<article> <p>অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেট পেশ করেছেন গত ৬ জুন। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে মোট পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৯৭১ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। বাজেটের মোট বরাদ্দের বিপরীতে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা এবং মোট ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ ৫৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।</p> <p>অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই বলা চলে ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। কেননা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বাস্তবতাই হচ্ছে উন্নয়ন করতে হলে ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমেই করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল, সব দেশই ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করে শুধু উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য। নিজস্ব অর্থের জোগান নিশ্চিত করে উন্নয়ন করতে গেলে সেই উন্নয়ন কখনোই হবে না। বরং আগে ঋণ করে উন্নয়ন করা এবং পরে সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করাই এখনকার বাস্তবতা।</p> </article> <p>আর এ কারণেই উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখন ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করে থাকে। তাই বাজেট ঘাটতি থাকবে, সেটা নিশ্চিত। তবে এই ঘাটতির পরিমাণ কত হবে, সেটাই আলোচনার বিষয় হতে পারে। এদিক থেকে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। বাংলাদেশ ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে এবং এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৪.৬ শতাংশ, যা সহনীয় পর্যায়েই আছে।</p> <article> <p> </p> <p><img alt="ব্যয় সংকোচনের বাজেট এবং বাস্তবতা" height="311" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/13-06-2024/1.jpg" width="320" />এবারের বাজেটে কতটা ব্যয় সংকোচনের নীতি অনুসরণ করা হয়েছে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বাজেট প্রস্তুতের আগে থেকে জোর আলোচনা ছিল যে এবার সরকার ব্যয় সংকোচনের বাজেট প্রণয়ন করবে। বিশেষ করে প্রাক-বাজেট আলোচনায় যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা সবাই এমন ধারণা দিয়েছিলেন যে সরকারের এবার ব্যয় সংকোচনের বাজেটই প্রণয়ন করা উচিত। তা ছাড়া বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা, বিশেষ করে ডলার সংকট, তারল্য সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি যেখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা, সেখানে ব্যয় সংকোচনের বাজেট প্রণয়ন করা ছাড়া ভালো কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে সরকারের সামনে নেই।</p> </article> <p>ফলে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে ব্যয় সংকোচনের নীতি কতটা অনুসরণ করা হয়েছে, সেটি এখন সবচেয়ে বড় আলোচনা।</p> <article> <p>বাজেটে ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি আলোচনা করতে হলে প্রথমেই গত কয়েক বছরের বাজেটের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বাজেটের আকার ছিল ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ছয় লাখ ৭৪ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ৭০ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা গত বাজেট থেকে ৮৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটের মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের বাজেট থেকে ৩৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বেশি। ২০২১ সাল থেকে যে চারটি বাজেট পেশ করা হয়েছে সেখানে প্রতিবছরই বাজেট বরাদ্দ পূর্ববর্তী বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এবারের বাজেট মোটেও ব্যয় সংকোচনের বাজেট হয়নি। কিন্তু আমরা যদি একটু বেশি পেছনে ফিরে যাই তাহলে কিছুটা ভিন্ন অবস্থা দেখতে পাব। ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বাজেটের আকার ছিল মাত্র এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা, যা ১০ বছর পরে ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২১, এই ১০ বছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে চার লাখ ৭১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে ২০২১ থেকে ২০২৪, এই চার বছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়ছে মাত্র এক লাখ ৯৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। বাজেটের এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার যে ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাজেট বরাদ্দ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের বাজেটে সেভাবে ঘটেনি। এ থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায় যে সরকার বাজেট প্রণয়নে ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণ করেছে।</p> <p>২০২১ সাল করোনা অতিমারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছিল এক ধরনের শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। এই অবস্থা কেটে যেতে না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, তারল্য সংকটসহ দেশের অর্থনীতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকার স্বার্থে সরকারের ব্যয় সংকোচনের বাজেটে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আরো একটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে, সরকার সম্প্রসারণমূলক না সংকোচনমূলক বাজেট প্রণয়ন করেছে, সেটা সঠিকভাবে বুঝতে হলে উন্নয়ন বাজেটের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। গত চার বছর সরকার যে বাজেট দিয়েছে সেখানে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়নি। সার্বিকভাবে মোট বাজেট বরাদ্দের আকার যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে তা পরিচালনা ব্যয় এবং ঋণের সুদ পরিশোধের কারণে, যা মূলত অত্যাবশ্যক ব্যায়। এ কারণেই সরকার এবারের বাজেটে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬.৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এটিও অর্জন করতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে এবং এমনকি বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি মোটেই সহায়ক নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। তারা মুখে বলছে তাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। তাদের মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে, বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে এবং তাদের শেয়ারবাজার যথেষ্ট চাঙ্গা অবস্থায় আছে। কিন্তু বাস্তবে তারা সুদের হার হ্রাস করছে না। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কানাডাই প্রথম তাদের নীতি সুদহার মাত্রই ২৫ সেন্ট কমিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। </p> <p>আসলে আমেরিকা সুদের হার না কমালে বিশ্বব্যাপী সুদের হার হ্রাস হওয়া শুরু হবে না। সুদের হার হ্রাসের প্রক্রিয়া যদি এই বছরের শেষ দিক থেকে শুরুও হয়, তাহলেও অন্তত আগামী দুই বছর ডলারের উচ্চমূল্য বজায় থাকবে এবং এর ফলে আমাদের দেশেও ডলার সংকট বিরাজ করবে। আর ডলার সংকট থাকলে তারল্য সংকটও থাকবে এবং থাকবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ফলে ব্যয় সংকোচনের বাজেট হলেও এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যথেষ্ট কষ্টকর হবে। বিশেষ করে জিডিপি ৬.৭৫ শতাংশ অর্জন করা এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণেই বাজেট বাস্তবায়নে, বিশেষ করে ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঘাটতি বাজেটের দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে, যার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের পরিমাণ যাতে আরো কমানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের পরিবর্তে বন্ড ইস্যুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে সরকারের ঋণের ওপর প্রদত্ত সুদ বাবদ ব্যয় যেমন কম হবে, তেমনই দেশে তারল্য সংকটেরও কিছুটা উন্নতি হবে। মোটকথা, শুধু ব্যয় সংকোচনের বাজেট প্রণয়ন করলেই হবে না, এর সঠিক ও কার্যকর বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে।</p> <p><b>লেখক : </b>সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p>nironjankumar_roy@yahoo.com</p> <p> </p> </article>