<p>স্বদেশপ্রেম বা স্বদেশ চেতনা ইমানের অঙ্গ। এটি বহুল আলোচিত প্রবাদপ্রতিম মধুর প্রবচন। এতে নিহিত রয়েছে পরিশ্রুত ভাবাবেগ, বৃহত্তর কল্যাণবোধ, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সংকল্প। নিজ দেশ, নিজ মাতৃভূমি, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, সংবিধান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার নামই দেশপ্রেম। এ বোধ, আবেগ ও চেতনা যাদের আছে তারা দেশপ্রেমিকের বিশেষণে বিশেষায়িত। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের মানুষ, সম্পদ ও প্রকৃতির সেবা, লালন ও উত্কর্ষ সাধন হয়ে পড়ে দেশপ্রেমিকের জীবনব্রত।</p> <p>ইসলামে দেশপ্রেমের পরিধি ব্যাপক। ইসলামে দেশপ্রেমের ভিত্তি হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা (আল হুব্বু ফিল্লাহ), আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালোবাসা ও সেবা (খিদমাতু খালক) এবং মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) অনুসরণ ও মুক্তির প্রত্যাশা। নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের পাশাপাশি অন্য দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সদাচার, সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে। সৃষ্টির প্রথম দিবস থেকে যেসব নবী ও রাসুল (সা.) মানবজাতির হেদায়েতের জন্য দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হন, তাঁরা প্রত্যেকে আপন দেশ, মাতৃভূমি ও জনগোষ্ঠীকে ভালোবেসেছেন। কোনো নবী-রাসুল পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষকে পরিত্যাগ করে বনবাদাড়ে, গিরিকন্দরে বা মরুপ্রান্তরে ধ্যানমগ্ন সাধনায় মাসের পর মাস তন্ময় ছিলেন, এমন ইতিহাস নেই। দ্বীন প্রচার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণ সাধন ও অশুভ শক্তির দমন ছিল তাঁদের নবুওয়তির মিশন। স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশচেতনা হচ্ছে সুন্নাতে আম্বিয়া (আ.)।</p> <p>মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন। নবুওয়ত-পরবর্তী প্রথম পর্যায়ে ১৩ বছর তিনি অত্যন্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যে মক্কায় ধর্মপ্রচারে ব্রতী ছিলেন। নিবর্তন ও সংঘাতের তাণ্ডব যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে দাওয়াতের আরেক দিগন্ত উন্মোচনের উদ্দেশ্যে হিজরত করে মদিনা রওনা হন। মদিনা যাত্রাপথে তিনি জন্মভূমি মক্কার পানে তাকিয়ে অশ্রুপাত করেন বারবার। তিনি মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার শহর কতই না সুন্দর, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার জনগণ যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না (জামে তিরমিজি : ৩৯৫২)। ৬২২ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মদিনা হয়ে উঠে মহানবী (সা.) কর্তৃক দ্বীনপ্রচার, দ্বীনের আরকান-আহকাম বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা, শান্তিচুক্তি সম্পাদন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণার কেন্দ্রস্থল। এ মদিনায় রচিত হয় তাঁর সমাধিস্থল ‘রাওজা আকদাস’। তিনি মদিনার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন। মক্কার পাশাপাশি মদিনার প্রতি ছিল তাঁর আজীবনের ভালোবাসা। তিনি বলেন, ‘আমি উহুদ পর্বতমালাকে ভালোবাসি আর উহুদও আমায় ভালোবাসে।’ (সহিহ বুখারি : ২৮৮৯) হিজরত করে মদিনা গেলেও মক্কার সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন মহানবী (সা.)। ফলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কা বিজয় সম্ভব হয়। বিজয়ের দিন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেওয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।</p> <p>দেশের রূপ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু ও প্রতিবেশ (ঊপড়ষড়মু) সুরক্ষায় একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অহেতুক গাছপালা কর্তন, জনগণের চলার পথে প্রবহমান পানিতে মলমূত্র ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘কিয়ামত হয়ে যাবে এটা যদি আগেভাগে অনুমান করতে পারো, তাহলে হাতে রক্ষিত গাছের চারা রোপণ করে দাও।’</p> <p>জাতীয় অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নফল ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব। ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’ নামক গ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লিখিত হয়েছে। এতে তিনি বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের  চেয়ে আরো একটি পুণ্যময় রাতের খবর তোমাদের দেব কি?’ সাহাবারা জবাব দেন, ‘বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ মহানবী (সা.) বললেল, ‘কোনো সৈনিক রাতে এমন কোনো কঠিন ভীতিপ্রদ চৌকিতে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে; যেকোনো মুহূর্তে শত্রুর উদ্ধত অস্ত্রের আঘাতে তার বক্ষ বিদীর্ণ হতে পারে এবং জীবনে আর স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ নাও আসতে পারে—সে রজনী লাইলাতুল কদরের চেয়েও বেশি বরকতপূর্ণ।’</p> <p>সবল রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্র দখল করে সম্পদ লুণ্ঠন ও আর্থ-রাজনৈতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা একটি পুরনো রেওয়াজ। বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তির উদ্ধত থাবা গুঁড়িয়ে দিতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হয়। এ দায়িত্ব ও ঔচিত্যবোধ থেকে মহানবী (সা.) মদিনা প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় প্রায় ২৭টি যুদ্ধে সশরীরে অংশ নেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এসব যুদ্ধ ‘গাজওয়া’ নামে খ্যাত।</p> <p>ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ব্যক্তিগত কল্যাণের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও সামষ্টিক কল্যাণ যখন নাগরিকের মনে ও কর্মে সক্রিয় হয়ে উঠে, তখন জ্বলে ওঠে দেশাত্মবোধের অনির্বাণ শিখা। ধর্ম, দেশ, জাতি যখন বহিঃশত্রুর আগ্রাসনের শিকার হয়, লুণ্ঠনের মহড়া চলে এবং জুলুমের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন গোটা জাতির সুপ্তিমগ্ন দেশপ্রেম জেগে ওঠে, তারা প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রাণ উত্সর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ধর্মপরায়ণতা জাতিকে ঐক্যের ডোরে আবদ্ধ করে। অন্যদিকে ধর্মান্ধতা বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে  বিভাজিত করে ফেলে। ধর্মপরায়ণ দেশপ্রেমিক আপন মাতৃভূমিকে ভালোবাসে, সমর্থন করে ও দেশ রক্ষায় জীবন বাজি রাখে। অন্যদিকে ধর্মান্ধ দেশপ্রেমিক নিজ ধর্মগোষ্ঠী, বর্ণ ও দলীয় রাজনীতির প্রতি থাকে পক্ষপাতপূর্ণ ও একপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। উদারতা ও ভালোবাসা থেকে নিষ্কলুষ দেশপ্রেম জন্ম নেয় আর ঘৃণা, ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি হীনমানসিকতা পোষণ থেকে তৈরি হয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা। নিজের লোক, নিজের দল ও নিজেদের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা আদেশ অন্ধভাবে সমর্থন উগ্র জাতীয়তার পরিচয়। দেশপ্রেমের নামে বর্ণবাদী ধারণা বিশ্বে অনেক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। উগ্র জাতীয়তা (আসাবিয়া) ইসলাম অনুমোদন করে না, এটা পাপ হিসেবে গণ্য। (সুনানে আবু দাউদ : ৫০৯৭) হিটলার ও মুসোলিনি এমন মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। দেশপ্রেমের নামে তাঁরা যথাক্রমে জার্মানি ও ইতালিকে অন্ধভাবে ভালোবাসতেন, অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ঘৃণা করতেন এবং গোটা বিশ্বকে পদানত করতে চাইতেন।</p> <p>দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা, রাষ্ট্রের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলা, রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উত্স ‘কর’ আদায়ে সচেষ্ট থাকা, নাগরিকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, নিজস্ব কৃষ্টি ও মূল্যবোধ চর্চা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও দুর্নীতির প্রতিবাদ। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক নাগরিকের অধিকারও ব্যাপক। নিজের নিরাপত্তা লাভ, ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা, মতামত প্রকাশ, ভোটাধিকার প্রয়োগ, ধর্মচর্চা, আইনের ক্ষেত্রে সমতা, বিচারপ্রাপ্তি ইত্যাদি অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭-৪৪ অনুচ্ছেদে মোট ১৮টি মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার পাওয়ার বিধান রয়েছে।</p> <p>আসুন, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা দেশপ্রেমের চেতনায় অক্ষুণ্ন রাখি। বিজয়কে সমুন্নত রাখি এবং নিজেদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ওমর গনি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম</p>