<p>‘আরে! আমার ভাই যে!’</p> <p>চোখ তুলে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠি। মরা মানুষ বেঁচে ওঠে কীভাবে? ভূতে আমি বিশ্বাস করি না। সামনে যাকে দেখছি তিনি জ্বলজ্যান্ত মানুষ!</p> <p>বর্ষার বৃষ্টিধোয়া দুপুর। বাতাসে কদম ফুলের মাতাল করা গন্ধ। পথের দুপাশে সবুজ ঝোপালো জঙ্গল, বর্ষায় এরা ডগমগে হয়ে ওঠে। ফসলের ক্ষেত কিংবা আম বাগান, ভেরাণ্ডা কচার বেড়া দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে ঘেরা। তার ফাঁকে ফাঁকে বিড়ালনখা ফুলের গোলাপি দ্যুতি। কোথায় যেন একটা বউ কথা কউ পাখি ডেকে চলেছে অবিরাম, দূরে বহদূরে, করুণ সুরে। ফুল আর পাখির টানেই চলেছি মাঠ পানে। হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা। সময়কে ও শৈশবের স্মৃতিময় জায়গাগুলো, ফুল-পাখিগুলোকে ধরে রাখতে চাই ক্যামেরার ফ্রেমে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা তেমাথা। তিন দিক থেকে তিনটে রাস্তা এসে মিলেছে বটগাছের তলায়। সেখানে একটা চায়ের দোকান, অলস লোকের ভিড়। সেই পথ দিয়েই চলেছি ইছামাতীর পুরোনো ভূতুড়ে খালটার দিকে। </p> <p>শহরে থাকি। আজকাল বাড়ি আসা হয় খুব কম। মাঝে মাঝে গ্রামে ফিরে তাই চেষ্টা করি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে।<br /> মিনিট পনেরো হাঁটার পর ওই কণ্ঠস্বর—‘আমার ভাই যে!’ গলাটা আয়ুব ভাইয়ের। ছেলেবেলার কত ম্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সাথে। তখন আমি খুব ছোট। আমার বাবার মামার বাড়ি আমাদের গাঁয়ের। বাবার মামা আমার বাবারই বয়সের। আমাকে খুব ভালোবাসতেন তাঁরা। সেই দাদুর বন্ধু আয়ুব ভাই। বড্ড গরিব। গরিব আমার ওই দাদুও। </p> <p>সীমান্তে বাড়ি। দেদারসে চোরাচালান হয়। গাঁয়ের একশ্রেণির লোকের পোয়াবারো। চোরাকারাবার করে দিন দিন ফুঁলে-ফেঁপে উঠছে সেসব মানুষ। যত কষ্ট আয়ুব ভাইয়েদের। সংসারে অভাব। পেট চালাতে চোরাচালানের মাল বইতে হয়। পুলিশ-বিডিআরের হুজ্জতও তাদের ওপর। আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তখন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ওঠেনি। সীমান্তরক্ষীদের ঘুষ দিয়ে অনেকটা অবাধে ওপারে যেতে পারত মানুষ। আয়ুব ভাইদের তো পেশাই ওই। </p> <p>একবার কলকাতা থেকে দারুণ একটা জিনিস কিনে আনলেন আয়ুব ভাই। একটা গ্যাস লাইটার। ধাতব। রুপালি রংয়ের। রোদ পড়লে ঝিকিয়ে ওঠে। চাকা ঘুরিয়ে আগুন ধরাতে হয় না। মাথায় একটা সুইচ আছে। টিপ দিলেই মাথাটা উঠে যায় ওপরে। আর আগুন জ্বলে ওঠে। কীভাবে আগুন জ্বলে, তা আমার জন্য রহস্যই। এই রহস্য টানে আমাকে। </p> <p>লোভি চোখে তাকাই সেটার দিকে। এত সুন্দর লাইটার আর কারো দেখিনি গাঁয়ে—বড়-বড়লোকেরও ঘরেও নয়। দাম নাকি পাক্কা এক শ টাকা। সেই যুগে এক কেজি চালের দাম ছিল পাঁচ টাকা, সেখানে এক শ টাকা দিয়ে একটা লাইটার কেনা রীতমতো বিলাসিতা।</p> <p>আয়ুব ভাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তাঁকে খুব পছন্দ করি। লাইটার কেনার পর আরI বেড়ে যায় তাঁর প্রতি আকর্ষণটা। যখনই দেখা হয় ওটা একবার চেয়ে নিই। ফেরৎ দিই নেড়েচেড়ে দেখে। দিতে মান চাই না! ইশ আমার যদি এমন একটা লাইটার থাকত! কত্ত সাধ আমার। কিন্তু দুধের সাধ ঘোলেই মেটাতে হয়। আয়ুব ভাই কখনো বিরক্ত হন না।</p> <p>তারপর ধীরে ধীরে বড় হই। লেখাপড়ার চাপে ভুলে যাই রুপালি লাইটারের কথা। কমে যায় ওপাড়ায় যাওয়াও। মাঠে-বাজারে আয়ুব ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। ‘আরে, আমার ভাই যে!’ বলে বুকে জড়িয়ে নেন। এ ভালোবাসা কক্ষণো ভোলার নয়। </p> <p>তখন পঞ্চম শ্রেণিতে আলাদা করে বৃত্তি পরীক্ষা হতো তখন। এজন্য যেতে হয় শহরে। মেস বানিয়ে থাকতে হয় কয়েকদিন। দরকার একজন রাধুনীর। অবাক হলাম, ভালোও লাগল, আমাদের রাধুনী হয়ে গেলেন প্রিয় আয়ুব ভাই। সঙ্গে তাঁর সেই রুপালি লাইটার। </p> <p>সেই শেষ। আয়ুব ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। পড়াশোনা করতে শহরে চলে গিয়েছিলাম। তারপর ঢাকায় চাকরি। দীর্ঘ পনেরো বছর আয়ুব ভাইয়ের আর দেখা নেই। মাঝে মাঝে তাঁর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই অদ্ভুত লাইটারের কথা। এক লহমায় কত্ত কত্ত স্মৃতি এসে ভিড় করে। সেই গ্রাম, সেই বর্ষার দুপুর। দাদুর কাঁচা ঘরের রোয়াকে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছেন আয়ুব ভাইয়েরা। কত্ত গল্প তাঁদের। সেসব গল্প আমাকে মুগ্ধ করে। তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ করে তাঁর লাইটার। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে মুখে বিঁড়ি গুঁজে দেন তাঁরা। ফস করে জ্বলে ওঠে রুপালি লাইটেরর মাথা। লালচে হলুদ সেই লাইটারের শিখা আমার বুকে শিহরণ তোলে। </p> <p>হঠাৎ একদিন মায়ের ফোন। প্রায় মাঝরাতে। ঢাকা শহরের ব্যস্তাতাও তখন কমে গেছে। মাঝে মাঝে রাতজাগা ট্রাকের ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনি। মালিবাগের রেলপথ দিয়ে রাতের নীরবতা খান খান করে ছুটে চলেছে দূরপাল্লার ট্রেন। তারই মাঝে মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। প্রতিদিনই মায়ের সাথে কথা হয়। কিন্তু এত রাতে তিনি ফোন করেন না কখনো। একটা দুঃসংবাদ দিলেন। করুণ গলায় বললেন, ‘খোকা, তোর আয়ুব ভাই মারা গেছে।’</p> <p>আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। পঞ্চাশ পেরোয়নি লোকটার বয়স। কী এমন অসুখ হলো? মা কারণ বলতে পারলেন না। আমাদের গ্রামটা অনেক বড়। এক পাড়ার মানুষ অন্য পাড়ার মানুষের খোঁজ রাখে না। আয়ুব ভাইদের বাড়ি পুব পাড়ায় আর আমাদের পশ্চিমপাড়ায়। কারো মৃত্যুর খবর শুনতে হয় মসজিদের মাইকে। অনেক কষ্ট, অনেক স্মৃতির সাথে যুদ্ধ করে সেদিন সারারাত জেগে ছিলাম। ইশ! কতদিন লোকটাকে দেখিনি। একটা ছবি পর্যন্ত তোলা হলো না তাঁর। আক্ষেপটা সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে আমাকে।</p> <p>আজ হঠাৎ আয়ুব ভাইকে জীবিত পাবো ভাবতেই পারিনি। আয়ুব ভাই মরেননি। তবে শরীরের কী হাল! শুধু হাড় কখানাই আছে। সেই প্রাণোচ্ছল, গল্পবাজ লোকটা কোথায় হারিয়ে গেছে! তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, মায়ের ভুল খবর দেওয়ার কথা। </p> <p>তিনি জানালেন, আরেকজন আয়ুব সেদিন মারা গেছিল। তাই হয়তো মায়ের এই ভুল। আমি ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি নিলাম তাঁর। তিনি তর্জনি উঁচিয়ে এক গহীন বাঁশবাগানের কোণে একটা পর্নোকুটির দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার বাড়ি।’ আয়ুব ভাই এ পাড়ায় চলে এসেছেন, এ খবর জানতাম না। তাই অবাক হলাম। তিনি বললেন, ‘এখন আমি বিজিবি ক্যাম্পের জওয়ানদের ভাত রাঁধি। এতে চলে যায় ভালোই।’<br /> ভালোই! এই ‘ভালো’তে দৈনতার হাহাকার মিশে আছে, বুঝতে কষ্ট হয় না আমার। </p> <p>আয়ুব ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে সামনে এগোয়। যত অসুস্থই হোক লোকটা বেঁচে আছেন, এতে আমার শান্তি। পনোরো বছর পর তাঁর সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে, তাও আবার তাঁর মরা খবর শোনার পর, তা-ই বা কবে ভেবেছিলাম!</p> <p>মাস তিনেক পর আবার বাড়ি গেলাম। সেই একই পথে আবার চলেছি ইছামতীর দিকে। সেই তেমাথা, সেই ঝুরি ছড়ানো বটগাছ—ভাবলাম আবার বুঝি দেখা হবে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু হলো না। আরেকটু এগিয়ে সেই বাঁশবাগান। কিন্তু সেটা ধুধু করছে। </p> <p>কোথায় সেই পর্নোকুটির? </p> <p>উঁচু মাটির একটা স্তূই সাক্ষী দিচ্ছে, কিছুদিন আগেও এখানে একটা কুটির ছিল। কাকে যেন জিজ্ঞেস করলাম আয়ুব ভাইয়ের কথা। সে জানালো, ‘আয়ুব! সে তো মাস দুয়েক আগে মারা গেছে!’</p> <p>বুকটা ভারী হয়ে উঠল। সেই ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম। সেই বর্ষা দুপুর, সেই দাদুবাড়ি, সেই আড্ডাখানা, সেই গল্পবাজ লোক, তাঁর হাতে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছে রুপালি লাইটার।</p> <p><br />  </p>