ঢাকা, মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫
৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫
৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মহররম ১৪৪৭

রাজধানীতে কৃষিশুমারি, তাও বর্ষায়!

  • বিবিএসের জরিপ-শুমারিতে সীমাহীন লুটপাট-গাফিলতি
আরিফুর রহমান
আরিফুর রহমান
শেয়ার
রাজধানীতে কৃষিশুমারি, তাও বর্ষায়!

একবার ভাবুন তো, পরিবার-পরিজন নিয়ে থিতু হয়ে আপনি বসবাস করছেন রাজধানী শহরে। আচমকা একদিন আপনার বাসায় একজন এসে বললেন, ‘আমরা সরকারের লোক। কৃষিশুমারি করতে এসেছি।’ তারপর হাতে একটি ফরম নিয়ে সরকারি লোকটি বললেন, ‘দয়া করে বলতে থাকুন, আমি পূরণ করে নিই।

’ ফরমের দিকে তাকিয়ে লোকটি একে একে প্রশ্ন করতে থাকলেন—আপনার খানার (এক রান্নায় যতজন খাবার খায় এবং একসঙ্গে বসবাস করে) সদস্যসংখ্যা কত, কৃষিকাজে নিয়োজিত সদস্য কত; বসতভিটার জমি কত, আবাদি জমি কত, অনাবাদি কত, পুকুর-দিঘি-নার্সারি কত, হাঁস মুরগি কবুতর কোয়েল কত, গরু ছাগল মহিষ ভেড়া কত; আলু পটোল ঢেঁড়স পেঁয়াজ কতটুকু জমিতে; আম লিচু কুল কাঁঠাল কত; ট্রাক্টর পাওয়ার টিলার নলকূপ কতটি... ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসব প্রশ্ন শুনে কী করবেন আপনি? লোকগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কি বলতে ইচ্ছা করবে না—‘এরা কি পাগল! ইটপাথর লোহালক্কড়ের এই মহানগরে জীবনযাপন আমার। এখানে কৃষিকাজ আসবে কোত্থেকে!’

এই ঘটনা বাস্তবে ঘটেছে জাতীয় কৃষিশুমারির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগর চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন এলাকায় কৃষিশুমারি চালিয়েছে।

ঢাকার একটি এলাকার বেশ কয়েকটি ফরম কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। সেগুলোতে গৃহকর্তার নামধাম, মোবাইল ফোন নম্বর ও খানার সদস্যসংখ্যা ছাড়া আর সব ঘর ফাঁকা। সংগত কারণেই আমরা এলাকা ও গৃহকর্তার নামধাম ছাপলাম না। তবে পূরণ করা একটি ফরমের মোবাইল নম্বরে গতকাল সোমবার রাতে ফোন করলে ওপার থেকে একজন ফোন ধরে গৃহকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘হ্যাঁ, গত জুন মাসে আমার বাসায় একজন এসেছিলেন।
ওই সব প্রশ্ন শুনে আমি তাঁকে বলেছি, ভাই, আমি একটা গার্মেন্টে চাকরি করে খাই। এসব প্রশ্ন নিয়ে গ্রামে যান, এগুলো শহরের জন্য না।’

গত ৯ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দেশজুড়ে সর্বশেষ কৃষিশুমারি করে বিবিএস। শুমারির আগে মাঠকর্মীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ এবং দৈনিক ১২৫ টাকা করে প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়ার কথা। প্রশিক্ষণ ও ভাতা ঠিকমতো হয়েছে কি না অনুসন্ধানের জন্য গত ৪ সেপ্টেম্বর নামধাম জোগাড় করে ফোন দেওয়া হয় রাঙামাটি সদরের সুপারভাইজর অনিল কান্তি চাকমাকে।

প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্ময়ের সুরে বলেন, ‘দাদা, এত কষ্ট করার পরও আমার লিগ্যাল টাকাটা আমি পাই নাই। এদের মানসিকতা এমন কেন দাদা!’ আপনার তো ছাতা, টি-শার্ট, ক্যাপ এসব পাওয়ার কথা—পেয়েছেন?’ অনিল কান্তি চাকমা স্বভাবসুলভ সরলতায় বললেন, ‘কী যে বলেন দাদা! লিগ্যাল টাকাটাই পাইনি আর ছাতা, টি-শার্ট পাব!’

টাকার অঙ্ক এবং একজন অনিল কান্তির টাকা না পাওয়ার দুঃখ অতি সামান্য মনে হলেও তাঁর কণ্ঠেই যেন ধ্বনিত হলো—কী অরাজক অবস্থা চলছে বিবিএসের করা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব জরিপ-শুমারির নেপথ্যে, সেই সুর।

দেশের কৃষক-জেলে-খামারিদের সহযোগিতার পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেওয়া হয় বিবিএসের কৃষিশুমারির মাধ্যমে; বের করা হয় দেশে কৃষিভিত্তিক খানার (হাউসহোল্ড) সংখ্যা কত, কী কী ধরনের শস্য উৎপাদন হয়, ভূমির ব্যবহার, জমিতে চাষের প্রকারভেদ, চাষের পদ্ধতি, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির সংখ্যা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের তথ্য-উপাত্ত।

দেশবাসীর প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন ও সেবা খাতের পরিকল্পনার জন্য জানা দরকার দেশের জনসংখ্যা কত। আর বিবিএসের করা আদমশুমারির মাধ্যমেই সেটা জানা যায়। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের অবস্থান-মর্যাদাও নির্ভর করে এই জনসংখ্যার ওপর। বিবিএসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থনৈতিক শুমারি। এর মাধ্যমে কৃষি খাতের বাইরে দেশের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য জানা যায় এবং তার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বিবিএসের করা শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে জানা যায় দেশে বেকারত্বের হার, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা, শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের হার, প্রবাসী শ্রমশক্তির সংখ্যা ইত্যাদি। আর তার ভিত্তিতেই করা হয় কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, বিনিয়োগসহ তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নানা পরিকল্পনা। বিবিএস দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় খানা ডাটাবেইস জরিপ (এনএইচডি) করেছে এবার।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান বলছে, এসব জতীয় গুরুত্বপূর্ণ জরিপ-শুমারির নামে চলছে ফাঁকিবাজি, গাফিলতি, খামখেয়ালি আর টাকা লুটপাটের মচ্ছব।

কৃষিশুমারিতে বেশুমার লুটপাট : গত ৯ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দেশজুড়ে কৃষিশুমারি করার কথা থাকলেও সেটা গড়ায় ২৮ জুন পর্যন্ত। দেশের মোট সাড়ে তিন কোটি খানা (১৬ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ—প্রতি খানার আওতায় ৪.০৬ জন) থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে এক লাখ ৪৪ হাজার ২১১ জন গণনাকারী (৯ হাজার টাকা করে) ও ২৪ হাজার ৭০০ জন সুপারভাইজর (১০ হাজার টাকা করে) নিয়োগ দিয়ে তাঁদের তিন দিনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল গত রমজানের সময়। অনুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেক গণনাকারীর জন্য প্রতিদিন ১২৫ টাকা করে সাড়ে চার কোটি টাকা সম্মানী রাখা ছিল। সুপারভাইজরদের জন্যও প্রশিক্ষণ বাবদ প্রতিদিন ১২৫ টাকা করে রাখা ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণের পর সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও লক্ষ্মীপুর সদরের এমরান আহমেদ, নোয়াখালীর মাসুদ আহমেদ, রাঙামাটি সদরের সবিনা চাকমা ও কেলভিন চাকমা, চট্টগ্রামের রাজু আহমেদসহ অন্তত ১০ জন গণনাকারীর সঙ্গে গত ৭ ও ৮ আগস্ট ফোনে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা কেউই প্রশিক্ষণের টাকা পাননি। একইভাবে লক্ষ্মীপুর সদরের কাজী দেলোয়ার হোসেনসহ চারজন সুপারভাইজরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরাও জানান, কেউ প্রশিক্ষণের টাকা পাননি। পরিসংখ্যান কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঝামেলা করলে ভবিষ্যতে আর কোনো কাজ পাবেন না এমন ভয় থেকে কেউ টাকা পাওয়ার চেষ্টাও করেননি। রাঙামাটি সদরের সুপারভাইজর অনিল কান্তি চাকমার দুঃখের কথা আগেই বলা হয়েছে। রাঙামাটিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা এ এইচ এম ওহিদুজ্জামান গত মাসে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ জেলায় কেউ কৃষিশুমারির টাকা পাননি, আমার কাছে এমন অভিযোগ আসেনি। তার পরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

এর আগে ১ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জুনিয়র পরিসংখ্যান সহকারী আবু মুসা অভিযোগ করেন, এবারের কৃষিশুমারিতে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সম্মানী ও আপ্যায়ন বিল পেতে অনেক দেরি হয়েছে। টি-শার্ট, ক্যাপ ও ছাতা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। জামালপুরের সাবেক কৃষি কর্মকর্তা আবদুস সালাম, যিনি ওই কৃষিশুমারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ওই রাতে কালের কণ্ঠ’র কাছে একই অভিযোগ তুলে ধরেন।

কৃষিশুমারিতে মানুষ যাতে সঠিকভাবে তথ্য দেয়, সে জন্য সারা দেশের দুই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদে প্রচার-প্রচারণার খরচের জন্য ৪০ লাখ টাকা রাখা ছিল। কিন্তু গত ১৫, ১৬ ও ১৭ আগস্ট কুমিল্লা, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি ও ময়মনসিংহ—পাঁচটি জেলার জোনাল অফিসার ও সুপারভাইজরদের কাছে খবর নিয়ে জানা গেল, এ ধরনের কোনো প্রচার-প্রচারণা সেখানে হয়নি।

সাধারণত কোনো জরিপ ও শুমারি চালানোর জন্য মোক্ষম সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মে মাস। তখন আবহাওয়া ভালো থাকে। কিন্তু সর্বশেষ কৃষিশুমারির কাজটি হয় গত ৯ জুন থেকে ২৮ জুন। সময়টি ছিল ভরা বর্ষা। কখনো বৃষ্টি, কখনো তীব্র দাবদাহে গণনাকারী ও সুপারভাইজররা মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে পারেননি। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত যে চারবার কৃষিশুমারি হয়, প্রতিটিই ডিসেম্বর থেকে মে সময়কালে হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা কেন বর্ষায় করা হলো, সে এক রহস্য। তার চেয়ে বড় রহস্য হলো, এই কৃষিশুমারি চালানো হয়েছে খোদ ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ অন্য বড় সিটিগুলোতেও। এই রাজধানী শহরে কৃষক কোথায় আর কৃষিজমি কোথায়?—এই প্রশ্ন ঘুরছে বিবিএসের মধ্যেই। এবারের কৃষিশুমারির বরাদ্দ ৩৪৫ কোটি টাকার পুরোটাই জলে গেছে—বিবিএসের পরিচালক ও উপপরিচালক পর্যায়ের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা এ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ সংগত কারণেই নাম প্রকাশ করতে রাজি নন।

কৃষিশুমারি শহরাঞ্চল ঘিরে করা উচিত কি না এই প্রশ্ন গত রাতে রাখা হয় বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সাত্তার মণ্ডলের কাছে। তিনি বলেন, শহরাঞ্চলে কৃষিশুমারি করা সময়ের অপচয় মাত্র। সেই সঙ্গে তথ্যের বিভ্রান্তিও ঘটতে পারে। কারণ শহরাঞ্চলে তো কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ থাকে না। শহরে কেউ গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন কিংবা জমি চাষবাস করে না। যেকোনো জরিপ-শুমারি পরিচালনার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, কার কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হবে। শুমারির সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই শহরের দিকে মনোযোগী না হয়ে ওই জনবল গ্রামে দেওয়া উত্তম বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। 

স্বাধীনতার আগে ও পরে কৃষিশুমারিগুলো কোন সময় করা হয়েছে তা জানতে গত ১৩ অক্টোবর খোঁজ করা হয় বিবিএসের লাইব্রেরিতে। সব শুমারির প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, ডিসেম্বর থেকে মে—এই সময়েই হয়েছিল সব শুমারি। পাকিস্তান আমলে প্রথম কৃষিশুমারি হয়েছিল ১৯৬০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ মার্চ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কৃষিশুমারি হয় ১৯৭৭ সালে, ১৪ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয়টি হয় মার্চ মাসে। তৃতীয়টি হয় ১৯৯৬ সালে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। ওপরের একটি কৃষিশুমারিতেও শহরাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০০৮ সালের ১১ থেকে ২৫ মে চতুর্থ কৃষিশুমারিতে প্রথম শহরাঞ্চল আনা হয়। 

কৃষিশুমারি করার সঠিক সময় আসলে কখন জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফকির আজমল হুদা গতকাল সোমবার বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ কৃষিশুমারির জন্য মোক্ষম সময়। কারণ বৈশাখের আগেই সব ফসল উঠে যায়। আষাঢ় মাসে শুমারি করলে ভালো ফল আশা করা যায় না। কারণ তখন গণনাকারীরা মাঠ পর্যায়ে তথ্য আনতে যেতে পারেন না।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার জোনাল অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান গত রাতে বলেন, জুন মাসে শুমারি করার কারণে দাবদাহে অনেক গণনাকারী অসুস্থ হয়ে যান। আবার টানা দুই দিন বৃষ্টিও ছিল। তাই শুমারি করতে সমস্যা হয়েছে। কৃষিশুমারির উপকরণ ছাতা ও টি-শার্ট পাননি বলে তিনিও অভিযোগ করেন।

জানতে চাইলে এবারের কৃষিশুমারির প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) জাফর আহমেদ গত ২০ আগস্ট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুপারভাইজর ও গণনাকারীরা কেন টাকা পাননি, আমি খবর নেব।’ তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা পেতে এবার দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি। অসময়ে কেন শুমারি করা হলো জানতে চাইলে জাফর আহমেদের জবাব, ‘ফেব্রুয়ারিতে করার কথা ছিল। কিন্তু বাজেট না পাওয়ায় দেরি হয়েছে।’ মাঠকর্মীদের অনেকে টাকা ও উপহারসামগ্রী কেন পাননি প্রশ্ন তুললে জাফর আহমেদ বলেন, ‘কেউ আপনাকে আমার পেছনে লাগিয়েছে। আমার অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।

শেষ হয় না ধনী-গরিবের তালিকা : দেশের দুস্থ-অসহায়-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের ১৪৫টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপযুক্তদের বদলে সচ্ছলদের ভাতা পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মত, এই অনিয়মের প্রধান কারণ দেশে ধনী-দরিদ্রের কোনো তালিকা না থাকা। চলতি অর্থবছরের ৭৪ হাজার কোটি টাকাসহ সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার স্বচ্ছতা আনতে ২০১৩ সালে প্রতিটি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজে হাত দেয় বিবিএস। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় খানা ডাটাবেইস জরিপ (এনএইচডি) চালিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো একটি ধনী-দরিদ্রের তালিকা তৈরি করা। সেই তালিকা ধরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সত্যিকারের দরিদ্রদের ভাতা দেবে। ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে তিন কোটি খানার তথ্য সংগ্রহ করার প্রকল্প এনএইচডি ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটা পারেনি পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। উপরন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কাছে আবেদন করে আরো দুই বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, ৩২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৭২৭ কোটি টাকা করা হয়েছে।

এই অনুসন্ধানের জন্য বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডারের অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রথম ধাপের তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সময়ের পার্থক্য অনেক বেশি—প্রায় এক বছর। এ কারণে দুটি ধাপের তথ্যের সমন্বয় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তা ছাড়া ২০১৭ সালে মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের গুণগত মান এত দিন ধরে রাখাও অসম্ভব। ২০২১ সালে যখন এই প্রকল্পের আওতায় চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হবে, তখন তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি খানা থেকে তথ্য আনার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এই প্রকল্পে তা করা হয়নি। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে অনেক খানা থেকে তথ্য আনা হয়নি বলে এই প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বিভিন্ন সভায় আলোচনা হয়েছে। এ ধরনের কয়েকটি সভার কার্যবিবরণী কালের কণ্ঠ’র সংগ্রহে আছে। সেগুলো থেকে এসব তথ্য জানার পর রাজধানীর মিরপুরে কয়েকটি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, যারা সরকারের দেওয়া বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য। তালতলায় ৫২৭ নম্বর বাসায় ভাড়ায় থাকেন ষাটোর্ধ্ব হালিমা খাতুন। একটি টং দোকান দিয়ে সংসার চলে তাঁর। গত ৫ আগস্ট হালিমার দোকানে গিয়ে ‘সরকারের কেউ বাসায় এসে তথ্য নিয়েছে কি না’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো দিন আমার নামটাও জানতে আসেনি।’ সরকারের কোনো সুবিধাই তিনি পান না বলে জানালেন। একই দিন পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৪৭৩ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকা নাজমা আক্তারও একই কথা জানালেন।

নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সারা দেশে সাড়ে তিন কোটি খানা থেকে তথ্য আনতে আদমশুমারি, কৃষিশুমারিসহ অন্য জরিপে টানা ২০ দিন কিংবা এক মাসের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলা হয়। পঞ্চম আদমশুমারি হয়েছে সাত দিনে। কিন্তু এনএইচডির ক্ষেত্রে সাড়ে তিন কোটি পরিবার থেকে তথ্য নেওয়া হয় তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ২০১৭ সালের এপ্রিলে; দ্বিতীয় ধাপে ৯ মাস পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এবং তৃতীয় ধাপে আরো ৯ মাস পর সেপ্টেম্বরে। পরিসংখ্যানের নিয়ম হলো—কোনো শুমারি ও জরিপের সময় মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করার ছয় মাসের মধ্যে প্রাথমিক ফল ঘোষণা করতে হয়। প্রতিটি প্রকল্প দলিলে এ কথা লেখা থাকে। কিন্তু ছয় মাস দূরের কথা, ছয় বছরেও এনএইচডি প্রকল্পের ফল ঘোষণা করতে পারেনি সংস্থাটি।

এর কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সফিউল আলম গত আগস্ট মাসে বললেন, ‘কাজটি অনেক বড়। প্রতিটি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। মাঠ থেকে তথ্য এনে আমরা এখন ডাটা স্থানান্তর করছি। আমাদের আরো কিছু সময় লাগবে।’

‘কিন্তু সব খানা থেকে তথ্য আনা হয়নি বলে আমাদের অনুসন্ধান বলছে’ জানালে সফিউল আলম বলেন, ‘শহর এলাকা থেকে তথ্য আনা খুব কঠিন। আমাদের দেশবাসীর মাঝে এখনো তথ্য দেওয়ার প্রবণতা ও আগ্রহ গড়ে ওঠেনি। তাই কিছুটা সমস্যা হয়েছে।’ গত ছয় বছরে পাঁচজন প্রকল্প পরিচালক কাজ করার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দেরি হওয়ায় প্রকল্পের এমন বেহাল বলে জানান সফিউল আলম।

অর্থহীন অর্থনৈতিক শুমারি : ১৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে করা অর্থনৈতিক শুমারির ফল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দুই বছর আগে প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন অর্থনৈতিক শুমারির যে ফল দিয়েছেন, সেটি এ বছর হালনাগাদ করতে গিয়ে আগের শুমারির অসংগতি খুঁজে পেয়েছেন বিবিএসের শিল্প শাখার পরিচালক ঘোষ সুবব্রত। আগের শুমারিতে দেখা গেছে, ১০ জনের বেশি জনবল আছে এমন স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সারা দেশে পাওয়া গেছে এক লাখ ৫৫ হাজার। সেটি এবার কমে হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার। দুই বছরের ব্যবধানে স্বাভাবিকভাবে যেখানে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাড়ার কথা, সেখানে কেন কমেছে জানতে চাইলে ঘোষ সুবব্রত বলেন, সারা দেশে রাস্তাঘাট ও সড়ক উন্নয়ন কাজের কারণে অনেক দোকান উচ্ছেদ হয়ে গেছে। সে কারণে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমতে পারে।

দুই কর্মকর্তার পাওয়া দুই ধরনের তথ্যের সূত্র ধরে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে অর্থনৈতিক শুমারির প্রকল্প প্রস্তাবটিই (ডিপিপি) সংগ্রহ করে ফেলা হয়। সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেল, প্রথম দফার শুমারিতে সারা দেশ থেকে দোকানপাট, শিল্প-কারখানা মিলিয়ে এক কোটি ১০ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিটের তালিকা সংগ্রহ করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন। কিন্তু প্রতিবেদনে তিনি ৮৫ লাখ ইউনিটের কোড নম্বর দিয়েছেন এবং তা কম্পিউটারে ধারণ করা হয়েছে। বাদ পড়েছে ২৫ লাখ ইউনিট। এরপর অর্থনৈতিক শুমারির চূড়ান্ত ফল যখন প্রকাশ করা হয়, তখন প্রকল্প পরিচালক দিলদার ৭৮ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিটের তথ্য প্রকাশ করেন। এবার বাদ পড়ল আরো সাত লাখ ইউনিট। আর আগের বাদ পড়া ২৫ লাখের তো খবরই নেই।

এভাবে দুই বছর আগের ফল ও এবারের ফল—দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ে যেসব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হয়, তা এই শুমারি থেকে তথ্য নিয়েই করা হয়। এই মুহূর্তে দেশে কোন শিল্প উদীয়মান; ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কী অবস্থা; কোন জেলায় শিল্প কম, কোন জেলায় বেশি; কোন শিল্প লোকসানে আছে আর কোন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়া জরুরি—এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই শুমারি থেকে জানা যায় এবং সেইমতো সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ফলের ভিত্তিতে এ রকম রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত-পরিকল্পনার পরিণতি যে কী হয়, তা বলাই বাহুল্য।

জানতে চাইলে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে অর্থনৈতিক শুমারির প্রকল্প পরিচালক উপসচিব দিলদার হোসেন বলেন, ‘আমি যে শুমারি করেছি, সেখানে দশের বেশি জনবলবিশিষ্ট স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার। সেটি এখন কেন কমে এক লাখ ৩৪ হাজারে নেমে এসেছে, তা দেখতে হবে; জানতে হবে। এবার যারা হালনাগাদ তথ্য বের করেছে, তারা কী প্রক্রিয়ায় সেটা করেছে, আমি জানি না।’

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে : ইশরাক

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে : ইশরাক
ইশরাক হোসেন

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই যে এনসিপির কেউ জয়লাভ করবে। তাই তারা পিআর পদ্ধতির নামে নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত করছে।

তিনি বলেন, জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে। কারণ শহীদরা কেউ জানত না তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে কারো মধ্যে ক্ষমতার লোভ জাগবে।

গতকাল রবিবার রাজধানীর নয়াবাজারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কটূক্তি, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে এক মশাল মিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। নয়াবাজার মোড় থেকে মশাল মিছিলটি তাঁতীবাজার, গুলিস্তান, পল্টন হয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়।

ইশরাক হোসেন বলেন, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি-বাক স্বাধীনতা আছে, তার মানে এই নয় যে আরেকজনের স্বাধীনতা হরণ করবেন, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করবেন। এনসিপি আজকে যেভাবে শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা বলছে, সেটিকে গণতন্ত্র বলে না।

কক্সবাজারে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী যে শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা বলেছেন তার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নতুবা চকরিয়ার মতো সারা দেশে জনগণ তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে।

তিনি বলেন, আজকে দেশে কিছু হলেই এনসিপি-জামায়াত বিএনপির দিকে আঙুল তোলে। তারা ভালোভাবেই জানেদেশে নির্বাচন হলে বিএনপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে।

তাই একেক সময় একেক অযৌক্তিক দাবি জানিয়ে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে তারা।

বিএনপির এই নেতা বলেন, আজকে জুলাই শহীদদের নিয়ে ফায়দা লোটা হচ্ছে। আমি জানতে চাইজুলাই আন্দোলনে এনসিপি-জামায়াতের কতজন শহীদ হয়েছেন? এনসিপি নেতারাও ভালোভাবে জানেন, পর্দার আড়ালে এই আন্দোলন তারেক রহমান তত্ত্বাবধান করেছেন এবং বিএনপি ও ছাত্রদল-যুবদলের নেতারা মৃত্যুর অগ্রভাগে ছিলেন। আজকে ক্ষমতার লোভে তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গেছেন। শুধু তাই নয়, তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও তাঁদের বিবেক একটুও কাঁপে না।

তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় বিএনপির তিনজন নিহত হলো। তখন কেন এত প্রতিবাদ হলো না, রাষ্ট্রযন্ত্র কেন নিশ্চুপ ছিল? এনসিপির সমাবেশ ঘিরে যে পাঁচটি জীবন গেল তার দায়ভার কে নেবে?

ইশরাক বলেন, মুরাদনগরে উপদেষ্টা আসিফ সজীব ভূঁইয়া কী করছেন তা সবাই অবগত। একের পর খুন হচ্ছে। হত্যা হলেই যাচাই-বাছাই না করেই বিএনপির ওপর দোষ চাপানো হয়। আর যখন দেখে এখানে নতুন একটি দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে তখন মিডিয়াও নিশ্চুপ হয়ে যায়। মুরাদনগরে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর এখন যত নির্যাতন চলছে তা আওয়ামী লীগ আমলেও হয়নি।

মন্তব্য
অ্যামচেমের নীতি সংলাপে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

পাল্টা শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
পাল্টা শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই

ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপিত হবে। পাল্টা শুল্ক আরোপিত হলেও এসব কথা বারবার বলে উদ্বেগ তৈরির দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সরকার যা যা করার সেটা করছে।

গতকাল রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) আয়োজিত টেকসই বিনিয়োগ বিষয়ক এক নীতি সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন উপদেষ্টা।

সংলাপের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর জ্বালানি, পোশাক ও তামাক খাত নিয়ে আলাদা তিনটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে পোশাক খাত নিয়ে উপস্থাপনা দেন বেসরকারি রিকভারি গ্রুপের প্রধান রূপান্তর কর্মকর্তা ফাহমি মুহসিন। তামাক খাতের টেকসই বিনিয়োগ নিয়ে উপস্থাপনা দেন ফিলিপ মরিস গ্রুপের এদেশীয় ব্যবস্থাপক রেজওয়ানুর রহমান মাহমুদ এবং জ্বালানি খাতের টেকসই বিনিয়োগ নিয়ে উপস্থাপনা তুলে ধরেন শেভরন বাংলাদেশের পরিচালক ইমরুল কবির। উপস্থাপনা শেষে শুরু হয় মূল আলোচনা পর্ব।

আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত অতিথিদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরও পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে বলা হয়েছিল; কিন্তু সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করায় এই খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। একসঙ্গে চললে সব বাধা দূর হবে। টেকসই বিনিয়োগ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, টেকসই বিনিয়োগের ধারণাটি বিশ্বের সব দেশের জন্য হওয়া উচিত।

কিন্তু আমরা দেখছি, যারা দূষণের জন্য বেশি দায়ী, তারা এ ধরনের বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। টেকসই পৃথিবী বিনির্মাণে শুধু টেকসই বিনিয়োগে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; জীবনধারণের পদ্ধতিও টেকসই হতে হবে। ভোগপ্রবণতাও কমাতে হবে। পানি কম ব্যবহার করতে হবে।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের বস্ত্র খাতে আমরা বেশ কিছু টেকসই বিনিয়োগ দেখতে পাচ্ছি, যেখানে কম পানি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।

শিল্পের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। জ্বালানির মিশ্রণ নিয়েও আমরা কাজ করছি, যাতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান জ্বালানিসংকটে না থাকে। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা উৎপাদন খাতে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে চাই।

আলোচনা শেষে ট্যানারিশিল্প নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখানে যৌথ ব্যর্থতা ছিল। এই ব্যর্থতার জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। সরকার বিনিয়োগ করেছে। আবার ব্যবসায়ীরা সক্ষমতার চাহিদা দিয়েছিল। এখন এই শিল্প নিয়ে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা হলে কিছু না কিছু ছাড় পাওয়া যাবে। এ ধরনের আলোচনা শুধু আমাদের সঙ্গে হচ্ছে না। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা আমেরিকা থেকে তুলা আনার কথা বলছি। কাস্টমসের সংস্কার নিয়ে কথা বলেছি।

অ্যামচেম সভাপতি আরো বলেন, দূষণ এখন শুধু পরিবেশগত কোনো বিষয় নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ৩.৪ শতাংশ দূষণের কারণে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে।

সংলাপে অ্যামচেমের সদস্য প্রতিষ্ঠান রিকভার, ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেড ও শেভরন বাংলাদেশ তাদের টেকসই উদ্যোগ তুলে ধরে।

মন্তব্য

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও পিআরের নামে প্রতারণার জাল

শরীফুল আলম সুমন
শরীফুল আলম সুমন
শেয়ার
বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও পিআরের নামে প্রতারণার জাল

অনেক শিক্ষার্থীর পছন্দের তালিকায় এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষা। আবার অনেকেই উন্নত জীবনযাপনের আশায় বিদেশে পার্লামেন্ট রেসিডেন্সি (পিআর) ও সিটিজেনশিপ পেতে চান। আর এই সুযোগই নিচ্ছে রাজধানীতে গড়ে ওঠা অনেক কনসালটেন্সি ফার্ম। তারা তাদের ওয়েবসাইটে আকর্ষণীয় নানা তথ্য তুলে ধরে।

এরপর ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। এমনকি তাদের অফিস খুবই পরিপাটি করে সাজায়। ফলে আগ্রহী প্রার্থীদের একবার অফিসে নিতে পারলে অনেকটাই পটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। আর একবার একটি ধাপ শুরু করলে পরে আর বের হওয়ার সুযোগ থাকে না।
আর এভাবেই হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক কনসালটেন্সি ফার্ম।

ইউনেসকোর গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল এডুকেশন শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে শুধু ৫০ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া ও ভিসা প্রসেসিং সম্পন্ন করে। বিনিময়ে ফার্মগুলো ক্ষেত্রভেদে একেকজনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।

সূত্র জানায়, সারা দেশে নামে-বেনামে দুই হাজারের মতো কনসালটেন্সি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই রাজধানীতে। তবে তাদের অনেকেই কিছুদিন পর পর অফিস পরিবর্তন করে। সরকারের মনিটরিং না থাকায় ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেছে কয়েকটি চক্র। আর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাঁর পরিবার।

ওয়েবসাইটে অনেকটা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহী প্রার্থীদের আকর্ষিত করছে এডুএইড নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, তারা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে স্কিলড মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে কনসালটেন্সি করে। সিটিজেনশিপ ও পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেয় তার্কি, ভানুয়াতু এবং অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডায়। আর রেসিডেন্সির ব্যবস্থা করে হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, ইউএই ও সৌদি অ্যারাবিয়ায়। আর বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের আছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউকে, ইউএসএ, আয়ারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন দেশে স্কুলিং ভিসার মাধ্যমে পরিবারকে বিদেশে পিআরের ব্যবস্থা করে দেয়। এ ছাড়া তারা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়িত আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিভিন্ন সেমিনার ও মেলারও আয়োজন করছে। তাদের গুলশান-১, ধানমণ্ডিসহ দেশের বাইরে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে।

গত মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিকেলে পরিচয় গোপন করে এই প্রতিবেদক এডুএইডের গুলশান অফিসে যান। সেখানে প্রথমে রিসেপশনে জানতে চাওয়া হয়, আপনি হায়ার এডুকেশন, স্কিলড মাইগ্রেশন, পিআর, না সিটিজেনশন কোন ব্যাপারে আলোচনা করতে চান। স্কিলড মাইগ্রেশন ও পিআরের কথা বললে একজন কনসালট্যান্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিভিন্ন দেশের স্কিলড মাইগ্রেশনের কথা বলেন। একজনের জন্য তাঁরা আট লাখ টাকা ফি নেন। এর সঙ্গে স্ত্রী যুক্ত হলে ১০ লাখ, আবার একজন সন্তান যুক্ত হলে ১১ লাখ টাকা নেন বলে জানান। এই ফি তাঁরা স্টেজ বাই স্টেজ নেন। তৃতীয় স্টেজ পর্যন্ত গেলে আর ফির টাকা ফেরত দেওয়া হয় না বলে জানান।

এরপর পিআর ও সিটিজেনশিপের জন্য এডুএইডের আরেকজন কনসালট্যান্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জানান, বর্তমানে জাপানে পিআর খুবই ইজি। এ জন্য প্রথমে একবার ওখানে গিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট করে ৩৫ হাজার ডলার জমা রাখতে হয়। তাঁরা তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ওই অর্থ ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেবেন। আর তাঁদের ফি একজনের জন্য আট থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া লাগতে পারে। আর তুরস্কে পিআরের জন্য পাঁচ কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। সেটিও তাঁরা তৃতীয় দেশ থেকে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তাঁরা তুরস্কের পাসপোর্টেরও ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে তাঁদের কত টাকা ফি দিতে হবে, সেটি আলোচনা সাপেক্ষে বলে জানান।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার আবেদনের তৃতীয় স্টেজ খুবই সাধারণ ধাপ। অর্থাৎ অনেকটা প্রাথমিক আবেদনের মতো। সেখানে সহজেই যাওয়া যায়। ফলে যাঁরা ফি দেন, তাঁদের ভিসা না হলেও তা আর ফেরত পান না। আর এডুএইড ইউএই, সৌদি আরব, তার্কি, লাটভিয়া, ক্যারিবিয়ানসহ অন্য বেশ কিছু দেশে যে পিআরের কথা বলছে, তা এখন অনেকটাই বন্ধ। আবার তারা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ করছে। 

জানা যায়, চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে অসাধু এজেন্সিগুলো প্রধানত তিন ধরনের প্রতারণা করে থাকে। এক. শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া অসম্পন্ন রাখা ও বিদেশে না পাঠানো। দুই. আগ্রহী প্রার্থীদর ভুয়া কাগজ তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করা। তিন. ভিসা করে বাইরে পাঠিয়ে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের বাইরে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতারকচক্রগুলো এখন লাগামহীন। এটিকে মানবপাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের নতুন ক্ষেত্র বলছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

সূত্র জানায়, কনসালটেন্সি ফার্মগুলোর কর্মকাণ্ড তদারকির কোনো ব্যবস্থা সরকারের নেই। কেবল পরামর্শক হিসেবে একটি ট্রেড লাইসেন্স বা কম্পানি করেই প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন ফার্মসংশ্লিষ্ট প্রতারকরা। মামলা বা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলা হয় ৪২০ ধারায়। ফলে আসামিদের বেশির ভাগ জামিনে বের হয়ে যায়।

বিদেশে ভর্তির নামে স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি করা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাডক্যাব)-এর সদস্যসংখ্যা চার শর মতো। অথচ রাজধানীর ফার্মগেট, পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কাকরাইল, উত্তরা, গুলশান, মহাখালীসহ সারা দেশে এই সংখ্যা দুই হাজারের মতো।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন কন্সালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার যাঁরা হন, তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্তসাপেক্ষ অভিযান পরিচালনা করে প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে থাকি। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব কিছু নজরদারি থাকে। এতে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি প্রতারণা করে এমন পাওয়া যায়, তাদের সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় আনা হয়।

সম্প্রতি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ রকম তিনজনের প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছে। উত্তরার ট্রাভেলার এজ বিডি নামের একটি প্রতিষ্ঠান সাব্বির হোসেন (২১), শামীমুল হক ও আমিনুল ইসলাম নামের তিনজনকে পড়াশোনার জন্য কানাডায় পাঠানোর কথা বলে যথাক্রমে ২০ লাখ, ১৫ লাখ ও ১৭ লাখ টাকা নেয়। এরপর তাঁদের কানাডায় না পাঠিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে শুরু হয় তাঁদের মানবেতর জীবন। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ইন্দোনেশিয়া পুলিশ তাঁদের আটক করে এবং ১৭ দিন তাঁরা জেলহাজতে থাকেন।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এম কে খায়রুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খায়রুল বাশার তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশনকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র গড়ে তোলেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, স্কলারশিপ ও ভিসা প্রক্রিয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপনে চটকদার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বহু শিক্ষার্থীর নামে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করা হয়নি। ভুয়া অফার লেটার তৈরি করে তারা নিজেরাই টাকা আত্মসাৎ করেছে। আবার অনেককে পাঠাতে পারলেও তাঁরা বিদেশে গিয়েও নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তাঁদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রুমন আলী লস্কর বলেন, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, স্কলারশিপ ও ভিসার নামে আমাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করে। আমার মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। গড়ে প্রত্যেকের ২০ লাখ টাকা করে হিসাব করলে অন্তত ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা করা হয়েছে।

মন্তব্য
ফিরে দেখা ২১ জুলাই ২৪

কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল সংঘর্ষে সারা দেশে আরো ১৯ জন নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল সংঘর্ষে সারা দেশে আরো ১৯ জন নিহত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১ জুলাই। শুরুতে অহিংস থাকলেও ১৫ জুলাই থেকে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ ছয়জন নিহত হন। নজিরবিহীন সহিংসতা ও সংঘর্ষে পরের মাত্র চার দিনে (২০ জুলাই পর্যন্ত) নিহতের এই সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় শর কাছাকাছি।

দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেও থামানো যাচ্ছিল না মৃত্যুর মিছিল।

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ২১ জুলাই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে এবং ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সাত শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

তবে আগের দিনের মতো গত বছর ২১ জুলাইও কারফিউয়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।

সংঘর্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে এদিন ১৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, নরসিংদীতে চার, গাজীপুরে দুই, নারায়ণগঞ্জে এক, সাভারে এক ও চট্টগ্রামে একজনের মৃত্যুর খবর জানায় গণমাধ্যমগুলো। 

 

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ঝরেছে অনেক প্রাণ

২০১৮ সালে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০২৪ সালের ২১ জুলাই রায় দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।

এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অবিলম্বে গেজেট জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই নির্দেশনার পরও সরকার প্রয়োজনে আদালত নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

 

শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া

কোটা ইস্যুতে আপিল বিভাগের রায়কে স্বাগত জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আপিল বিভাগের রায়কে শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, রায়ের পর শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে চার দফা দাবি পূরণে আন্দোলনের সমন্বয়করা ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। চার দফা দাবির মধ্যে ছিলকারফিউ তুলে দেওয়া, ইন্টারনেট চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খুলে দেওয়া এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া আন্দোলনে সংঘটিত গত্যাকাণ্ডের বিচারসহ আট দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহবান জানানো হয়। সেই সঙ্গে পরদিন ২২ জুলাই গায়েবানা জানাজা কর্মসূচির ঘোষণাও দেন শিক্ষার্থীরা।

তবে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ। তাদের মতে, ভবিষ্যতে কোটার পরিমাণ নিয়ে সরকারের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে এ সংক্রান্ত আইন পাস করার দাবি জানায়।

 

রাজধানীসহ সারা দেশের পরিস্থিতি

এদিন ভোরে রাজধানীর পূর্বাচল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায়। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর নন্দীপাড়ার এক বন্ধুর বাসা থেকে নাহিদ ইসলামকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করে তার পরিবার।

২১ জুলাই ছিল সরকারঘোষিত দুই দিন সাধারণ ছুটির প্রথম দিন। এদিনও সারা দেশ ছিল ইন্টারনেটবিহীন, বলবৎ ছিল কারফিউ। জরুরি পরিষেবা রোগীবাহী অ্যাম্বুল্যান্স, গণমাধ্যমের গাড়ি এবং আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের যাত্রীরা টিকিট দেখিয়ে যাতায়াতের সুযোগ পায়।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, পরের দিনও দেশে কারফিউ বলবৎ থাকবে। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। ঢাকা জেলা ও মহানগর, গাজীপুর জেলা ও মহানগর এবং নারায়ণগঞ্জে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্য জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসকরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কারফিউয়ের মধ্যেও এদিন রাজধানীর বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল ও মিরপুর এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন সড়কে জড়ো হয় বিক্ষোভকারীরা। সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে আহত হয় শতাধিক ব্যক্তি।

দুপুরে রাজধানীর কুড়িল চৌরাস্তা ও নর্দা সড়ক অবরোধ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।

মিরপুরে বিক্ষোভকারীরা মেট্রো রেলের কাজে ব্যবহৃত তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায়ও।

রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ ও চৌধুরীপাড়া এলাকা ছিল থমথমে। আগের দিনের তুলনায় এসব এলাকার সড়ক ও অলিগলিতে মানুষ ও যানবাহনের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়ভাবে কম।

তবে বিকেল ৩টায় দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে সড়ক ও অলিগলিতে মানুষ ও রিকশার উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।

এদিন রাজধানীর বাইরে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয় নরসিংদীতে। দুপুরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধলে চারজন নিহত হন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক শ আন্দোলনকারী আহত হন। এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯ গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

বাসস বলছে, রাজধানীর সেতু ভবন ভাঙচুর, রামপুরার বিটিভি ভবনে আগুন দেওয়া ও বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন মামলায় এদিন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায় ও গণ-অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এদিন এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পক্ষ থেকে বলা হয়, ৩১ জুলাই পর্যন্ত পিএসসির সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

 

বিদেশি কূটনীতিকদের সরকারের ব্রিফিং, আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির

এদিন রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিদেশি কূটনীতিকদের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিংকালে সরকারের পক্ষে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, কোটা বাতিল ও সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে পুঁজি করে স্বাধীনতাবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী সামপ্রতিক সহিংসতা চালিয়েছে। ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের একটি ভিডিও দেখানো হয়।

 

দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক

২১ জুলাই রাতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সামরিক-বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার উপস্থিত ছিলেন।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ