এমপি হতে পারলেই টাকা আর টাকা! তাই এমপির মনোনয়ন ‘কিনতে’ বিপুল টাকার ছড়াছড়ি হয়। কোনোমতে এমপির মনোনয়ন পেয়ে গেলেই সরাসরি সংসদ সদস্য। তখন এমপি হওয়ার ‘খরচের’ টাকা ওঠাতে আর সময় লাগবে না। এমপি হওয়ার পেছনে টাকা খরচের এমন বদ্ধমূল ধারণা সব স্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যেই।
অনুসন্ধানে গোয়েন্দারা
সাবেক ৫০ নারী এমপি করজালে
মো. জাহিদুল ইসলাম

ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে ‘বিনা ভোট’, ‘রাতের ভোট’ ও ‘ডামি ভোট’ হওয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। ওই সব নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসন পেতেও কালো টাকার ছড়াছড়ি ছিল বলে সবার ধারণা। প্রচার রয়েছে কোনো কোনো সংরক্ষিত আসনের এমপি পদের দর শতকোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এত টাকায় এমপি হয়ে থাকলে ওই এমপিরা সত্যিকার অর্থে কত টাকার মালিক? আর ওই টাকা তাঁরা কিভাবে আয় করেছিলেন? তাঁদের বৈধ আয়ের উৎস কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে সন্দেহভাজন মহিলা এমপিদের ধরতে তাই ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বেছে নিয়েছেন কর গোয়েন্দারা।
এরই মধ্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসন বাগিয়ে নেওয়া ৫০ জনের আয়কর নথি যাচাই শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসনে কোনো নির্বাচন হয় না। দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে তাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই পদ নিতে কোটি কোটি টাকা দিয়ে দলকে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছিল। যাঁরা এই পদে ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের এই সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা হবে।”
তিনি আরো বলেন, ‘নারী এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে যে টাকা তাঁরা খরচ করেছেন, আয়কর নথি অনুযায়ী সেই সক্ষমতা দেখাতে না পারলে বা সম্পদ গোপন বা অন্য কোনো ধরনের অসংগতি পাওয়া গেলে আয়কর আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাকার উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলে সে বিষয়ে দুদক তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’
করজালে সংরক্ষিত আসনের সেই ৫০ এমপি : জানা যায়, সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর বিপরীতে হেরে যান সানজিদা খানম ও মেহের আফরোজ চুমকি। দুজনই আগে এমপি ছিলেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদের। মনোনয়ন চেয়েও পাননি সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা। তাঁরা প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে পেয়েছেন সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন।
সংরক্ষিত আসনে এমপি হয়ে পরে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন ওয়াসিকা আয়শা খান। এনবিআরের সাবেক আয়কর নীতির সদস্য মো. আলমগীর হোসেনের স্ত্রী নাদিয়া বিনতে আমিনও পেয়েছিলেন সংসদের টিকিট। আগেও সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন ফরিদুন্নাহার লাইলী ও নাজমা আকতার। তাঁরাও ছিলেন এমপি হওয়ার তালিকায়। পিছিয়ে ছিলেন না জাতীয় প্রেস ক্লাবের দুইবারের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনও।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করলেও রাজাকারের মেয়ে বলে পরিচিত রেজিয়া ইসলামকে সংরক্ষিত আসনের এমপি বানিয়ে বসানো হয়েছিল সংসদে। এ ছাড়া পারভীন জামান কল্পনা, শামসুন নাহার চাঁপা, রোকেয়া সুলতানা, দ্রৌপদী দেবী আগরওয়াল, আশিকা সুলতানা, কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, জারা জেবিন মাহবুব, ফরিদা আক্তার বানু, ফারজানা সুমি, খালেদা বাহার বিউটি, উম্মে ফারজানা সাত্তার, মাহফুজা সুলতানা মলি, আরমা দত্ত, লায়লা পারভীন, বেদৌরা আহমেদ সালাম, শবনম জাহান, পারুল আক্তার, সাবেরা বেগম, নাহিদ ইজহার খান, ঝর্ণা আহসান, শাহিদা তারেখ দীপ্তি, অনিমা মুক্তি গোমেজ, শেখ আনার কলি পুতুল, মাসুদা সিদ্দীক রোজী, তারানা হালিম, অপরাজিতা হক, হাসিনা বারী চৌধুরী, আশরাফুন নেছা, কানন আরা বেগম, শামীমা হারুন লুবনা, ফরিদা খানম, দিলারা ইউসুফ, জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা, নাছিমা জামান ববি, নাজনীন নাহার রোশা ও রুমা চক্রবর্তী সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের ব্যানারে এমপি হয়েছিলেন।
নির্বাচনে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা প্রসঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি অর্থ প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। নেত্রকোনা থেকে মনোনীত সংরক্ষিত আসনের এমপি নাদিয়া বিনতে আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্যদের ব্যাপারে আমি ঠিক জানি না। আমি এক টাকাও ডোনেশন দিইনি। আমি নিজের এলাকায় কাজ করতে চেয়েছিলাম। প্রথমে নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে পাইনি। আহমেদ হোসেন সে সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে আমি সংরক্ষিত আসনের জন্য চেয়েছি এবং দল আমাকে দিয়েছে।’
তবে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বিক্রির অভিযোগকে মনগড়া ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন। দক্ষতা, যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে দল থেকে তাঁদের মনোনীত করা হয়েছে। এর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। যাঁরা এমন মিথ্যা অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগের বদনাম করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।’
যদিও ভিন্নমত পোষণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর যারা তাদের সবাই দুর্নীতি-অনাচারের সঙ্গে যুক্ত। ফ্যাসিবাদী সরকার দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলেছিল। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
টাকা দিয়ে ‘সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন ক্রয়’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা এনবিআরের খুঁজে দেখা উচিত। সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে।’
জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন দুজন এমপি। তাঁরা হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুন নাহার। জানা গেছে, নির্বাচনের পর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের নাম আলোচনায় থাকলেও বেশি টাকায় অন্য প্রার্থীকে ছেড়ে দেওয়ায় তিনি মনোনয়ন পাননি।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থাকায় মনোনয়ন পাওয়াটাই ছিল বড় বিষয়। কেউ মনোনয়ন কিনতে পারলেই এমপি হয়ে যাওয়া অনেকটা সময়ের ব্যাপার ছিল। তাই সবাই ছুটেছে মনোনয়ন ‘কেনা’র দৌড়ে। টাকা খরচে যে বেশি উদার ছিল, তাঁর মনোনয়নই নিশ্চিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। টাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য, রাজনীতিতে পরীক্ষিত কর্মীরও মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমপি হতে পারলেই এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা কামানো সহজ। এই আশায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা টাকা খরচে কার্পণ্য করেননি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে প্রতিপক্ষবিহীন ডামি ভোটের নির্বাচনের পর ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের এমপির মধ্যে ‘আমি’ ও ‘ডামি’ প্রার্থীদের সমর্থনে ৪৮টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বাকি দুটি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল জাতীয় পার্টি।
জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগের ৪৮টি সংরক্ষিত নারী আসনের বিপরীতে ফরম জমা দিয়েছিলেন এক হাজার ৫৪৯ জন। এই বিশাল সংখ্যা থেকে সীমিত সংখ্যা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তেলবাজি, তোষামোদ, দলদাসত্ব ও ক্ষমতার তাঁবেদারির পাশাপাশি বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে বিপুল টাকা। চূড়ান্ত মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের প্রতি ত্যাগ আমলে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন অনেকেই।

ব্যর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ


বেশি দামে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজন হলে ডলার কিনব, আবার প্রয়োজন হলে বিক্রিও করব।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে ‘আপওয়ার্ড সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এতে করে ডলারের রেট একদিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত উপস্থিতিও বজায় থাকছে। এই কৌশল মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং আইএমএফের শর্ত পূরণ উভয় উদ্দেশেই সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডলার কিনেছে। গত ২৩ জুলাই এই নিলামে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১.৯৫ টাকা, যা আগের তুলনায় ০.৪৫ টাকা বেশি। এর মাধ্যমে মাত্র আট দিনের ব্যবধানে নিলামে ডলারের রেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সায় এক কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নিলামে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১.৯৫ টাকা।
ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে এবার আগের মতো অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখায়নি। কারণ অনেক ব্যাংক ধারণা করছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। তাই তারা অপেক্ষা করছে। চড়া দর সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাজারে প্রত্যাশা কিভাবে গড়ে উঠছে।’
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তা ছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।’
বাজার পরিস্থিতি ও এলসির চাপ : পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্প্রতি ডলারের বাজার কিছুটা টাইট। কারণ ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহে ডলারের প্রবাহ বাড়লে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বাজার স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আগের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, তবে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’
স্পট ও আন্ত ব্যাংক বিনিময় হার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই স্পট বিনিময় হার ছিল ১২১.৯৪ টাকা। আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলার লেনদেন হয় ১২১.৬০ থেকে ১২২.০২ টাকার মধ্যে। শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার আন্ত ব্যাংক বাজারেই ডলারের দাম ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপওয়ার্ড সিগন্যালের ফলে আগামীকাল এটি আরো বাড়তে পারে।’
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণচুক্তির আওতায় এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নির্দিষ্ট রেটে ডলার কেনে না। মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় এখন নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা হয়। এতে করে ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেরা রেট নির্ধারণ করত। এখন মার্কেট রেটেই লেনদেন হচ্ছে। এই পদ্ধতিই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারকে আরো স্বচ্ছ করবে।’

ফিরে দেখা ২৫ জুলাই ’২৪
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব জাতিসংঘের
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে শিগগিরই শান্তি ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপিও।
এদিকে এদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিক্ষোভ করে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় সরকার। বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন এবং অনাবাসিক মিশনগুলোর মাধ্যমে হোস্ট গভর্নমেন্টের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা খোলা ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস। রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। কারফিউ বলবৎ থাকায় রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না।
অন্যদিকে ২৩ জুলাই (২০২৪) প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’। বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা, রংপুরের আবু সাঈদসহ নিহত সবার কবর জিয়ারত, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো।
২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি তারা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেক অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।
নিহত ১৭০ জনের বেশি, আহত হাজারের বেশি— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হালনাগাদ তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পর অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। অন্তত দুজন সাংবাদিক নিহত এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক শ লোকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিনই এক যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণ জবাবদিহির আহবান জানান জাতিসংঘের ১৩ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বাংলাদেশে সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে তা বন্ধ করার আহবান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিচার চাইলেন জনগণের কাছে : এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন ঘুরে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় তাঁকে চোখের পানি মুছতেও দেখা যায়। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (দেশব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের) বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।’
মামলা ও গ্রেপ্তার : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র দিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এদিনও অভিযান অব্যাহত ছিল। এদিন বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রসঙ্গ শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৯ জুলাই চূড়ান্ত আলোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা বাসসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এর আগে বাংলাদেশ ২২ জুলাই ইউএসটিআরের কাছে নিজেদের অবস্থানপত্র পাঠায় এবং ২৬ জুলাই চূড়ান্ত দফার আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেয়।
বাণিজ্যসচিব জানান, ইউএসটিআর ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস করবে। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের জন্য ১৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন পণ্য, যেমন—তুলা, গম, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিমান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ২০ জুলাই মার্কিন গম সরবরাহকারীদের সঙ্গে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকরা শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, এমন কোনো কাজ করা হবে না।
শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচারণা নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আমরা কেন এমন কাজ করব? তাহলে তো আন্ত মন্ত্রণালয় মিটিংয়ের দরকার হয় না। কিছু জিনিস মেনে নিয়ে কাজটা করে ফেললেই তো হয়ে যায়। সম্পূরক শুল্কের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে লবিইস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় না।’