<p>‘কাওয়ালি’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি ‘কাওল’ বা ‘কাওলুন’ থেকে, যার অর্থ বাক্য। এর বহুবচন হলো ‘কাওয়ালি’, অর্থাৎ কথামালা বা বাক্যমালা। উপমহাদেশে একটি ধারার আধ্যাত্মিক সংগীতকে কাওয়ালি বলা হয়। আমির খসরু মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ছিলেন।</p> <p>মূলত নিজামুদ্দিন আওলিয়া ও আমির খসরু উভয়ের সঙ্গে উভয়ের আধ্যাত্মিক হৃদ্যতা গভীর ছিল। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে নিজামুদ্দিন আওলিয়া যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন থেকে আমির খসরু তাঁর কবরে গিয়ে বিলাপ শুরু করেন। এভাবে টানা ছয় মাস কবরে বিলাপ করতে করতে অবশেষে আমির খসরুও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অসিয়ত অনুসারে, গুরু-শিষ্য বর্তমানে একই স্থানে শায়িত আছেন।</p> <p>‘কাওয়ালি’ এমন এক ধরনের সংগীতের নাম, উপমহাদেশের অনেক সুফি-সাধক, ওলি-আউলিয়ার ব্যাপারে দাবি করা হয় যে তাঁদের সামনে এই সংগীত পরিবেশিত হয়েছে। অথচ ইসলাম গান-বাজনা ও অহেতুক কাব্যচর্চায় নিরুৎসাহ করেছে।  পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কিছু মানুষ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে অজ্ঞতাবশত অবান্তর কথাবার্তা (গান-বাজনা) ক্রয় করে আর আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। ওদের জন্যই আছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ৬)</p> <p>উপরোক্ত আয়াতে উল্লিখিত ‘লাহওয়াল হাদিস’-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে এই শব্দ দ্বারা ‘সংগীত’-এর কথা বলা হয়েছে। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, এটি তবলা। (তাফসিরে তাবারি)</p> <p>হাসান বসরি (রহ.) বলেন, এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে গান-বাজনার ব্যাপারে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)</p> <p>ইবনে কাইয়্যেম (রহ.) তাঁর ‘ইগাসাতুল লাহফান’ গ্রন্থে বলেন, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িদের মধ্যে যাঁরা ‘লাহওয়াল হাদিস’-এর ব্যাখ্যা ‘সংগীত’ করেছেন, তাঁরা যথার্থ ব্যাখা করেছেন।</p> <p>প্রশ্ন হলো, ‘কাওয়ালি’ কি জায়েজ? এর জবাব হলো, যদি কবিতা, সংগীত ইত্যাদির মধ্যে ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে এমন সংগীত বা কবিতা শোনায় ইসলামের বাধা নেই। তবে যদি (বর্তমান যুগের সংগীতগুলোর মতো) ইসলামী ভাবধারা ও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা হয়, তাহলে অবশ্যই তা হারাম। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩৪৯)</p> <p>পবিত্র হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সংগীত অন্তরে কপটতা সৃষ্টি করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯২৭)</p> <p>আবু মালিক আল-আশআরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের কতক লোক মদের ভিন্নতর নামকরণের মাধ্যমে তা পান করবে। (তাদের পাপাসক্ত অবস্থায়) তাদের সামনে বাদ্য-বাজনা চলবে এবং গায়িকা নারীরা গীত পরিবেশন করবে। আল্লাহ তাআলা তাদের মাটির নিচে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কতককে বানর ও শূকরে রূপান্তর করবেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০২০)</p> <p>প্রচলিত কাওয়ালির ব্যাপারে ‘ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া’র (পুরনো সংস্করণ : ১৭/৪৫৪) বরাত দিয়ে ‘ফাতাওয়ায়ে কাসেমিয়া’য় বলা হয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন কাওয়ালি অনুষ্ঠানে যে কাওয়ালি গাওয়া হয়, সেগুলো নাজায়েজের পর্যায়ের। এগুলো আর সিনেমার গানের বিধান একই। দুটিই নাজায়েজ ও গুনাহর কাজ। [ফাতাওয়ায়ে কাসেমিয়া, মাকতাবায়ে জিবরিল] : ২৪/৪৯৩]</p> <p>নবী (সা.) ও সাহাবিদের যুগে কোরআন-হাদিসের নিয়ম মেনে ইসলামী সংগীতের চর্চা ছিল। এমন ইতিহাস সামনে থাকার পরও সংগীত সম্পর্কে ইসলামী ফিকাহবিদদের এমন কঠিন মাসআলা দেওয়ার কারণ হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংগীত জায়েজ হওয়ার শর্তগুলো পালন করা হয় না। </p> <p>‘ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন’-এ ইমাম গাজালি (রহ.) সংগীত জায়েজ হওয়ার পাঁচটি শর্ত উল্লেখ করেছেন, যেগুলো সংগীতকে হারাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন—</p> <p>১. গায়কের কারণে, যথা—গানের গায়ক যদি এমন কোনো নারী হয়, যাকে দেখা বৈধ নয়, তাকে দেখে গান শুনতে গেলে ফিতনার ভয় থাকে। এমতাবস্থায় গান শোনা হারাম। আর এ হারাম গানের কারণে নয়, বরং গায়িকার প্রতি আশক্তির কারণে ও ফিতনা সৃষ্টির কারণে।</p> <p>এ ক্ষেত্রে ইমাম গাজালি শুধু তখনই গান শোনা হারাম বলে মন্তব্য করেন, যখন ফিতনার ভয় দেখা দেয়। আর তিনি তাঁর এ অভিমত ব্যক্ত করেন আয়শা (রা.)-এর বাড়িতে দুই শিশু গায়িকার গান গাওয়ার ভিত্তিতে। কারণ তা থেকে জানা যায় যে শিশু গায়িকাদের গান রাসুল (সা.) শুনছিলেন, তা পরিহার করেননি। কিন্তু এ শোনায় তাঁর ফিতনায় পড়ার কোনো ভয় বা আশঙ্কা ছিল না। এ কারণেই তিনি তাদের গানের শব্দ পরিহার করেননি। সুতরাং এ থেকে বোঝা গেল যে ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা গায়ক-গায়িকা ও শ্রোতা নারী-পুরুষদের অবস্থান তথা তার যুবক-যুবতী হওয়ার ওপর নির্ভর করে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হুকুম ব্যতিক্রম হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ আমরা তো বলে থাকি যে বৃদ্ধ লোক রোজা রেখে তার স্ত্রীকে চুমু দিতে পারবে, কিন্তু যুবকরা পারবে না।</p> <p>২. আর একটি বাহ্যিক বিষয় হতে পারে বাদ্যযন্ত্রে। যেমন—বাদ্যযন্ত্রটি হতে পারে মাতাল মদখোর ও নপুংসকদের বিশেষ পরিচয়বাহক। আর তা হচ্ছে বাঁশি, গিটার এবং পান পাত্রের ঢোল ইত্যাদি।</p> <p>৩. আর একটি বাহ্যিক বিষয় হতে পারে গানের বিষয়বস্তু বা বক্তব্য। যদি তাতে অশ্লীলতা, পরনিন্দা বা আল্লাহ-রাসুলের প্রতি মিথ্যারোপ কিংবা সাহাবাদের প্রতি মিথ্যারোপ জাতীয় কিছু থাকে। যেমন—রাফেজিরা সাহাবাদের নিন্দা করে গান লিখেছে। এজাতীয় গান শোনা হারাম। তা সুর দিয়ে হোক বা সুর ছাড়াই হোক। এজাতীয় গানের শ্রোতারাও লেখক ও গায়কের সঙ্গে শামিল। তেমনি যে গানে কোনো বিশেষ নারীর বিবরণ আছে, সে গানও শোনা হারাম। কারণ কোনো বিশেষ নারীর বিবরণ দান পরপুরুষের সামনে বৈধ নয়। তবে নারীর অবয়ব গড়ন, গণ্ডদেশ ইত্যাদির বিষয় দিয়ে কাব্য রচনা অবৈধ নয়। সত্য কথা হলো, এ ধরনের কাব্য রচনা ও তা সুরসহ বা সুর ছাড়া গাওয়া অবৈধ নয়। তবে শ্রোতার অবশ্যই তা বিশেষ কোনো নারীর ওপর আরোপ করা চলবে না। আর যদি একান্তই কোনো নারীর ওপর আরোপ করতে চায়, তাহলে তা অবশ্যই এমন নারীর ওপর আরোপ করতে হবে, যার ওপর আরোপ করা তার জন্য বৈধ। আর যদি তা কোনো পরনারীর ওপর আরোপ করে, তবে সে এ কারণে গুনাহগার হবে। আর যার অবস্থা এরূপ তাকে অবশ্যই গান শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।</p> <p>৪. আর একটি বাহ্যিক বিষয় হতে পারে গান উপভোগকারীতে। আর তা হতে পারে যদি তার যৌন কামনা তীব্র হয় এবং সে পূর্ণ যৌবনে অবস্থান করে। অন্যদের চেয়ে তার মধ্যে এ ধরনের উত্তেজনা যদি তীব্রতর হয়, তাহলে তার জন্য গান শোনা হারাম। এর দ্বারা তার হৃদয় কোনো বিশেষ লোকের প্রেমে জড়িয়ে পড়ুক বা না পড়ুক। যা-ই হোক না কেন, যদি তার অবস্থা এমন হয় যে যখন সে কারো জুলফি ও গণ্ডদেশের বিবরণ শোনে, মিলন ও বিরহের কথা শোনে, তাতেই তার উত্তেজনা তীব্রতর হয়, তখন যেকোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর তা আরোপ করে এবং শয়তান এসব বিষয় নিয়ে তার হৃদয়কে আলোড়িত করতে থাকে। ফলে তার উত্তেজনা ও কামনা বৃদ্ধি পায় আর মন্দের উদ্রেক দীর্ঘায়িত হতে থাকে (তাহলে তার জন্য এ ধরনের গান শোনা হারাম)।</p> <p>৫. শ্রোতা যদি সাধারণ মানুষ হয়, যার অন্তরে আল্লাহর প্রেম বাসা বাঁধেনি। ফলে গানেই তার অন্তরকে আবিষ্ট করে নিয়েছে। এমতাবস্থায় গান তার অন্তরে উত্তেজনা সৃষ্টি না করলেও তার জন্য গান শোনা নিষিদ্ধ হবে। তবে তা তার জন্য অন্য বৈধ জিনিসের মতো বৈধ হতে পারে—যদি তা শোনা তার অভ্যাস ও স্বভাবে পরিণত না হয়। সব সময় তা নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে পড়ে। কারণ এ ধরনের ব্যক্তিদের শরিয়তের ভাষায় নির্বোধ বলা হয়, যাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ খেল-তামাশায় ব্যস্ত থাকা একটা অপরাধ। সগিরা গুনাহ বারবার করতে থাকলে তা যেমন কবিরা গুনাহে পরিণত হয়, তেমনি কোনো কোনো বৈধ কাজে লেগে থাকার কারণে তা সগিরা গুনাহে পরিণত হয়। এ ধরনের একটা কাজ হলো দাবা খেলা। এ খেলা একটা মুবাহ বা বৈধ খেলা। তবে সর্বদা এ খেলায় ব্যস্ত থাকা একটা বড় মাকরুহ কাজ। সব বৈধ কাজই বেশি ও অতিরিক্ত করা বৈধ নয়, বরং রুটিও একটা বৈধ খাবার। এ খাবারও অতিরিক্ত খাওয়া অন্যান্য বৈধ জিনিসের মতো হারাম।</p> <p>অতএব কোনো সংগীতকে ইসলামী সংগীত ও নবী (সা.), সাহাবায়ে কিরাম ও আউলিয়ায়ে কিরামের সামনে পরিবেশিত ইসলামী সংগীতের সঙ্গে তুলনা করতে হলে অবশ্যই তাতে ইসলামের শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা সতর্কভাবে যাচাই করা উচিত। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথের দিশা দিন। আমিন।</p> <p> </p>