<p><img alt="সরকার" height="207" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Harun/January-2024/April-2024/30-04-2024/Biddut Sarker_kalerkantho_pic (1).jpg" style="float:left" width="168" />তখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, কথাও হয়নি শুধু তার গল্প শুনেছি। গল্প শুনে শুনে তাঁর পায়ের ছাপ গুনে গুনে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি। না কোথাও পাইনি তাঁকে। সালটা হবে ১৯৬৭, যত বার কুমিল্লায় যাত্রা বিরতি করেছি ততবার খুঁজেছি তাকে। না, তখনো পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। </p> <p>দেয়াল লিখনে তার শিল্পীত হাতের কারুকাজ, সংবাদপত্র, বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর শৈল্পিক প্রকাশ ও বিকাশ আমাকে বিমুগ্ধ করেছে পলে পলে। ১৯৬৯ সালে এসে আমার বহু দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত আমার। অনেক দিন অদেখার মন্দ লাগাটা তাকে তাড়িত করত টমছম ব্রিজের নিউ হোস্টেলে আমার আস্তানায় চলে আসতে। গল্প হতো দিন গড়িয়ে রাতের সীমানায় পৌঁছা অব্দি।</p> <p>গল্প হতো এলোমেলো, যেখানে আনন্দের উৎস খুঁজে পেতাম সহজেই। এ সুখ এক বছর কাল, তারপর চলে এলাম বাগেরহাট। মেঘে মেঘে অনেক বেলা, বাতাসে বারুদের গন্ধ। ছুটে গেলাম ঢাকায়। সেখানে আবার দেখা হয়ে গেল প্রিয় শিবুদার সঙ্গে বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বারান্দায়। রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকছেন, মানচিত্র সমেত একটি পতাকার। আঁকা শেষ হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো সিগারেট সুখ টান দিতে দিতে। পরদিন সেই পতাকা প্রথমবার আ স ম আব্দুর রব কর্তৃক উত্তোলিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বাঁদিকের প্রবেশ দ্বারের ওপরে ছাদে। যে পতাকা এখন শুধু বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পত পত করে উড়ছে দখিনা হাওয়ায়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের আবির্ভাব ঘটলো একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর সেই পতাকা বুকে নিয়ে।</p> <p>সত্তরের গণঅভ্যুত্থান, পঁচিশে মার্চে গণহত্যার শুরু, সেই পতাকা বুকে জড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার সাহসী সন্তানরা দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ এ সমস্ত শব্দগুলোর সঙ্গে শিবু দা ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এক হাতে রাইফেল অপর হাতে শানিত কলম। রণাঙ্গন থেকেই প্রকাশিত হলো ‘অশ্রু হলো বারুদ’। অতপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামে দেশটি শত্রুমুক্ত হয়ে পুরোপুরি স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে জেগে উঠলো।</p> <p>এরপর ঢাকার বিভিন্ন আড্ডায় দেখা হতো। কথা হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ২৬নং দিলু রোড থেকে ফুলার রোড, টিএসসি থেকে শাহবাগের রেখায়ন হয়ে আজিজ সুপার মার্কেটে তাঁর হাতে গড়ে তোলা ‘অন্তরে’ রেস্তোরাঁয়। অনেক দিন পর কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের ‘উত্তমাশা’ সংগঠনের অতিথি হয়ে আসেন। কথা বলেন উত্তমাশার সদস্যদের সঙ্গে, জয়নগর স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে। গল্প শোনান মুক্তিযুদ্ধের শিহরণ জাগানো আলোকিত দিনগুলোর। এরপর তিনি এসেছেন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এ সকল বিশেষ দিনগুলোতে কখনো আমাদের আহ্বানে, কখনো তাঁর মনের তাগিদেই। পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধনগুলো বুঝি এমনই হয়। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরল মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন, আলোকিত করেছেন সহজ রশ্মি-কিরণে। সে যে শিবনারায়ণ, তাঁর পক্ষেই সম্ভব সাগর সেচে মুক্তো কুড়িয়ে আনা, উজ্জীবিত  করা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আলোর পথ খুঁজে দেওয়া।</p> <p>বন্ধু অরুণ চৌধুরী ও আমি এক সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলাম শিবুদার উপর একটি ডকুমেন্টারি বানাব। এ কাজে অন্য বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে কিছু দিনের মধ্যে তা বানিয়ে ফেলা হলো। দেশের বিশেষ বিশেষ  টিভি চ্যানেলে ডকুমেন্টারিটি প্রদর্শিত হলো এবং প্রশংসিতও হলো। ডকুমেন্টারিতে সত্য নির্ভর তথ্য থাকায় সবার দ্বারা বহুল সমাদৃত হয়েছে। শিবুদার রাজনৈতিক জীবনের প্রজ্ঞা ও প্রত্যয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা অংকনে তার ঐতিহাসিক অবদানের কথা তদানীন্তন ছাত্রনেতা ও বিজ্ঞজনের প্রশংসনীয় উক্তিসমূহ সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ তথ্যচিত্রে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।</p> <p>যে মানুষটি সাদা সার্ট, সাদা পায়জামা পরে, চপ্পল পায়ে হেঁটে হেঁটে ধির পায়ে চলে গেলেন পূর্ব থেকে পশ্চিমের ঘোর অন্ধকারের দিকে, কী তার অভিমান, কী তার অভিযোগ—কিছুই তো বলে যাননি। জানা হলো না, তার না বলা যত কথা।</p> <p><em><strong>লেখক: </strong>নির্বাহী সম্পাদক, আজকাল, টরনটো, কানাডা</em></p>