<p>প্রতিবছরের শেষ দিন এলেই মানুষ নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে কত আয়োজনই না করে। কিন্তু যে বছরটিকে আমরা ‘নতুন’ বলছি, সে বছরটি কি আসলেই নতুন? কিংবা যে বছরটি আমাদের জীবন থেকে চলে গেল, তা কি আসলেই পুরনো? এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, সময়ের পাতায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত্ বলে কোনো কিছু নেই! আমরা সময়কে যে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যত্ হিসেবে দেখি তা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের বিভ্রম বা ইলিউশন! বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভাষায় :</p> <p>‘The distinction between the past, present and future is only a stubbornly persistent illusion.’ তাহলে সময় আসলে কী? বিজ্ঞান এ প্রশ্নের উত্তর এককথায় আজও দিতে পারেনি। কিন্তু মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ । (সুরা : হা-মিম আস্সাজদা, আয়াত : ৩৭)</p> <p>সময়ের পরিমাপ করার জন্য আমাদের সাহায্য করে থাকে দিন-রাত, সূর্য-চন্দ্র ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমেই আমরা দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের গণনা করে থাকি। মহান আল্লাহ এগুলোর মাধ্যমেই আমাদের সময়ের বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দেন। ইরশাদ হয়েছে, তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় এবং চাঁদকে আলোকময় আর তার জন্য নির্ধারণ করেছেন বিভিন্ন মনজিল, যাতে তোমরা জানতে পারো বছরের গণনা এবং (সময়ের) হিসাব। আল্লাহ এগুলো অবশ্যই যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি আয়াতগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)</p> <p>উল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা বোঝা যায়, সময় হলো মূলত আল্লাহর নিদর্শন। এর বৈচিত্র্য রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রবিশেষে এর ধরনও পাল্টে যায়। যেমন আমাদের সৌরজগতে সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণকারী পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহের কথাই ধরা যাক। দুটিই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে । কিন্তু দুটি গ্রহের সময় সমান নয়। পৃথিবী থেকে এক হাজার ৩০০ গুণ বড় এই গ্রহের এক দিন পৃথিবীর সময় অনুযায়ী মাত্র ১০ ঘণ্টা। বোঝা গেল, ক্ষেত্রবিশেষে একই সময় কারো জন্য বড় ও কারো জন্য ছোট হতে পারে। এটিই মহান আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন।</p> <p>‘দ্য ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ বইয়ের পর্যালোচনায় আছে, মহাবিশ্বের যদি শুরু থাকে, তাহলে কালেরও শুরু থাকবে। মহাবিশ্বের শুরু যখন থেকে, কালের শুরু তখন থেকে। তা সত্ত্বেও শুরুর পূর্বে কালের বোধ মানসপটে ভেসে ওঠে। শুরুর পূর্বে কাল কী অবস্থায় ছিল? ধর্ম মতে, স্রষ্টাই সেখানে কালের জ্ঞাপক। স্রষ্টা চিরন্তন, ফলে কালও চিরন্তন। স্রষ্টার সৃষ্টির পরের কাল এবং সৃষ্টির আগের কালের বিবরণ দিতে পারি না। প্রশ্ন জাগে, আগের অসীম কালে স্রষ্টা কী করছিলেন? এমন সব চিন্তায় অ্যারিস্টটল ও নিউটন চিরন্তন, স্থির বিশ্বে বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্ব চিরকাল এমন বিরাজ করছিল। ফলে স্রষ্টার সহগামী বিশ্ব তথা কাল চিরন্তন, শাশ্বত, স্থির। পরম সত্তায় স্থান ও কাল পরম  (Absolute)|</p> <p>নিউটন এখানে স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি ‘সময়’ দিয়ে বিচার করতে গিয়ে অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। স্রষ্টা যেহেতু সময়ের নিয়ন্ত্রক, তাই স্রষ্টাই চিরন্তন হতে পারেন। কিন্তু সৃষ্টি কখনো চিরন্তন হতে পারে না।</p> <p>আইনস্টাইনের মতে, সময় চিরন্তন নয় বরং আপেক্ষিক। গাণিতিক তত্ত্বের  (Special theory of relativity) মাধ্যমে তিনি দেখান যে সময় মূলত আপেক্ষিক, এবং সময় বা কাল স্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।</p> <p>আইনস্টাইনের মতে, সময়ের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয় ও এটি স্থানভেদে সর্বদা পরিবর্তনশীল। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মহাশূন্যের যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আধিক্য বেশি, সময় সেখানে তত ধীরগতিতে প্রবাহিত হয়। একটি পারমাণবিক ঘড়িকে বিভিন্ন উচ্চতায় স্থাপন করে দেখা যায়, তাদের মধ্যে সামান্য হলেও সময়ের তারতম্য রয়েছে। সময়ের এই পার্থক্যকে গ্রাভিটেশনাল টাইম ডাইলেশন  (Gravitational Time Dilation) বলা হয়। তিনি আরো বলেন, যেকোনো শূন্য মাধ্যমে গতি ও সময়ের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক আছে, যেটা আমরা সচরাচর উপলব্ধি করতে পারি না। তার মানে, আমাদের কাছে সময়ের উপলব্ধি গতি, দিক ও মাধ্যমভেদে ভিন্ন হতে পারে।</p> <p>মানে আমাদের এক ঘণ্টা সময় ইউনিভার্সের সবার জন্য এক ঘণ্টা নাও হতে পারে।</p> <p>পবিত্র কোরআনেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন এবং এ পরিচালনার বৃত্তান্ত ওপরে তার কাছে যায় এমন এক দিনে, যার পরিমাপ তোমাদের গণনায় এক হাজার বছর। (সুরা : সাজদা, আয়াত : ৫)</p> <p>অর্থাত্ তোমাদের কাছে যেটা এক হাজার বছরের ইতিহাস, আল্লাহর কাছে যেন সেটা মাত্র এক দিনের কাজ। এর দ্বারা বোঝা যায়, সময় গতি, দিক ও মাধ্যমভেদে ভিন্ন হতে পারে।</p> <p>এরপর হজরত উজাইর (আ.)-এর ঘটনাও প্রমাণ করে যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জন্য সময় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, অথবা দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই ব্যক্তিকে দেখো যে এমন একটি লোকালয় অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। সে বলল, এ তো ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতি, একে আল্লাহ আবার কিভাবে জীবিত করবেন? এ কথায় আল্লাহ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে ১০০ বছর পর্যন্ত মৃত পড়ে রইল। তারপর আল্লাহ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন—বলো, তুমি কত বছর পড়ে ছিলে? জবাব দিল, এই এক দিন বা কয়েক ঘণ্টা পড়ে ছিলাম। আল্লাহ বললেন, ‘বরং ১০০টি বছর এ অবস্থায় তোমার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের ওপর একবার নজর বোলাও, দেখো তার মধ্যে কোনো ধরনের সামান্য পরিবর্তনও আসেনি। অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো (তার পাঁজরগুলোও পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে)। আর এটা আমি এ জন্য করেছি যে মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করাতে চাই। তারপর দেখো, এই অস্থিপাঁজরটি কিভাবে একে উঠিয়ে এর গায়ে গোশত ও চামড়া লাগিয়ে দিই।’ এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল তখন সে বলে উঠল, ‘আমি জানি, আল্লাহ সব কিছুর ওপর শক্তিশালী।</p>