কি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে?
সেলিম রায়হান : আমার মনে হয় না। বাজেটে কোনো নীতিগত বা প্রশাসনিক স্পষ্টতা নেই, যেটা দেখে বিনিয়োগকারী আশ্বস্ত হতে পারেন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—সবই বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে আছে। বাজেটে এসব সমস্যার কোনো সমাধান নেই, বরং এসব সমস্যা স্বীকারই করা হয়নি। এটা মনে রাখতে হবে, বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, এটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের দলিল। কোনো রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াই যখন একতরফাভাবে বাজেট প্রণয়ন করা হয়, তখন তা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। সংসদে খোলামেলা আলোচনা বা বিরোধী দলের মতামতের প্রতিফলন যেখানে নেই, সেখানে বাজেট রাজনৈতিক আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়। এই বাজেটও সে ধারাবাহিকতা বহন করছে। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে আমরা কোনো দিকনির্দেশনা দেখছি না; কোন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতি আসবে, কোন বার্তার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী আস্থা ফিরে পাবে? অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা একটা বড় শূন্যতা।
কালের কণ্ঠ : বাস্তবায়নের দিক থেকে বাজেটকে কতটা কার্যকর মনে করেন?
সেলিম রায়হান : বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, বাজেটের ৭৫-৮০ শতাংশই খরচ হয়। সেই খরচও হয় বছরের শেষ দিকে, যখন তাড়াহুড়া করে অর্থ ব্যয় করা হয়। এতে প্রকল্পের গুণগত মান নষ্ট হয়, সেবা পৌঁছায় না জনগণের দোরগোড়ায়। এবারের বাজেটেও মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। কাজেই বাস্তবায়নযোগ্য হলেও এটি হবে গতানুগতিক অর্থে, ভবিষ্যৎ বদলানোর অর্থে নয়।
কালের কণ্ঠ : এবারের বাজেটে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কী আছে বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম রায়হান : খুব স্পষ্ট করে বলি, এই বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কার্যকর কিছুই নেই। তারা যে সংকটে আছে, সেই সংকটকে চিহ্নিত করেই বাজেট পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে, কিন্তু বাজেটে সেই চাপ লাঘবে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেই। বরং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে কিছু স্কিম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর মানে হলো, যাঁরা সবচেয়ে বেশি সহায়তার দাবিদার তাঁরাই এবার বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা যদি সত্যিই বৈষম্য কমাতে চাই, তাহলে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোনো টেকসই রোডম্যাপ নেই। যুবসমাজের জন্য দক্ষতা উন্নয়নের যে সম্ভাবনা সেটাও বাজেটে প্রায় অনুপস্থিত। এই জায়গাগুলোতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে শুধু ভাতা বা পরিসংখ্যান দিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করা যায় না। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর জন-আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার খাতে অধিক অগ্রাধিকার দেখার। কিন্তু বাজেট এসব খাতকে প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকারেও নেয়নি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সংকটের সময়েও সামাজিক খাতের বরাদ্দ কমেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সংকট মোকাবেলায় যে মানবিক সংবেদনশীলতা প্রত্যাশিত ছিল, সেটি এই বাজেটে অনুপস্থিত। এর ফলে যাঁদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার ছিল, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থাকছেন।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু সরকারের বক্তব্য হলো—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আপনি একমত?
সেলিম রায়হান : আমি একমত নই। যে কিছু মাসে কিছুটা স্থিতি এসেছে, সেটি মৌসুমি কারণে, রমজান ও ঈদের প্রভাব। কিন্তু আসল জায়গায়, অর্থাৎ খাদ্য সরবরাহ, বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ, সেখানে এখনো কাঠামোগত কোনো সমাধান হয়নি। কোনো কোনো জায়গায় দাম আবার বাড়ছেও। এবং এটা এমন এক দেশে ঘটছে, যেখানে বাজারে অতি মুনাফা, লোপাট, সরবরাহ ঘাটতি এবং করের বোঝা মিলেমিশে সাধারণ মানুষকে পিষ্ট করছে।
কালের কণ্ঠ : গত জানুয়ারিতে সরকার রুটি, পাউরুটি, কেক-বিস্কুটের মতো নিত্য খাদ্যপণ্যে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছিল। পরে সমালোচনা হওয়ায় তা ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছিল। বাজেটে এই ভ্যাট বাড়ানো না হলেও আগের ভ্যাট অব্যাহত আছে। আপনি কী মনে করেন?
সেলিম রায়হান : এটা নিছক অন্যায়। এই পণ্যগুলো দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের নিত্যদিনের খাবার। অনেকে দুপুরে ভাত না খেয়ে বিস্কুট বা পাউরুটি খেয়ে কাজ চালান। এসব পণ্যে ভ্যাট বসানো মানেই গরিবের পেটে লাথি মারা। অথচ সুপারশপে ৫ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেওয়া হয়েছে। এটা একেবারে স্পষ্ট বৈষম্য। আমি আবারও বলছি, বাংলাদেশে রাজস্বের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে, যা মূলত গরিবের ঘাড়ে চাপানো হয়। এটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে এই রাষ্ট্র গরিববান্ধব বলে দাবি করার কোনো অধিকার রাখে না।
কালের কণ্ঠ : তাহলে করনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আপনি দেখতে চান?
সেলিম রায়হান : প্রথমত, পরোক্ষ করনির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ধনীদের আয়ের ওপর কর বাড়াতে হবে। যাঁরা কর ফাঁকি দেন, যাঁদের কালো টাকা আছে, যাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আমরা দেখি বাজেটে বরং কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক প্রস্তাব আসছে। এটা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহ করে এবং সামগ্রিকভাবে করনীতিকে দুর্বল করে। আমরা বহুবার বলেছি, যারা কর ফাঁকি দেয়, যাদের আয়করের আওতায় থাকা উচিত কিন্তু নেই, তাদের বাদ দিয়ে রাজস্ব পরিকল্পনা করলে সেটা কখনোই দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে না। বাস্তবায়নযোগ্য করনীতি মানে হলো ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা, অথচ বাজেটে সে চেষ্টা নেই।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে। আপনি কি মনে করেন করনীতি এই ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে?
সেলিম রায়হান : একদম তাই। করনীতি যখন ভ্যাটের মাধ্যমে দরিদ্রের খাদ্য কেড়ে নেয়, সেটা শুধু রাজস্ব নয়, মানবিক মূল্যেও ভয়াবহ। বাজেটে পুষ্টি, শিশুখাদ্য, কৃষি উৎপাদন বা সাশ্রয়ী খাদ্যপ্রাপ্তির কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেই। এটা বুঝতে হবে—রুটি, বিস্কুট, কেক গরিবের জন্য বিলাস নয়, এটা তাদের ভাতের বিকল্প।
বিশ্বব্যাংকের সতর্কতার পেছনে বাস্তবতা আছে। আমাদের কৃষি খাত বঞ্চিত, কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অথচ ভর্তুকি কমছে। খাদ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ, অথবা দরিদ্র শ্রেণির জন্য ন্যায্যমূল্যের রেশনিং—কোনো কিছুতেই বাজেটে উল্লেখযোগ্য অগ্রাধিকার নেই। এটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এক ধরনের সামাজিক অমনোযোগ। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়।
কালের কণ্ঠ : মধ্যবিত্তদের অবস্থাও তো খুব একটা ভালো না। আপনি তাদের জন্য বাজেটে কী দেখছেন?
সেলিম রায়হান : আসলে মধ্যবিত্ত এখন সবচেয়ে বেশি চাপে আছে। একদিকে আয় বাড়ছে না, অন্যদিকে ব্যয় দ্রুতগতিতে বাড়ছে—বিশেষ করে নগরজীবনে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, অথচ সামগ্রিকভাবে তাদের করের বোঝা কমছে না। বরং শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসাভাড়া—সব কিছুতেই ব্যয় বেড়েছে। তারা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় পড়ে না, আবার ধনীদের মতো কর ছাড়ও পায় না। কর্মসংস্থানের অভাব, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে মধ্যবিত্তের ওপরও চাপ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এই চাপ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা সামাজিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে। আরেকটা ব্যাপার হলো—রাষ্ট্র এই শ্রেণিকে কার্যত অদৃশ্য মনে করে। তারা নিয়মিত কর দেয়, সরকারি সেবা চায়, কিন্তু নীতিনির্ধারণে এই শ্রেণির জায়গা কোথায়? চিকিৎসায় সরকারি বিনিয়োগ নেই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সুলভে কেনার নিশ্চয়তা নেই, বাসস্থানের কোনো পরিকল্পনা নেই। বাজেট দেখে মনে হয়, মধ্যবিত্ত শুধু ‘রাজস্বের উৎস’, নাগরিক নয়। এটা দীর্ঘ মেয়াদে একটি গভীর আস্থাহীনতার জন্ম দেবে।
কালের কণ্ঠ : বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপনি এটাকে কিভাবে দেখেন?
সেলিম রায়হান : এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে খতিয়ে দেখা দরকার ছিল ভর্তুকি কাদের কাছে পৌঁছায়, আর কাদের লাভ হয় বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, গরিব মানুষ এই ভর্তুকির পুরো সুবিধা পান না। আবার শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হলে তার প্রভাবও গরিবের জীবনেই পড়ে। এখন যদি হঠাৎ ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির চাপ আরো বাড়বে। সমস্যা হলো, সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপচয়প্রবণ জ্বালানি খাত সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে যদি মূল্যবৃদ্ধির পথ নেয়, তবে আমি বলব, শাসনব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া ভর্তুকি কমালে মানুষ শুধু দামই পাবে, গুণমান নয়, স্বস্তিও নয়।
কালের কণ্ঠ : আপনি বলেছিলেন বাজেটে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলার কোনো পরিকল্পনা নেই। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
সেলিম রায়হান : বাজেট শুধু অর্থনৈতিক দলিল নয়, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তাও দেয়। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। কিন্তু আমরা দেখছি না যে বাজেট প্রণয়নের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সংলাপ হয়েছে, ভবিষ্যতের সরকার এই বাজেট বাস্তবায়ন করবে কি না, সেই আস্থা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে। বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমন-পীড়ন এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা আরো গভীর হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাজেটের ঘোষণাগুলো কার্যত অকার্যকর রয়ে যায়।
কালের কণ্ঠ : সব মিলিয়ে আপনি কি মনে করেন এবারের বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য?
সেলিম রায়হান : বাস্তবায়নের অর্থ যদি হয় আগের মতো ৭৫-৮০ শতাংশ খরচ করা, তাহলে সেটা সম্ভব। কিন্তু বাজেটের প্রকৃত উদ্দেশ্য, জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, সেটা সম্ভব হবে না। কারণ বাজেটে নেই কাঠামোগত সংস্কার, নেই জনগণের চাহিদার প্রতিফলন, নেই আস্থার জায়গা তৈরি করার কোনো রোডম্যাপ।
আমি বহুবার বলেছি সংখ্যার অঙ্ক মেলানো মানেই বাজেট নয়। আমাদের দরকার ছিল করব্যবস্থায় সংস্কার, মন্ত্রণালয়গুলোর বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানো এবং প্রকল্প খরচে স্বচ্ছতা আনা। পরিকল্পনা কমিশন বা অর্থ মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রকল্প গৃহীত হয়, তার বাস্তবতাও অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ। যখন বছরের শেষদিকে হুটহাট করে টাকা খরচ হয়, তখন জনগণ উন্নয়ন নয়, শুধু ব্যয় দেখতে পায়। এটা পাল্টাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সম্পর্কিত খবর

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা
- ড. ফরিদুল আলম

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের মজুদ করা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না বা আদৌ এর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তাঁরা কিছু স্পষ্ট করেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খুব একটা ক্ষতি হয়নি এবং তারা কয়েক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট্রিফিউজগুলো মেরামত করে নতুন করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।
আইএইএ, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল, কাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক, তা পরিষ্কার নয়। তবে মার্কিন বিমান হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএকে আর কোনো ধরনের সহায়তা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই বলুন না কেন যে তাঁর দেশের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, বাস্তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তামুক্ত নন, এর আভাস পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে।
ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিষয়টি এখনো বহাল রয়েছে, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো করে জানে যে তাদের এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতি তারা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশটির ভেতরে ব্যাপক জন-অসন্তোষ থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন বিপন্ন হতে বসে, তখন ইরানিরা সবাই এক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়। ইরানের সাবেক শাহর নির্বাসিত পুত্র রেজা শাহকে নিয়ে ইসরায়েল এবং পশ্চিমারা আবারও ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইলেও ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং প্রাণহানি নিয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রশংসা করে সরকারবিরোধীদেরও রোষানলে পড়েছেন। পশ্চিমারা রেজা শাহকে সামনে নিয়ে ইরানে নতুন করে কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা অনিবার্য। তবে ইরানকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানো দেখাটাও তাদের জন্য এক চপেটাঘাতের শামিল। আর সে জন্যই ইরানের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত এটি শঙ্কা করছেন যে আইএইএকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে না—এমন অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আবারও ইরানে হামলা করে বসতে পারে।
ইরানের অবস্থানকে সুবিধার মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তে। গত ৪ জুলাই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এত দিন ধরে চাউর ছিল যে ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শ্যাডো ফ্লিটের (গোপন জাহাজ) মাধ্যমে ইরান এই রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জানা গেছে, ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ সাঈদীর মালিকানাধীন বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেল ইরাকের তেলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আরব আমিরাত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়ে আসছে, যার মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী সালেহর কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যেন ইরান এভাবে বাণিজ্য করে এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তা সামরিক খাতে ব্যয় করতে না করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে তাকে বিরত রাখতে হলে সর্বাগ্রে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জায়গায় আঘাত করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা থেকে যায়, যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এটি ইরানের অর্থনীতিতে যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য, সেটি খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
মোটকথা হচ্ছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন কথা হচ্ছে, ইরান যদি এমনটা মনে করে থাকে যে তারা আবারও সম্ভাব্য হামলা থেকে নিরাপদ নয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষার ধরন কেমন হবে? এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কয়েকটি অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত, হরমুজ প্রণালি ঘিরে তারা তাদের কৌশলকে শাণিত করতে পারে, যেন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে পারে; দ্বিতীয়ত, তাদের নতুন করে আরো উন্নতমানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে; তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রযুক্তির বিপরীতে নিজেদের প্রযুক্তি দুর্বল—এই বাস্তবতার আলোকে এটিকে আরো উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা নিতে পারে এবং চতুর্থত, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের চলমান কৌশলগত সম্পর্ককে আরো কার্যকর করার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্নত করা এবং ইসরায়েলের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে, ইরানকেও এমন পাশে থাকার মতো বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের আপাত অবসান হতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটি মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বরং হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর দুর্বলতার এই সুযোগে ইরানকে আরো পর্যুদস্ত করার নতুন চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা খুব ভালো করেই জানে এই সময়ে এসে তারা যদি ইরানকে ছাড় দেয়, তাহলে ইরান দ্রুতই আরো শক্তি সঞ্চয় করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। এসব যুক্তিতে ইরানে ফের হামলার শঙ্কা থেকেই যায়।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com

ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে
- ড. মো. শফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান। অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলো ভালো পারফরম করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যদিও এই সমস্যাটি অতীতের জের ধরেই তৈরি। খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে কিছু ব্যাংকের অতীতের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১২ শতাংশ। জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অনেক ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে, যা তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও কমিয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব একটি বড় সমস্যা। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে, যা দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করে। ব্যাংকিং খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি বাড়তে থাকবে, যা ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমাবে।
বিগত এক দশকের খেলাপি ঋণ অনুপাতের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ আদায়ে অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থার কারণে ওই অনুপাত ২০১৪ সালের ৬.১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১০.৩০ শতাংশে পৌঁছে। এরপর অনুপাত একটু কমে ২০২০ সালে হয় ৭.১০ শতাংশ।
উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের আস্থায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সঞ্চয়ের নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ব্যাংক, এমনকি অনানুষ্ঠানিক, অনিয়ন্ত্রিত চ্যানেলে স্থানান্তর বা জমা করতে তাঁরা প্ররোচিত হতে পারেন, যা বেসরকারি ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ। সীমিত ঋণপ্রবাহ শিল্প উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তোলে। যখন খেলাপিরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তখন এটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।
বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদাররা দেশের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে, যা ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদি কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক গতিপথ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আইন ভঙ্গের চর্চার জন্য ব্যাংকিং খাতের আজকের এই পরিণতি, যা থেকে এ খাতের উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া ব্যাংক প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করা, ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের নাম প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ঋণ মূল্যায়ন এবং ডিজিটাল ঋণ পর্যবেক্ষণের মতো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নানাভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি
- ড. সুলতান মাহমুদ রানা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল—এই দুটি ‘টাইমফ্রেম’ বা সময়সীমা সামনে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং তেমনি সরকারের সঙ্গেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটিও এখন অনুমান করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।
দেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সংশয় রয়েছে। নির্বাচনের সময় ও অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকতে হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা লক্ষ করছি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংস্কার এবং বিচারের আগে নির্বাচন না দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনকি এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র না দিলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচন বিষয়ে ধীরগতিতে আগাতে চান। কারণ তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে নবগঠিত দলের ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা এবং ভোটারদের কাছে তাঁদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে আগাতে চায়। জামায়াত সংস্কার প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের লক্ষ্যে সব দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবে—এটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায়, তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি উপযুক্ত হবে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও যদি প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলেই নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সব পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের উপযুক্ত ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভর করে।
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত, নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।
অবশ্য রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনাও জরুরি। আর তা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবে—এমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।
আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব, আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে অতীতের অনেক আচরণ বদলানোর প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা বা প্রতিহিংসা নয়। রাজনীতি মানে ভদ্রতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা অপেক্ষাকৃত উন্নত, ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য