<p>কেফিয়াহ সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিধান করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনিদের পরিচয় এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে এটি জ্বলে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ মিছিল চলছে ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। ৭ আক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর ফিলিস্তিনে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীরা গলায় বিশেষ স্কার্ফ বা কেফিয়াহ পরছে।</p> <p>ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানাতে কেউ এই স্কার্ফটি তাদের গলায় জড়ায়, কেউ বা মাথায় বাঁধে বা মুখ ঢাকতেও ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির প্রতীক হিসেবে কাপড়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্ব আছে স্কার্ফটির। কিন্তু কেফিয়াহ কোথা থেকে এসেছে?</p> <p>বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, কৃষক এবং আরব বেদুইনরা (যাযাবর আরব) সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, গরম বাতাস, মরুভূমির বালি এবং ঠাণ্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কেফিয়াহ পরিধান করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে স্কার্ফটি। পশ্চিমা বিশ্বেও  স্কার্ফটি ফ্যাশনেবল অনুষঙ্গে পরিণত হয়। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফিলিস্তিনি-কানাডিয়ান সাংবাদিক এবং নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি প্রার্থী মাজিদ মালহাস বলেছেন, ‘মূলত রাখাল এবং যাযাবর কৃষকরা কেফিয়াহ পরিধান করলেও বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতাবিরোধী বিপ্লবী এবং কর্মীরা এই স্কার্ফ পরিধান শুরুর করেন। যা একটি আইকনিক পোশাক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখনো প্রবীণ এবং কৃষকরা এই ঐতিহ্যবাহী  কেফিয়াহ পরিধান করেন।’ গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত পশ্চিমের অনেক তরুণ পুঁজিবাদী সংস্কৃতি এবং ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জানাতে সামরিক ধাঁচের পোশাক পরিধান করত। একইভাবে কেফিয়াহ মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।</p> <p>ইতিহাসবিদদের মতে, কেফিয়াহর ব্যবহার শুরু হয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ইরাকের কুফা শহরে। সেই শহরের নাম থেকেই স্কার্ফটির নাম হয়ে যায় কেফিয়াহ। অনেকের মতে, আরো প্রাচীন আমল থেকে কেফিয়াহর প্রচলন শুরু হয়েছে। সম্ভবত সেটা ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভের আগেও ছিল। কিন্তু অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৩০-এর দশকে ফিলিস্তিনি সমাজে কেফিয়াহ একটি আলাদা স্থান পায়। তখন থেকে এর গুরুত্ব এবং ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।</p> <p>ফিলিস্তিনে এর ব্যবহার শুরুর পেছনেও একটি গল্প আছে। ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল ফিলিস্তিন। ব্রিটিশদের আধিপত্য স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা ভালোভাবে নেয়নি। কারণ তারা মনে করেছিল, ব্রিটিশরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক আন্দোলন জায়নবাদী বা ইহুদিবাদী প্রকল্পকে সমর্থন করছে। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ জেন টাইনান বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিরা ব্রিটিশদের উপস্থিতির কারণে খুব হতাশ হয়ে পড়ছিল। তখন কারা কারা প্রতিরোধ করছিল তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। এতে বিদ্রোহীদের পক্ষে চলাফেরা করা ও তাদের কার্যকলাপ চালানো সহজ হয়ে যায়। তখন থেকে কেফিয়াহ বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এবং এই স্কার্ফটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কৌশলের অংশ হয়ে ওঠে।’</p> <p>১৯৩৮ সালে থেকে বিদ্রোহী নেতারা শহরে বসবাসকারী আরবদের কেফিয়াহ পরিধান করার নির্দেশ দেন। স্কার্ফটি এতটাই প্রচলিত হয়েছিল যে পরে ব্রিটিশরা কেফিয়াহ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সফল হয়নি তারা। ‘আ সোশিও পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব কেফিয়াহ’-এর লেখক অনু লিঙ্গালার মতে, কেফিয়াহ একটি কার্যকর সামরিক কৌশলের অংশ ছিল। কিন্তু এটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রদর্শনের প্রতীকও হয়ে ওঠে।’ তাঁর মতে, ‘১৯৩৮ সালে এই স্কার্ফটি ফিলিস্তিনি সংস্কৃতিতে গুরুত্ব পেয়েছে। একে ফিলিস্তিনি সংস্কৃতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।’</p> <p>ফিলিস্তিনি কেফিয়াহর কালো এবং সাদা নকশাটি ইরাক থেকে ব্রিটিশ শাসনের সময় এই অঞ্চলে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। কেফিয়াহ বিভিন্ন রং এবং ডিজাইনের হয়। এর মধ্যে সাদা-কালো কেফিয়াহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জলপাইপাতা, লাল রং ও কালো রেখা। জলপাইপাতা এই অঞ্চলের জলপাইগাছের প্রতীক, পাতা জমির সঙ্গে শহরের সম্পর্কের প্রতীক আর লাল রং ফিলিস্তিনি জেলে এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে তাদের সংযোগের প্রতীক। কালো রেখা ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী অংশীদারদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য পথের যোগাযোগের প্রতীক।</p> <p>কেফিয়াহ ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক স্পটলাইটে এনেছিলেন। এটি ছাড়া তিনি জনসমক্ষে খুব কমই আসতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার সময় কেফিয়াহ পরেছিলেন। তখন থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও এখন এটি একটি ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক। ফিলিস্তিনিরা কেফিয়াহকে উচ্চ সম্মান ও গুরুত্ব দেয়।</p> <p>১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরাও স্কার্ফটি পরতে শুরু করেন। বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড আরবান আউটফিটার্স, জিভঞ্চে বা লুই ভিটনও কেফিয়াহ বিক্রি করতে শুরু করে। জনপ্রিয়তা বেড়ে  যাওয়ায় চীনও এটি উৎপাদন শুরু করে। তবে সেই ফিলিস্তিনে মাত্র একটি কেফিয়াহ তৈরির কারখানা অবশিষ্ট আছে। যেটা পশ্চিম তীরের হেবরন শহরে ইয়াসির হারবাউই ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। নানা সময়ে বিতর্কের মুখে পড়লেও চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে এর গুরুত্ব আবারও বেড়ে গেছে।</p> <p><strong>সূত্র : বিবিসি, সিএনএন</strong><br />  </p>