<p>দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। সেদিন বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (রেসকোর্স ময়দান) ছিল মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ। শুধু ঢাকা নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হয়েছিল প্রতিবাদী ও স্বাধীনতাকামী মানুষ। বিশাল ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। জায়গা না পেয়ে অনেকে উদ্যানের গাছে উঠে বসেছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। মঞ্চে উঠেই তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিত হয়। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে তা সমাদৃত হয়েছে। দেশের আপামর মানুষের কাছে এ ভাষণের রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। তরুণদের কাছে অনুপ্রেরণার বাতিঘর বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ। বছর ঘুরে আজ শনিবার আবার এসেছে সেই দিন। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।</p> <p>বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালেন। মাউথপিসের সামনে পোডিয়ামের ওপর চশমাটি রাখলেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারণ করলেন স্বাধীনতার অমর মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধু যে দেশের স্বাধীনতার জন্য সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন, দৃঢ় কণ্ঠে তিনি ডাক দিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার।’ তারপর একটানা ১৮ মিনিট ধরে বলে গেলেন নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষকে সংগ্রাম করার, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার ঐতিহাসিক ঘোষণা। ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’</p> <p>বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারুণ্যের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের এ ভাষণ অনুপ্রেরণা এবং দেশ ও জাতিকে ভালোবাসার অনুপম এক দৃষ্টান্ত। সংকট মুহূর্তে দেশের জন্য কিভাবে দৃঢ় থাকা যায়, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য কিভাবে নিখাদ ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া যায়, কিভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়—বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে ও পড়ে অনুপ্রাণিত হয় তারা।</p> <p>তরুণ নৃত্যশিল্পী ও ত্রিশূল-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তৃণা মজুমদার বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমার এক অনুভূতির নাম, চেতনার নাম, যাঁর সব কিছুর কাছে এসে আমি গুণমুগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ। সেখানে ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে কিছু বলা, অধিক আবেগে আমি হয়ে যাই বাক্রুদ্ধ। ৭ই মার্চের ভাষণ একজন ছান্দসিক কবির জন্য ছন্দোময় দিকনির্দেশনা; একজন কবির, মহাকালের মহাকবির মহাকাব্য; এক সম্মোহনী জাদুকরের সম্মোহিত মূর্ছনা; একটি জাগরণী; নব মানচিত্র তৈরির রং তুলি; একটি লাল-সবুজ পতাকা তৈরির কারিগরের কাঁচা রসদ; বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরির ক্ষিপ্ত তীর-ধনুক; অদম্য সাড়া জাগানিয়া রাগিণী; একটি তাড়না; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এক অনিরুদ্ধ বহমান চেতনা; অমোঘ তিমির রাত্রিতে কুয়াশায় আচ্ছন্ন বন্ধুর পথে দিশাহারা পথিকদের জন্য দৃপ্তমান এক দীপ্তি শিখা; নিথর, নিস্তব্ধ, ম্লান, নিষ্কম্প রক্তের প্রতিটি কোষের এক শক্তিমান অক্সিজেনের অনুরণন; অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একটি যুগান্তকারী চেতনা।”</p> <p>বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে আমি দেখছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রামাণ্য দলিল হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের একেকটি শব্দ, একেকটি বাক্য এবং তাঁর কণ্ঠের কারুকাজ সেদিন স্বাধীনতার ভিত রচনা করেছিল। বাঙালির ভেতর যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং বঞ্চনার ক্রোধ জমেছিল তা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল। আমি মনে করি, তাঁর এ ভাষণের সারমর্ম বা আহ্বান সর্বজনীন এবং চিরস্থায়ী। কোন ক্রান্তিকালে কিভাবে মনোবল ঠিক রেখে সংগ্রামী কিংবা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয়, এ ভাষণ প্রতিটি নাগরিককে সেই বার্তা দিয়ে যাবে অনন্তকাল।’</p> <p>বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের তরুণ শিক্ষক নায়না তাবাসসুম বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ কোনো সাধারণ বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ভাষণ আমার চোখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির সারসংক্ষেপ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে অসহনীয় শোষণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে আসছিল, ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল সেই শোষিত মানুষের মুক্তির প্রথম সোপান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয় এসেছিল জনতার ভোটে। পাকিস্তানের সামরিকচক্র আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্রে মত্ত হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, ৩ মার্চ হরতালের সময় চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ, ৫ মার্চ ঢাকা ও টঙ্গীতে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর সেনাবাহিনীর হামলায় আহত ও নিহত মানুষ। তারপর অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে বাংলার মানুষের মনে জ্বলে ওঠা আগ্নেয়গিরিতে শেষ স্ফুলিঙ্গ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ।’</p> <p>জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের তরুণ শিক্ষক কথাসাহিত্যিক মেহেদী উল্লাহ বলেন, “বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই সেদিন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নিজ জনগণকে। ‘আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন’, ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু এমনটি বলে পূর্ব বাংলার মানুষকে এমন আত্মবিশ্বাসী করে তোলার প্রয়াস চালিয়েছিলেন, যা জাতিগত ঐতিহাসিক হীনম্মন্যতা দূর করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মূলত পূর্ব বাংলার সাত কোটি মানুষকে মাত্র ১৮ মিনিটে জাগ্রত করার মন্ত্র ছিল এ ভাষণ!। জাগ্রত করার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব কী হবে তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন জনগণকে করণীয় নির্দেশ করে তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ আসন্ন, এই সংগ্রামে শৃঙ্খলার সঙ্গে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করলে অবশ্যই স্বাধীনতা আসবে। সাবলীল, সহজবোধ্য আর অনুপ্রাসময় শব্দ যোজনায় বাংলার মানুষের কাছে তিনি যে আহ্বান সেদিন রেখেছিলেন তা আজও যেন বেজে চলেছে পৃথিবীর নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত জনগণের কানে কানে, মন ও মননে।”</p> <p>তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান বলেন, “৭ই মার্চের ভাষণকে আমার কবিতা মনে হয়, যে কবিতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ইতিহাস বলে দিচ্ছেন, নির্যাতন-নিপীড়ন-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ইতিহাস বলে দিচ্ছেন। ৭ই মার্চের ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লাখো জনতার উদ্দেশে বলছেন, ‘আমার ওপর কি তোমাদের আস্থা আছে?’ জনতা উত্তর দিচ্ছে, ‘আছে।’ এই যে জনতাকে তিনি ‘তুমি’ সম্বোধন করছেন, বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে আর কেউ কি এভাবে সম্বোধন করতে পেরেছেন? পারেননি। বঙ্গবন্ধু পেরেছেন। তিনি তো পিতা। সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত হও।’ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে মাঝেমধ্যে খুব হতাশ হয়ে পড়ি। ভেতর থেকে কোনো অনুপ্রেরণা পাই না, উদ্যম পাই না। আমি তখন ৭ই মার্চের ভাষণ শুনি। শুনতে শুনতে আমার ভেতরের হতাশা কাটতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু যেন আমাকেই বলছেন, ‘বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আমি তখন জেগে উঠি। পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করি।”</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম হাসান বলেন, ‘বাঙলির সহস্র বছরের মুক্তির অভিপ্রায়, স্বাধীনতার আকণ্ঠ তৃষ্ণাকে ভাষা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের এক অনুপুঙ্খ রূপরেখা; সশস্ত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ডাক। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের সেই গোধূলিবেলায়, আগত অগণিত জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধু আঁচ করেছিলেন সহস্র মুক্তিকামী তরুণের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি। বাঙালিকে দিয়েছিলেন শৃঙ্খল থেকে মুক্তির প্রণোদনা।’</p> <p>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অরিত্র দাস বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৮ মিনিটের এ ভাষণ একদিকে যেমন ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক,  অন্যদিকে ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে হাজার বছরের বাঙালির অধিকার আদায়ের আহ্বান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণে বলেছেন উদারতা, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ও সম্প্রীতির কথা। আশাহত মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন বেঁচে থাকার প্রত্যয়। এ ভাষণ সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ, প্রেরণাময়ী।’</p> <p> </p>