<p>নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সরকারের প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও মজুদদারদের অসাধু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এই অসউৎ লোকেরা অন্যায্য লাভের জন্য বাজারকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে। ফলে চলমান রোজার মাসে ক্রমবর্ধমান খরচ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, যা জনসংখ্যার দুর্বল অংশের জীবনমানকে আরো নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। মজুদদারদের সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে এবং জনগণের দুর্দশা দূর করতে সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।</p> <p>দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের জনগণের বৃহত্তম অংশ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি সবার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সীমিত আয়ের মানুষের জীবনধারণের সক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে এই পরিবারগুলো খাদ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই আর্থিক বোঝা বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ যখন পবিত্র রমজান মাসে জনগণ ধর্মীয় বিধান মেনে সময় অতিবাহিত করার পরিবর্তে জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে।</p> <p><img alt="মজুদদারদের সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি" height="422" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/16-03-2024/66.jpg" style="float:left" width="500" />মজুদদারদের চলমান পদক্ষেপ দ্রব্যমূল্য কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। দ্রব্যের মজুদকরণ বাজারে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে মজুদদাররা ভোক্তাদের সংবেদনশীলতার সুযোগ নিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের আইন প্রয়োগের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও মজুদদারদের সিন্ডিকেট সূক্ষ্মভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা বাজারের স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটগুলোর অবৈধ তত্পরতা বাজারের গতিশীলতাকে পরিবর্তন করেছে এবং জনগণের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।</p> <p>রোজার মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি হস্তক্ষেপ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এই পবিত্র মাসটি সংযমের মাস হিসেবে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মাধ্যমে সমগ্র মুসলিম জাতি সহানুভূতি, উদারতা এবং ঐক্যের আদর্শকে তুলে ধরে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই মাসের পবিত্রতা বিপন্ন হতে পারে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করার ক্ষেত্রে জনগণকে অক্ষম করে তুলতে পারে। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কিছু মজুদদার ব্যবসায়ীর স্বার্থপরতার কারণে সমগ্র সমাজের কল্যাণ বিপন্ন হতে পারে। </p> <p>মজুদদারদের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধিজনিত সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে মজুদকরণের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কমাতে একটি ব্যাপক কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথমত, মজুদকরণ বন্ধ করতে এবং দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এই অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও বিচারের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মধ্যে শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া ভোক্তাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করতে এবং বাজারে নানা ধরনের কারসাজির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।</p> <p>মজুদকরণের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্য, বাজারের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এই অনৈতিক আচরণগুলোকে আরো সহজতর করেছে। বাজারের উন্মুক্ততা উন্নত করা এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার প্রচার একটি টেকসই সমাধানের অপরিহার্য উপাদান। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সরকারকে ন্যায্য মূল্যে বাণিজ্য অনুশীলন প্রচার এবং ভোক্তাদের জন্য তথ্যের সহজ অ্যাকসেস নিশ্চিত করার জন্য কৌশল গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। বাজারের গতিশীলতা এবং মূল্যের ধরন সম্পর্কে তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের ক্ষমতায়িত করা গেলে ভোক্তারা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং অসউৎ ব্যক্তিদের প্রভাব প্রশমন করতে সক্ষম হবে।</p> <p>সরবরাহ শৃঙ্খলকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং কয়েকটি বড় সংস্থার ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী এবং ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। সরকার ক্ষুদ্র উদ্যোগকে সহায়তা করার মাধ্যমে আরো শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজারের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। এটি অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করবে এবং বড় আকারের মজুদকরণ সিন্ডিকেটের শক্তিকে দুর্বল করে দেবে। কারণ ছোট অংশগ্রহণকারীরা এই ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে কম আগ্রহী হয়।</p> <p>সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং সহায়তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দিকেও মনোনিবেশ করা উচিত। এর মধ্যে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য কর্মসূচির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট নগদ হস্তান্তর প্রকল্প প্রণয়ন এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সরকার জনসংখ্যার সহনশীলতা উন্নত করতে পারে এবং মূল্যবৃদ্ধির ফলে আরো খারাপ হওয়া আর্থ-সামাজিক দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা করে মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবগুলো হ্রাস করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কার্যকারিতার জন্য প্রশংসিত হয়ে আসছে, যা উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়। তবু সরকারের উচিত এই কর্মসূচিগুলোর পরিধি বৃদ্ধি ও বিস্তৃত করা।</p> <p>প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর দেশের নাগরিকদের অবিচল আস্থা রয়েছে, যা সদ্যঃসমাপ্ত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জনগণের আশাবাদের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি দেশের জনগণের চূড়ান্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বিধায় এই কঠিন সময়ে দেশের জনগণ তাঁর দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্বের দিকেই তাকিয়ে আছে। এরই মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যেকোনো মূল্যে বাজার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন, যা জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা বাড়িয়েছে।</p> <p>এখন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাজ হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসরণ করা এবং বাজারের মূল্য স্থিতিশীল করতে মজুদকরণের বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করা। বর্তমানে সরকারের সামনে কোনো বড় রাজনৈতিক বাধা নেই। কাজেই এই জরুরি সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সরকারি দলের কেউ কেউ এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তবে দেশ ও সরকারের সফলতার স্বার্থে সব দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে মজুদদার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যদি মজুদদার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাজার স্থিতিশীল করতে পারে, তবে এটি অবশ্যই জনগণের জন্য স্বস্তির অনুভূতি নিয়ে আসবে এবং সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনকে আরো শক্তিশালী করবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ</p> <p>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p> </p> <p> </p>