<p>মাঝবয়সে এসেও কেউ গল্পের বইয়ে এমন মজে থাকতে পারেন, আফসানা করিমের এ স্বভাব বিস্মিত করে অনেককে। বিস্ময়ের কিছু মানুষ নীরবে মেনে নিতে পারে না, সে নিয়ে একটা কোনো মন্তব্য তার করা লাগবেই। আফসানা করিমকেও প্রায়ই নানা উদ্ভট মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। এই যেমন বইয়ের জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ কেউ কেউ একেক দিন বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ আফসানা, তোমার পড়ার বাকি এমন বই পৃথিবীতে এখনো তবে আছে!’ আফসানা করিম প্রত্যুত্তরে শুধু হাসেন। একটা মানুষ এক জীবনে পৃথিবীর বইয়ের ভাণ্ডারের কটা বই-ই বা পড়তে পারেন! কিংবা কেউ যখন বলেন, ‘আফসানা, কী লাভ হচ্ছে বলো তো এত এত বই পড়ে! তার চেয়ে একটু ঘুরে বেড়িয়ে, ফেসবুক-ইউটিউব করে জীবনটাকে উপভোগ করো।’ এমন মন্তব্যেও আফসানা করিম নীরব। শুধু মনে মনে বলেন, জীবনকে উপভোগের ধরন সব মানুষের একই রকম হতে হবে কেন!</p> <p>আশপাশের অনেকের এমন বেমক্কা মন্তব্যের পরও ঘরকন্নার কাজে অবকাশ মিলতেই আফসানা করিম বই নিয়ে বুঁদ হয়ে যান। এখন যেমন।</p> <p>ভাদ্রের বিকেল। ভাপসা গরমে রুমের ভেতরটা গুমট হয়ে রয়েছে। তার ওপর বিদ্যুৎ নেই। এমন আবহাওয়াকে দিব্যি উপেক্ষা করে আফসানা করিম চুর হয়ে রয়েছেন বই হাতে। সহসা ছেলের কণ্ঠে সচকিত হন তিনি।</p> <p>মা, আমি একটু বেরোচ্ছি। বলতে বলতে নাঈম দোরমুখে উদয় হয়।</p> <p>আফসানা করিম বই থেকে মুখ উঁচিয়ে ছেলের দিকে তাকান, এখন আবার কই যাবি! একটু পর তানি ফিরবে। সন্ধের নাশতাটা একসঙ্গে করতে মেয়েটা কত না পছন্দ করে।</p> <p>কৈফিয়তের ঠাটে অনুচ্চ গলায় নাঈম জবাব দেয়, দূরে কোথাও যাব না, মা। সামনের পার্কে গিয়ে অল্পক্ষণ বসব। খুব গরম পড়ছে আজ।</p> <p>শোন বাবা, সাবধানে থাকবি। পথেঘাটে কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করবি না। তোর কারণে যেন আমাদের মাথা হেঁট না হয়। ঈষৎ সসংকোচে বলে ওঠেন আফসানা করিম।</p> <p>প্রতিবার ঘর থেকে বেরোতে গেলে মায়ের এ কথা কটা শুনতে হবে, নাঈম জানে। নরম গলায় নাঈম ঝটপট উত্তরে বলে, না মা, তোমার ছেলে অতটা পচেগলে যায়নি।</p> <p>ছেলে আশ্বস্ত করে গেলেও আফসানা করিমের দুশ্চিন্তা  পুরোপুরি কাটে না। ঠিক জানেন, ছেলে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত পুরো তিরোহিত হবে না তাঁর এই ধুকপুকুনি।</p> <p>নিজের ছেলেকে নিয়ে আফসানা করিমের এতখানি উৎকণ্ঠা অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হয়। কারো কারো কাছে চূড়ান্ত রকম হাস্যকরও। এসব টিপ্পনীতে আফসানা করিম দমেন না। বরং ছেলে যখনই বাসার বাইরে বেরোতে যায়, ছেলেকে অন্তত একবারের তরে এই সাবধানবাণী শোনাতে কসুর করেন না।</p> <p>বাকিদের অবাক করে যা, আমাদের সমাজে প্রত্যেক মা-বাবা নিজেদের মেয়েকে ঘর থেকে বেরোতে গেলে যেখানে সাবধানে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন; আফসানা করিম সেসব সাবধানবাণী আওড়ান ছেলের বেলায়। অবশ্য এ ব্যাপারটায় আফসানা করিমের জবাবও সোজাসাপ্টা। ছেলেকে সাবধান করা মানেই তো মেয়ের পথচলা নিশ্চিন্ত করা। বরং উন্মত্ত শিকারিকে সাবধান না করে সুবোধ শিকারকে সতর্ক থাকতে বলার মাঝে একধরনের গোঁড়ামি দেখতে পান তিনি। আফসানা করিম ভেবে পান না, এভাবে শিকারিকে এড়িয়ে শিকারকে প্রতিনিয়ত তটস্থ করে আদৌ কোনোকালে নিরাপদ সমাজ তৈরি করা সম্ভব কি না!</p> <p> </p> <p>২.</p> <p>তানজিলা অফিস থেকে ফেরার পথে গলির মোড়টায় নাঈমকে পেয়ে যায়।</p> <p>কী রে, এমন হন্তদন্ত হয়ে কই যাচ্ছিস?</p> <p>নাঈম প্রথমটায় বড় বোনকে লক্ষ করে না। প্রশ্নের মুখে ফিরে তাকিয়ে আলতো হেসে কপট রহস্যঘন গলায় বলে, সত্যিটা বলব, না মিথ্যা করে বলব?</p> <p>প্রথমে মিথ্যাটাই শোনা।</p> <p>পার্কে কজন কলেজের বন্ধু এসেছে। ফোন করেছে। খানিকক্ষণ বসে আড্ডা দেব।</p> <p>এবার সত্যিটা শুনি!</p> <p>আপু, তুমি জানো যে আমি তোমার কাছে মিথ্যা বলতে পারি না!</p> <p>তোর বন্ধুগুলো কেমন স্বভাবের রে? আজেবাজে গোছের নয়তো?</p> <p>তানজিলার এমন চোখা কথায় নাঈম ঈষৎ ক্ষুণ্ন হয়। চটজলদি বলে, তুমি কি ভাবো যে পৃথিবীতে শুধু তোমারই বন্ধুভাগ্য ভালো! তেমন সন্দেহ হয় যদি তুমিও এসো, আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত হবে।</p> <p>তানজিলা স্নেহের গলায় বলে, ধুর, তোর সঙ্গে ঠাট্টা করলাম। একটু থেমে বলে, শোন, বেশি দেরি করিস না। একসঙ্গে নাশতা করব।</p> <p> </p> <p>৩.</p> <p>তানজিলা বাইরের পোশাক ছেড়ে মায়ের রুমে এসে দেখে, মা গুনগুন করে নিজের খেয়ালে একটা চেনা সুরের গান ভাঁজছেন। তানজিলা উপস্থিত হতে আফসানা করিম গান থামিয়ে দিলে তানজিলা উপরোধের স্বরে বলে, মা, থামলে কেন! বেশ তো গাইছিলে!</p> <p>হয়েছে, আর এ নিয়ে তোকে রঙ্গ করতে হবে না। সব বয়সে সব কিছু মানায় না, সে বুঝি আমি জানি না?</p> <p>তানজিলা মায়ের আরেকটু কাছ ঘেঁষে এসে বলে, তোমার কিন্তু এমন কোনো বয়স হয়নি, মা।</p> <p>তুই বলছিস!</p> <p>হ্যাঁ। তোমার মেয়ে তানি বলছে।</p> <p>তুই যখন বলছিস তবে আমার নিশ্চয় এমন কোনো বয়স হয়নি। বলে আফসানা করিম সপ্রাণ হেসে ওঠেন।</p> <p> </p> <p>৪.</p> <p>রাতে খেতে বসে নাঈম দৈবাৎ বলে, আপু, শুনেছ! আমাদের পুবের পার্কটায় পরশুদিন একটা লাশ পাওয়া গেছে। অল্প বয়সী একটা মেয়ের লাশ। আজ পার্কে গিয়ে শুনলাম। সবাই ধারণা করছে, বেচারিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।</p> <p>আফসানা করিম ও তানজিলা দুজনেই চুপ। নাঈম আন্দাজ করে নেয়, ব্যাপারটা তাঁদের জানতে বাকি নেই। একটুক্ষণ পর নাঈম জানতে চায়, আচ্ছা মা, পৃথিবী এতটা এগিয়েছে, এতটা সভ্যভব্য হয়েছে; কিন্তু ধর্ষণের মতো ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন?</p> <p>আফসানা করিম একটা কিছু বলার আগে তানজিলা বলে, মা, আমার মনে হয় কী, কোনো সমাজের যত দিন একজন ধর্ষককে ঘিরে বিবমিষাবোধ না জাগবে, ওই সমাজে ধর্ষণের মতো গর্হিত ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। তুমি কী বলো?</p> <p>মেয়ের জবাবটা আফসানা করিমের মনঃপূত হয়েছে বোঝা যায়। তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা। একটা সমাজ যদি ওই সমাজের কোনো ধর্ষকের জীবনকে অনুক্ষণ বিষাতে থাকে, সে ধর্ষকের জীবনকে পরিত্যাজ্যতুল্য করে ছেড়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করে, তবেই ওই সমাজে দ্বিতীয় কোনো ধর্ষকের জন্ম হবে না। হঠাৎ ছেলের দিকটায় মুখ ঘুরিয়ে যোগ করেন, শোন বাবা, ছেলে হয়ে জন্মেছিস, ধর্ষণের ঘটনা একজন নারীর ভেতরটা কতটা ভেঙেচুরে দেয়, কখনোই তা বুঝে উঠতে পারবি না। তোর কাছে অনুরোধ, আমার ছেলে হয়ে তুই এমন কিছুতে কক্ষনো জড়াবি না; বন্ধুদের কেউ কখনো তেমনটা করে বসলে তার সঙ্গেও জন্মের তরে সম্পর্ক ছিন্ন করবি।</p> <p>     ঘুমুতে এসে রুম লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নাঈম মায়ের কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মায়ের সে কথাটা তার পুরোপুরি বিশ্বাসে নিতে মন সায় দিচ্ছে না। ছেলে হয়ে জন্মেছে বলেই বুঝি একটা মেয়ের কষ্ট বুঝতে সে অপারগ হবে! একজন ছেলেও যেমন মানুষ, একজন মেয়েও। একজন মানুষ কেন আরেকজন মানুষের কষ্টের জায়গাটা বুঝবে না!</p>