<p>পবিত্র রমজান মাসে সংগঠিত ইসলামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায় বদর যুদ্ধ। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে সংঘটিত এই যুদ্ধটি মানবজাতির ইতিহাসে অনন্য এক ঘটনা। এটি ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে একনিষ্ঠতার লড়াই। অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিশ্বাসের লড়াই। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এই দিনটির বিভিন্ন তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। নবীজি (সা.)-এর হাদিসেও এর বিশেষ কিছু মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে। নিম্নে সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধরা হলো;</p> <p><strong>‘ইয়াওমুল ফুরকান’ আখ্যা দান : </strong>‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বলে মূলত বোঝানো হয়েছে, হক-বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালার দিন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু গনিমতরূপে পেয়েছ, নিশ্চয় আল্লাহর জন্যই তার এক-পঞ্চমাংশ ও রাসুলের জন্য, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরের জন্য, যদি তোমরা ঈমান এনে থাকো আল্লাহর প্রতি এবং হক ও বাতিলের ফয়সালার দিন আমি আমার বান্দার ওপর যা নাজিল করেছি তার প্রতি, যেদিন দুটি দল মুখোমুখি হয়েছে, আর আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪১)</p> <p><strong>শত্রুর মনে ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন : </strong>মহান আল্লাহ বদর যুদ্ধের দিন নবীজি (সা.) ও তাঁর বাহিনীকে এমন প্রভাব দিয়েছিলেন যে তাঁরা সংখ্যায় কম হলেও শত্রুপক্ষ তাঁদের ভয়ে কাতর ছিল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের প্রতি ওহি প্রেরণ করেন যে ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তোমরা তাদের অনড় রাখো।’ অচিরেই আমি ভীতি ঢেলে দেব তাদের হৃদয়ে, যারা কুফরি করেছে। অতএব তোমরা আঘাত করো ঘাড়ের ওপর এবং আঘাত করো তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে। (সুরা আনফাল, আয়াত : ১২)</p> <p>মহান আল্লাহ শত্রুর মনে ভীতি সৃষ্টি করেও নবীজি (সা.)-কে সাহায্য করতেন। এটা ছিল নবীজি (সা.)-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত: নবী (সা.) বলেন,...আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে এক মাস দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয়...। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৫)</p> <p><strong>ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য : </strong>বদর যুদ্ধের বিশেষ মর্যাদার মধ্যে একটি হলো, এই যুদ্ধে মহান আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে মুসলমানদের সহযোগিতা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে হীনবল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায়, তোমরা শোকরগুজার হবে। স্মরণ করো, যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে, ‘তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে তোমাদের রব তোমাদের তিন হাজার নাজিলকৃত ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবেন?’ হ্যাঁ, যদি তোমরা ধৈর্য ধরো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, আর তারা হঠাৎ তোমাদের মুখোমুখি এসে যায়, তবে তোমাদের রব পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১২৩-১২৫)</p> <p><strong>বদরি সাহাবি ও ফেরেশতাদের বিশেষ মর্যাদা : </strong> যেসব সাহাবায়ে কেরাম ও ফেরেশতা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা মর্যাদার দিক থেকে অন্যদের থেকে আলাদা। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, মুআজ বিন রিফাআ ইবনে রাফি জুরাকি (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণিত, তার পিতা বদর যুদ্ধে যোগদানকারীদের একজন। তিনি বলেন, একদা জিবরাঈল (আ.) নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আপনারা বদর যুদ্ধে যোগদানকারী মুসলিমদের কিরূপ গণ্য করেন? তিনি বলেন, তারা সর্বোত্তম মুসলিম অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) এরূপ কোনো শব্দ তিনি বলেছিলেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, মালায়িকাদের মধ্যে বদর যুদ্ধে যোগদানকারীগণও তেমনি মর্যাদার অধিকারী। (বুখারি, হাদিস : ৩৯৯২)</p> <p><strong>বদরি শহীদদের জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ সম্মান : </strong>আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত: উম্মু রুবায়্যি বিনতে বারা, যিনি হারিস ইবনে সুরাকার মা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আপনি হারিসাহ (রা.) সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবেন কি? হারিসা (রা.) বদরের যুদ্ধে অজ্ঞাত তীরের আঘাতে শাহাদাত লাভ করেন। সে যদি জান্নাতবাসী হয়ে থাকে তবে আমি সবর করব, তা না হলে আমি তার জন্য অবিরাম কাঁদতে থাকব।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে হারিসার মা, জান্নাতে অসংখ্য বাগান আছে, আর তোমার ছেলে সর্বোচ্চ জান্নাতুল ফেরদাউস পেয়ে গেছে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৮০৯)</p> <p><strong>বদরি সাহাবিদের ক্ষমার ঘোষণা : </strong>মহান আল্লাহ বদরি সাহাবিদের সব পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে নবীজি (সা.)-এর হাদিসে পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি জান কি? অবশ্যই আল্লাহ তাআলা আহলে বদর সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন এবং তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যেমন ইচ্ছা ‘আমল করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮১)</p> <p><strong>বদরি সাহাবিরা জাহান্নামে যাবে না : </strong>বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের মর্যাদা হলো, মহান আল্লাহ তাদের জন্য জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, হাতিব ইবনে আবি বালতাআহ (রা.)-এর এক ক্রীতদাস রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তার বিরুদ্ধে নালিশ করে বলে, হে আল্লাহর রাসুল, নিশ্চয়ই সে জাহান্নামে যাবে। তিনি বলেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, সে কখনো জাহান্নামে যাবে না। কেননা সে বদরের যুদ্ধে এবং হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৬৪)</p> <p>এই যুদ্ধেই মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য গনিমতের মাল হালাল করেছেন : আগের উম্মতদের জন্য গনিমতের সম্পদ ভোগ করা জায়েজ ছিল না। তারা এগুলো একত্র করে রাখলে আকাশ থেকে আগুন এসে সেগুলো গ্রাস করে নিত। তবে বদর যুদ্ধের সময় মহান আল্লাহ মুসলিমদের জন্য গনিমতের সম্পদ নিজেরা ভোগ করার অনুমতি দিয়ে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা যে গনিমত পেয়েছ, তা থেকে হালাল পবিত্র হিসেবে খাও, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৬৯)</p> <p><strong>যুদ্ধের আগেই আল্লাহর বিজয় দানের অঙ্গীকার : </strong>বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুদ্ধে নামার আগেই মহান আল্লাহ তাদের সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিজয় দানের গ্যারান্টি দিয়েছেন। এটা অবশ্যই বদর যুদ্ধের একটি বিশেষ মর্যাদা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর স্মরণ করো, যখন আল্লাহ তোমাদের দুই দলের একটির ওয়াদা দিয়েছিলেন যে নিশ্চয়ই তা তোমাদের জন্য হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে অস্ত্রহীন দলটি তোমাদের জন্য হবে এবং আল্লাহ চাচ্ছিলেন তাঁর কলেমাসমূহ দ্বারা সত্যকে সত্য প্রমাণ করবেন এবং কাফেরদের মূল কেটে দেবেন। যাতে তিনি সত্যকে সত্য প্রমাণিত করেন এবং বাতিলকে বাতিল করেন, যদিও অপরাধীরা তা অপছন্দ করে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৭-৮)</p> <p><br />  </p>