বাজেটে সরকারের প্রাক্কলিত আয়-ব্যয়ের হিসাব ও কর প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমদানি বা উৎপাদন পর্যায়ে নতুন বা বর্ধিত কর আরোপের আশঙ্কা থেকে বাজেট পেশের আগেই অনেক সময় বাজারে তার প্রভাব পড়ে। এবার কিন্তু অবস্থা ভিন্ন। নানা কারণে অনেক আগেই বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকনির্দেশনা চাই
- গোলাম রহমান

করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের চেয়ে বেশি হওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য নষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রাসংকট দেখা দিয়েছে এবং টাকার বিনিময় হারের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। আমদানি মূল্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে যে মুদ্রাস্ফীতি, একক কোনো দেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের পক্ষে তা প্রভাবিত করার সুযোগ আছে বলেও মনে করি না। তবে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি দেশে যাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব না ফেলতে পারে সে লক্ষ্যে ছোট-বড় অনেক দেশই নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং বহুলাংশে সফল হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব এবং এ ক্ষেত্রে মূলত অনুসৃত সুদনীতি মুখ্য ভূমিকা রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং সুফল লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিয়েছে। করোনা-পূর্ববর্তী প্রশাসনিকভাবে আরোপিত ‘নয়ছয়’ সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যা অর্থনীতিতে কোনো সুফল বয়ে এনেছে বলে মনে হয় না। বাজারভিত্তিক সুদের হার নির্ধারণ প্রক্রিয়া গ্রহণ সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রা সরবরাহ সুনিয়ন্ত্রিত রাখা প্রয়োজন। সাধারণভাবে বলা হয়, অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। সে কারণে সরকার সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ পরিহার করে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ঋণ প্রদান করে এবং তাতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বর্তমান অর্থবছরে সরকার এর মধ্যে ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে কয়েক শ কোটি টাকার সরবরাহ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, তা মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ না করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সরকারের অর্থ সংগ্রহ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতো বলে মনে করি। তা না করে অর্থ মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা শর্ত আরোপের মাধ্যমে জনগণকে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে নিরুৎসাহ করছে।
মুদ্রাস্ফীতির আবহের মধ্যে ভোজ্য তেল, চিনি ইত্যাদি পণ্যের আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলসহ বেশ কিছু পণ্যের মূল্য এখন নিম্নমুখী। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ সংকটের কারণে দেশের বাজারে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। এ ছাড়া বেশির ভাগ আমদানি করা এবং দেশে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ স্বল্পসংখ্যক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বাজারে কাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা নেই। যে কারণে সময়ে সময়ে সরবরাহসংকট সৃষ্টির ফলে মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। অধিকন্তু ধান, চালসহ অনেক কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। সে কারণে এসব ক্ষেত্রে উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপিত আছে।
মুদ্রাস্ফীতির আবহ থেকে দেশকে রক্ষা করার উপায় নির্ধারণ এবারের বাজেট প্রণয়নে অর্থমন্ত্রীর প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি। কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস করা গেলে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টানা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী বাজেটে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি নানা পদক্ষেপ নিতে পারেন। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিকাশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সহায়ক হতে পারে। কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ যুক্তিযুক্ত হবে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় প্রদানও বিবেচনা করা যেতে পারে। রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে গুরুত্বারোপ সময়োপযোগী হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার লক্ষ্যে বাজেটের অর্থায়নে অর্থমন্ত্রীর বিশেষ দক্ষতা ও সৃজনশীতার প্রয়োজন হবে। অর্থায়নে ব্যাংকিং খাত থেকে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তামাক ও মাদকজাত পণ্য এবং বিলাসী পণ্যের ওপর অধিক হারে করারোপ যুক্তিযুক্ত হবে। অন্যদিকে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর শূন্য বা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণ সুবিবেচনার পরিচয় বহন করবে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। এই অবস্থায় করমুক্ত আয়সীমা নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। বর্তমানে করমুক্ত বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকা, অর্থাৎ মাসিক গড় আয় ২৫ হাজার টাকার বেশি হলে কর প্রদান বাধ্যতামূলক। জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করা হলে এই আয়সীমা অপ্রতুল। সাধারণ পরিবারের মাসিক ন্যূনতম ব্যয় বর্তমানে ৩০ হাজার টাকার অধিক। সে পরিপ্রেক্ষিতে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ সুবিবেচনাপ্রসূত হবে মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, করমুক্ত আয়সীমার ঊর্ধ্বে আয় থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক নাগরিক আয়কর প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এ অবস্থায় আয়কর আরোপের পরিধি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণকারী প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের এবং মাসিক ৩০ হাজার টাকার বেশি বেতনে র্কমরত সরকারি-বেসরকারি সব র্কমকর্ত-কর্মচারীর তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন প্রদান বাধ্যতামূলক করা বিবেচনা করা যেতে পারে। কর অব্যাহতির পরিধি পুনর্বিবেচনা ও সংকুচিত করা যেতে পারে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অর্থনীতিতে মানবদেহের রক্ত সঞ্চালনের সমতুল্য ভূমিকা রাখে। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে হলে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। জ্বালানি তেলের জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে তেল আমদানির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পাদন এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশে তেল শোধনাগার স্থাপন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মিতব্যয়িতা অর্জন সম্ভব।
গ্যাস সরবরাহ চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। সরকার তরলায়িত গ্যাস আমদানি করে চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। স্পট মার্কেটে উচ্চমূল্যের কারণে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, দেশের স্থলভাগে ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে পর্যাপ্ত গ্যাসের মজুদ আছে। অর্থাভাবে গ্যাস আহরণ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে অর্থের জোগান দিতে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করে বিইআরসি ২০০৯ সালে ’গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও আমদানির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি গ্যাস অনুসন্ধানে কূপ খনন বৃদ্ধির উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে ভোলায় একাধিক গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। আশা করা যায়, স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করা হলে আমদানিনির্ভরতা হ্রাস সম্ভব হবে।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং এর মধ্যে দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ বিতরণের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। প্রতিবেশী ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানির ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। আমদানি করা কয়লানির্ভর বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশে পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ আছে। কিন্তু উত্তোলনের প্রচেষ্টা নানা কারণে থেমে আছে। দেশে কয়লা উত্তোলন করে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি পরিহার সুবিবেচনাপ্রসূত হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কয়লা ও আণবিক শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অধিক সম্প্রসারণ থেকে বিরত থাকা সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি।
সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি প্রদান করছে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্বচ্ছ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় মূল্য বৃদ্ধি করে ভর্তুকি হ্রাসের প্রচেষ্টা লক্ষ করছি। তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাব আছে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনীহা বা ধীরগতি ভর্তুকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আইন করে প্রতিযোগিতা সীমিত ও স্বেচ্ছাচারিতা উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা সারা দেশ বিদ্যুতায়নের মতো সরকারের বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। তাদের ধারণা, অপচয়, অমিতব্যয়িতা ও দুর্নীতির লাগাম টানা গেলে ভর্তুকি ছাড়াই সাশ্রয়ী মূল্যে ভোক্তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের বলিষ্ঠ উদ্যোগ প্রত্যাশা করি।
অর্থলগ্নিকারী একটি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে দেশে মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া বিবেচনা করছে। কোনো কোনো দেশে এ প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি এবং মুদ্রাস্ফীতি উসকে দিয়েছে। বিশ্ববাজারে দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ সুবিবেচনাপ্রসূত হবে বলে মনে করি না। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারের দৈনন্দিন মূল্য ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মূল্য সমন্বয় বাস্তবসম্মত নয়। একটি ‘মূল্য স্থিতিশীলতা/সমন্বয় তহবিল’ সৃষ্টি করে বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাস পেলে দেশে নির্ধারিত উচ্চমূল্যে বিক্রি এবং বৃদ্ধি পেলে তহবিলে সঞ্চিত অর্থ থেকে ঘাটতি সমন্বয় এবং মূল্য অপরিবর্তিত রাখা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে বলে মনে করি।
বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ ২০২৬ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণি থেকে উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করবে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে পণ্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে প্রতিযোগিতা মূল্যে কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের চাহিদা মেটানোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার মানোন্নয়ন, কর্মক্ষম সব নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনমানের উন্নয়ন এবং আয়বৈষম্য দূর, স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়ক হবে বলে মনে করি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘প্রবৃদ্ধি’কে মুখ্য লক্ষ্য স্থির করে অর্থমন্ত্রী বাজেট কাঠামো প্রণয়ন করে আসছেন। এবারের বাজেট আসন্ন নির্বাচন-পূর্ববর্তী শেষ বাজেট। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয়-রোজগার ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা অর্জন, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা, টাকার মূল্যের অধোগতি রোধকে অধিক গুরুত্ব প্রদান সুবিবেচনাপ্রসূত হবে বলে মনে করি এবং এসব বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করি। আশা করি, তিনি গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজার দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ভারত সরকার অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ‘কনজিউমারস অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালন করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ‘কনজিউমারস অ্যাফেয়ার্স’ ও ‘বিজনেস অ্যাফেয়ার্স’-এর দায়িত্ব পৃথককরণ এবং দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিভিশন সৃষ্টি সুবিবেচিত ও সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি।
লেখক : সভাপতি, কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ক্যাব
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd