২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সওজ অধিদপ্তরের ৯০ শতাংশ কাজ পেয়েছিল। ওই সময় বিভিন্ন প্রকল্পে সওজ প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। তার মধ্যে ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ পায় ওই ১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অথচ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে হাজারের ওপরে।
সড়ক ভবন লুটেছে ১৫ ঠিকাদার
- নেপথ্যে ছিলেন সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি নিজাম হাজারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটনও
বিশেষ প্রতিনিধি

সওজ সূত্রে জানা গেছে, বেশি কাজ পাওয়া ১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি), ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এমএস সালেহ আহমেদ, এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। কাজ পেতে অনিয়মের জেরে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫ প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। তাতে শীর্ষ এই ১৫টির মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান ছিল।
১৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান : ২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে সড়কের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা হাসান টেকনো বিল্ডার্স পায় ১১ হাজার ১১৮ কোটি এবং রানা বিল্ডার্স পায় ১০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কাজ। হাসান টেকনোর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হাসান এবং রানা বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আলম সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। জালিয়াতির অভিযোগে এ দুই প্রতিষ্ঠানকেই কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মো. আলমের ভাতিজা জুলফিকার হোসেনের প্রতিষ্ঠান মাসুদ হাইটেক চার হাজার ৩৮১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিল। জুলফিকারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সাগর ইনফো বিল্ডার্স ৩৯টি কাজ পায়। এসব প্রতিষ্ঠান এনডিইর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। ১৫ প্রতিষ্ঠানের একটি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) ২০১৭ সাল থেকে সওজ অধিদপ্তরে কাজ বাগিয়ে নিতে শুরু করে। ছয় বছরেই এটি বাগিয়ে নেয় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কাজ। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে সড়ক ভবনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। সওজ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওবায়দুল কাদের আগেই সবুজ সংকেত দিয়ে রাখতেন, তাতেই কাজ পেত এনডিই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের আশীর্বাদ ছিল এনডিইর কর্ণধারদের ওপর। সওজ সূত্র জানায়, জাল ও ভুয়া নথি জমা দিয়ে কাজ নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়ে গত বছরের ৬ জুলাই ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এনডিইকে। তখন তারা উচ্চ আদালতে যায়। আদালত নিষিদ্ধ করার ওপর স্থগিতাদেশ দেন। মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল ইসলাম বাগেরহাটের সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই ঘনিষ্ঠতায় পেতেন কাজ। মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ছয় হাজার ৫৩১ কোটি টাকার কাজ করেছে। মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড কাজ করেছে ছয় হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার। মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড পায় চার হাজার ৫৪৯ কোটি টাকার কাজ। এমএস সালেহ আহমেদ দুই হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার কাজ পায়। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সালেহ আহমেদ ছিলেন ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর ঘনিষ্ঠ। নেপথ্যে থেকে প্রতিষ্ঠানটি চালাতেন নিজাম হাজারী। রিলায়েবল বিল্ডার্সকে দুই হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব্বাধিকারী শফিকুল আলম আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়ার। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে দুই হাজার ৩০৯ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন সহজেই। মাহফুজ খান লিমিটেড দুই হাজার ২৮১ কোটি টাকার পায়। এটির মালিক মাহফুজ খান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ। আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ছয় বছরে এক হাজার ৯১৪ কোটি টাকার কাজ পায়। কাজ পেতে ওবায়দুল কাদেরের ভাগ্নে পরিচয় দিতেন আবেদ মনসুর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পিয়ন’ জাহাঙ্গীর আলমের তদবিরে জে এন্টারপ্রাইজ প্রায় ১৯৭ কোটি টাকার কাজ।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের মধ্যে ১৩ বছর সড়কমন্ত্রী ছিলেন ওবায়দুল কাদের। তাঁর অধীনে থাকা সওজ অধিদপ্তরে ঠিকাদারি কাজ পেতে ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য হয়েছে অবাধে। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সর্বশেষ গবেষণায় বলেছে, নিজ দলের নেতা, ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের প্রকল্প ব্যয়ের ১০ থেকে ২০ শতাংশ দিতে হয়েছে কমিশন বাবদ। প্রকল্পের ব্যয়ে ঠিকাদারদের লাইসেন্স ভাড়া, কার্যাদেশ বাণিজ্য, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজিতে ৬ শতাংশ টাকার অনিয়ম হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, সওজের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়ের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে। এই দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন কাজের তদবিরকারী, প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা।
গত ৯ অক্টোবর প্রকাশিত ‘সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, প্রকৌশলী-ঠিকাদারদের যোগসাজশে উন্নয়ন প্রকল্প ছক বা ডিপিপি তৈরি করা হতো কয়েক দিনে। ফরমায়েশি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন প্রণয়ন করে তা ডিপিপির সঙ্গে জমা দেওয়া হতো। প্রকল্পের কাজ হাতে রাখতে সওজের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যালয়প্রধান নিজে ডিপিপি তৈরি করতেন। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প অনুমোদন সভায় ডিপিপির ওপর পর্যবেক্ষণ জানতে সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুই থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের চক্রও জড়িত ছিল।
ডিপিপি প্রণয়নে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য ২৫-৩০ শতাংশ বাড়তি ব্যয় প্রাক্কলন করা হতো। সওজের স্থানীয় দপ্তর ডিপিপি তৈরি করার সময় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদাররা নিজেদের লাভের অংশ নিশ্চিত করতেন। অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু হতো ডিপিপি তৈরি থেকে। একাধিক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, কোনো কোনো কাজ অতিরিক্ত হিসেবে ধরা আছে, যা করতে হবে না; কোন খাতে কত টাকা বাঁচানো যাবে; প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা আগেই জানতেন। প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় কত ধরতে হবে, তা প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা বসে ঠিক করতেন।
সরকারি ক্রয় আইন (পিপিএ) ২০০৬ এবং সরকারি বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮ অনুযায়ী, দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। টিআইবির সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেছেন, কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলেও দুর্নীতিতে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই। চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলেও সওজ কর্মকর্তাদের পক্ষে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই কথা বলতে রাজি হননি। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেদের ওয়েবসাইটে তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ মিথ্যা বলে তাদের বিবৃতি প্রকাশ করেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিইর কর্ণধার রায়হান মোস্তাফিজ ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পতিত সরকারের সাবেক চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্ক ব্যবহার করেও রায়হান কাজ বাগিয়ে নিতেন। এ ব্যাপারে এনডিইর পক্ষ থেকে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁর বদলে এই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সোয়েব আহমেদ। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি আইন ও বিধি অনুসরণ করেই কাজ দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। পরে যখন দেখা গেল তার মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান আবার উচ্চ আদালতেও গেছে। তিনি বলেন, যে ১৫ প্রতিষ্ঠান বেশি অর্থের কাজ পেয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই দেশীয় অর্থায়নের প্রকল্পে কাজ করেছিল।
সম্পর্কিত খবর

জামায়াতের সমাবেশ আজ
১০ লাখের বেশি লোক সমাগমের লক্ষ্য
বিশেষ প্রতিনিধি

দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আজ শনিবার আয়োজন করতে যাচ্ছে তাদের জাতীয় সমাবেশ। এবারই প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সর্ববৃহৎ জনসমাগমের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে দলটি। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে নানামুখী প্রস্তুতি।
সমাবেশ শুরু হবে দুপুর ২টায়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সমাবেশ উপলক্ষে প্রায় ১০ হাজার বাস, বিশেষ ট্রেন ও লঞ্চে আসবেন নেতাকর্মীরা। ১০ লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম আশা করছে দলটি।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানিয়েছেন, বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে সমাবেশে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের শহীদ পরিবার ও আহতরাও থাকবেন সম্মানিত অতিথি হিসেবে।
সমাবেশের মূল লক্ষ্য ৭ দফা দাবি জনসমক্ষে উপস্থাপন ও আদায়ের অঙ্গীকার।
জাতীয় সমাবেশ সফল করতে কাজ করছে একটি মূল বাস্তবায়ন কমিটি এবং অধীন আটটি উপকমিটি। দেশের সর্বত্র পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন, ভ্রাম্যমাণ মাইক এবং সাংস্কৃতিক দল নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে। গান, নাটিকা আর স্লোগানে সমাবেশের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগর থেকে গ্রামান্তরে।
সমাবেশস্থলে থাকবে কড়া নিরাপত্তা।
অতিথিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে থাকবে ১৫টি মেডিক্যাল বুথ, প্রতিটিতে দুজন এমবিবিএস চিকিৎসক, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও অ্যাম্বুল্যান্স সুবিধা।
বৃহৎ জনসমাগমের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হবে ড্রোন ও ক্যামেরা, যা প্রদর্শিত হবে এলইডি স্ক্রিনে এবং একযোগে প্রচারিত হবে ফেসবুক ও ইউটিউবেও।
এর আগে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, সড়ক, রেল ও নৌপথে সারা দেশ থেকে ঢাকামুখী হবেন লাখো মানুষ। তিনি নগরবাসীর কাছে সম্ভাব্য যানজট ও ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা
পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা দেখছে না বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায় না বিএনপি। দলটি সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চেয়ে আসছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আগামীর সংলাপে আবার যথারীতি তাদের আগের এ অবস্থানই তারা তুলে ধরবে। এ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশন নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব করলে, সেটার বিরোধিতা করবে না দলটি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে ৩১ দফার আলোকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই অঙ্গীকার রক্ষা করবে।
সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনার বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, আমরা সেই জায়গাতেই আছি। আমাদের ৩১ দফার ভিত্তিতে আমরা যে আইডিয়া নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বলেছিলাম, সেটি হলো—যাঁরা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন, যাঁদের জাতি গঠনে অবদান আছে এবং যাঁরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তাঁদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার অবদান যেন জাতি গঠনের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়। জাতি যাতে সমৃদ্ধ হয়, সেই আইডিয়া থেকেই আমরা এই প্রস্তাবটি রেখেছিলাম।
এর আগে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো। পরে গত সপ্তাহের সোমবার ঐকমত্য কমিশন ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশন থেকে একজন করে নির্বাচিত সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের বিকল্প প্রস্তাব করলেও তা সরাসরি নাকচ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল।
পরদিন মঙ্গলবার কমিশনের সংলাপে বিএনপিসহ পাঁচটি দল প্রস্তাব করে, সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে।
দীর্ঘ আলোচনায়ও সদস্যরা কিভাবে নির্বাচিত হবেন—এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হওয়ায় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবই বাদ যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী সপ্তাহে সংলাপে উচ্চকক্ষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কমিশন মনে করে, সমাজে বিরাজমান বৈচিত্র্যকে প্রতিনিধিত্ব করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজন রয়েছে।
অন্যদিকে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলো একমত। তবে সংসদের উচ্চকক্ষের মতো নারী সংসদ সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও একমত হতে পারেনি দলগুলো।
কমিশনের প্রথম প্রস্তাব ছিল, সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা হবে। ১০০ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে শুধু নারীরা প্রার্থী হবেন। এতে ঐকমত্য না হওয়ায় গত সোমবার কমিশন প্রস্তাব করে ২৫টির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে—এমন দলগুলো অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী দেবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এ প্রস্তাব নাকচ করে। বিএনপি আগের মতোই জানায়, নারী আসন ১০০ করতে একমত হলেও নির্বাচন হতে হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে অর্থাৎ কোনো দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের আসন সংখ্যার অনুপাতে।
জামায়াত জানায়, পিআর (ভোটের অনুপাতে) পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হলে তারা আসন বৃদ্ধিতে রাজি। এনসিপি নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের নতুন ফর্মুলা দেয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংসদে নারী সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নেতারা অভিমত দেন, তাঁরা নারীর ক্ষমতা ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনসংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ১০০টির মধ্যে ৫০টি নারী আসন সংরক্ষিত চাইবে। আর বাস্তবতার নিরিখে ধাপে ধাপে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন চাইবে। এর অংশ হিসেবে আগামী নির্বাচনে ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫টি আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং পরবর্তী নির্বাচন অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে ১০% মানে ৩০টি আসনে সরাসরি নির্বাচন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দলটি তাদের মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি আছে। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না।
স্থায়ী কমিটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, যদি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যাপক বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে, সেটা অকার্যকর হয়ে পড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য বলেন, আগামীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কিংবা সংসদীয় সরকার—যে পদ্ধতিই করা হোক, সরকারপ্রধানকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। তবে আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নিয়ে আগামীতে আরো আলোচনা হবে।

সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা
গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল
নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. আশরাফুল হুদা বলেছেন, গোপালগঞ্জের ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা ছিল। তিনি আরো দাবি করেন, জুলাই চেতনা নস্যাৎ করে ‘পতিত প্রধানমন্ত্রীকে’ পুনর্বাসন ও জাতীয় নির্বাচন পেছানোর একটি চক্রান্ত চলছে, গোপালগঞ্জের ঘটনা তারই অংশ।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর এফডিসিতে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’ আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সাবেক আইজিপি বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর থাকলে গোপালগঞ্জের মতো এত বড় ঘটনা ঘটত না।
সোহাগ হত্যা প্রসঙ্গে আশরাফুল হুদা বলেন, শহরের কেন্দ্রস্থলে হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর পুলিশের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। দুই দিন পর বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের তৎপরতা শুরু হয়, এটা দুঃখজনক।
‘মব ভায়োলেন্স’ প্রসঙ্গে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সব সময় ভুক্তভোগীরাই মব ভায়োলেন্স করে না, অনেক সময় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যও এটি সংঘটিত হয়। কেউ কেউ পরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।’
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা মব সন্ত্রাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ—এ বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত ছায়া সংসদে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকদের হারিয়ে বিজয়ী হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের বিতার্কিক দল।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, মব সন্ত্রাস জাতীয় জীবনে এক নতুন আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশটা যেন ‘মবের মুল্লুকে’ পরিণত হচ্ছে। এটি গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে কলঙ্কিত করছে। সমাজের ক্যান্সার হিসেবে এই সংস্কৃতি বন্ধ করা না গেলে জনজীবনে আতঙ্ক আরো বাড়বে।

মার্কিন কূটনীতিকদের প্রতি ট্রাম্প
অন্য দেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

অন্য দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য না করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাসগুলোতে তারবার্তা পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। তারবার্তায় বলা হয়েছে, কোনো দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি হয়নি, এই নিয়ে কোনো দেশের মার্কিন দূতাবাস বা রাষ্ট্রদূত যেন মন্তব্য না করেন। গত ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছে এই তারবার্তা।
এতে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে সেই দেশের মার্কিন দূতাবাস কিংবা ওয়াশিংটন থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হবে না।
তারবার্তায় আরো বলা হয়েছে, ‘কোনো দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি হয়নি, বৈধ হয়েছে কি হয়নি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে সমুন্নত রাখতে পেরেছে কি পারেনি—এসব নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিকরা আগ বাড়িয়ে মন্তব্য তো করবেনই না, এমনকি কোনো পক্ষ প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তা এড়িয়ে যেতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’
তারবার্তায় বলা হয়, ‘অবশ্য কোনো দেশের নির্বাচন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত স্পষ্ট ও বাধ্যতামূলক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে, তাহলে এই নির্দেশনার ব্যতিক্রম ঘটবে; তবু সে ক্ষেত্রে ওই দেশের মার্কিন দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত বা কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকরা কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানাবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত মুখপাত্ররা প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
তারবার্তায় আরো বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে এবং তা উদযাপনও করছে। অন্যান্য দেশও একই পথ বেছে নিয়েছে। আমাদের প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে বলেছেন, যেকোনো দেশ, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, সেই দেশের সঙ্গে তিনি মার্কিন অংশীদারি বিস্তারের পক্ষে।’ সূত্র : রয়টার্স