<p>আধুনিক সিরিয়ার বুসরা নগরীর যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে। সিরিয়ার দক্ষিণে জর্দান সীমান্তে প্রাচীন এই নগরীর অবস্থান। বুসরা নগরীকে বলা হয় ইসলামী, রোমান ও বাইজান্টাইন সভ্যতার সম্মিলন কেন্দ্র ও ধারক। ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো বুসরাকে বিশ্বঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। আরব বসন্তের প্রভাবে ২০১১ সালে সিরিয়া গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বুসরা নগরীর বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়।</p> <p>মিসরের ১৪ শ বছরের প্রাচীন নথিতে প্রাচীন এই শহরের নাম পাওয়া গেছে। প্রাচীনকালে শহরটি নাবাতিয়ান রাজ্যের রাজধানী এবং ট্রাজান সাম্রাজ্যের সময় রোমান সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশের রাজধানী ছিল। একইভাবে এটা ছিল সিরিয়ার প্রথম মুসলিম শহর। সিরিয়া থেকে মক্কায় গমনকারী হজ কাফেলার একত্র হওয়ার এবং যাত্রাবিরতির শেষ স্থান।<br /> বুসরা নগরীতে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বহু নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় মোবারক আন-নাকরা মসজিদ।</p> <p>ধারণা করা হয়, সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যাওয়ার সময় এখানেই মহানবী (সা.)-এর উট হাঁটু গেড়ে বসেছিল। নবীজি (সা.)-এর স্মৃতিধন্য স্থানটিকে বরকতময় মনে করে দর্শনার্থীরা প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আগমন করে। ১১৩৬ খ্রিস্টাব্দে মোবারক আন-নাকরা মসজিদ নির্মিত হয়। উটের হাঁটু গেড়ে বসার স্থানটি মসজিদের মেহরাবের সামনে অবস্থিত। একটি পাথরখণ্ডের ওপরের ছাপকে উটের হাঁটুর ছাপ বলে দাবি করা হয়। এক মসজিদে স্থাপিত শিলালিপিতে কুফিক বর্ণে লেখা আছে ‘নবীর মসজিদ’।</p> <p>বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনিতেও এই নগরীর বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বুসরার সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক যোগাযোগের বিষয়টিও বিশ্লেষণ করেছেন। বুসরা নগরীতে বিরকেত আল হজ নামে একটি বৃহৎ জলাধার রয়েছে। ১৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ১২০ মিটার প্রস্থ জলাধারটি হাজিদের পানি সরবরাহের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। হাজিরা দীর্ঘ মরুপথে যাত্রা শুরু করার আগে জলাধার থেকে নিজেদের জন্য ও কাফেলার পশুগুলোর জন্য পানি নিয়ে যেত। এ ছাড়া অন্যান্য মরুযাত্রী, মরুভূমির পশু-পাখিও এখানে পানি পান করত।</p> <p>বুসরা নগরীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম স্থাপত্য আল ওমরি মসজিদ। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। সিরিয়া জয় করার পর খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর নির্দেশে ওমরি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। উমাইয়া খলিফারা মসজিদের পাকা ভবন স্থাপন করেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদ মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করেন। দামেস্ক ও আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় মসজিদের মতো ওমরি মসজিদকে উমাইয়া স্থাপত্যরীতির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন মনে করা হয়। উমাইয়া রীতিতে মসজিদের মিনারটি বর্গাকার আকৃতিতে তৈরি করা হয়। খ্রিস্টীয় ১২ ও ১৩ শতকে আইয়ুবীয় শাসকরা ওমরি মসজিদের আধুনিকায়ন ও সংস্কার করেন।</p> <p>প্রাচীনকালে মসজিদের প্রাঙ্গণটি খোলাবাজার, পথিক ও মুসাফিরদের বিশ্রামকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিশেষত আরব উপদ্বীপের বাণিজ্য কাফেলা ও হজ মৌসুমে মক্কায় গমনকারী কাফেলা এখানে বিশ্রাম নিত। ইবনে বতুতা ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক থেকে মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে বুসরাতে তাদের কাফেলা যাত্রাবিরতি দেয়। তিনি সে ভ্রমণের বিবরণে লেখেন, ‘আমরা দামেস্ক থেকে বুসরায় এলাম। এটা খুব ছোট একটি শহর। হজ কাফেলার এখানে চার রাত বিরতি দেওয়ার রীতি আছে।’</p> <p>এ ছাড়া বুসরায় রয়েছে বিখ্যাত রোমান থিয়েটার, যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মাণ করা হয়। ঐতিহাসিক এই থিয়েটারে ৯ হাজার থেকে ১৫ হাজার লোক সমবেত হতে পারত। ১১ শতকে থিয়েটারটিকে দুর্গে পরিণত করা হয়।</p> <p><em>তথ্যঋণ : স্কয়ার কুফিক ডটকম ও উইকিপিডিয়া</em></p>