<p>কোভিড ১৯ এর টিকা নেয়ার পর সুবিদ হাসানের মধ্যে বিশেষ কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। স্কুলের কাজ শেষ করে টিকা দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন অন্যদিনের চেয়ে একটু আগেই। বিকেলের দিকে ইনজেকশনের স্থানে সামান্য ব্যাথা হলেও অন্য কোন উপসর্গ দেখা দেয়নি। রাতের দিকে প্রচণ্ড জ্বরে কাহিল হয়ে পড়লেন সুবিদ হাসান। কিন্তু সেটাও খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। সকালে স্কুলেও গেলেন। কিন্তু শরীরটা তখনও ম্যাজ ম্যাজ করছে। তাই ক্লাসে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বই বের করে পড়তে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। প্রিয় শিক্ষকের এরূপ আচরণে শিক্ষার্থীরা কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলো। সাবিনাই প্রথম স্যারের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইল। সুবিদ হাসান টিকা আর জ্বরের কথা বললেন। সাবিনার বন্ধু খাদিজা তাঁর বাবারও একই অবস্থার কথা জানালো। খাদিজার বাবা স্থানীয় বাজারের মুদি দোকানদার। টিকা দিতে যাওয়ার পর খাদিজার বাবার সাথে সুবিদ হাসানের দেখা হয়েছিল। এই সুযোগে মেয়ের পড়াশোনার খোঁজখবরও নিয়েছেন বাবা। সুরেশ ভেবে পাচ্ছিল না যে টিকা নিলে কেন জ্বর আসবে! টিকা তো দেয়াই হয়েছে যেন জ্বর না আসে, রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। অসুস্থ স্যারকেও জিজ্ঞাসা করতে খারাপ লাগছে। কিন্তু সুবিদ স্যারই ওদের মধ্যে জানার আগ্রহ এমনভাবে তৈরি করে দিয়েছেন যে উত্তরটা না জেনেও সুরেশ শান্তি পাচ্ছে না। মনটা কেমন উসখুস করছিল। হয়ত এর কোন উত্তর নেই, বা থাকলেও হয়ত স্যার জানেন না। স্যার অনেক জ্ঞানী মানুষ সে বিষয়ে ওদের মনে কোন সংশয় নেই। তারপরও এটা স্বীকার করতেই হবে যে স্যারও সবজান্তা নন। তাছাড়া এটা চিকিৎসাবিদ্যার একটা অংশ। স্যার না জানলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই বা স্যারকে দোষারোপ করারও কিছু নেই। তারপরও সুরেশের জিজ্ঞাসু মন আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলল। অন্তত একটা কথা ঠিক যে স্যার ওদেরকে শেখাতে পছন্দ করেন। </p> <p>সুবিদ স্যার সোজা হয়ে বসে কিছুটা আনমনে বললেন, 'শারীরবিদ্যা জানার একটা বড় সুবিধা কী জানিস?’</p> <p>'কী, স্যার?’- কয়েকজন পালটা প্রশ্ন করল।</p> <p>'শারীরবিদ্যা জানলে নিজের শরীরে কখন কী হচ্ছে, বা কীভাবে সেটা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারা যায়। আর একটা জিনিস যদি তুই ভালো জানিস, তবে তোর মধ্যে একটা পূর্ণতা কাজ করবে। মনে সাহস তৈরি হবে, যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবি। বাসার কারও কোন রোগ হলেও তুই সেটা তাঁদেরকে জানিয়ে বাহবাও নিতে পারবি। আসলে শুধু শারীরিবিদ্যা না, সকল জ্ঞানের ক্ষেত্রেই এটা কাজে লাগে। আমরা আমাদের দেহ নিয়েই ঘুরি, চলি-ফিরি, বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেহের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন বুঝতে পারি; কিন্তু কেন বা কীভাবে সেগুলো হচ্ছে তার কোন কারণ আমরা খুঁজে পাই না।'</p> <p>একটু থেমে আবার শুরু করলেন তিনি। 'টিকা জিনিসটা হচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো একটা ব্যবস্থা। মনে কর তোর শরীরে একটা কাঁটা ফুটছে। একটা সময় আমাদের দেশে সার্জারির ব্যাপার-স্যাপারগুলো এতোটা সহজলভ্য ছিল না। একটা কাঁটা শরীরে থেকে গেলে তা থেকে পরে ইনফেকশন হয়ে আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্য অন্য কোন কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে চামড়ার নিচে থেকে যাওয়া কাঁটা বের করা হতো। এখন যে কাঁটা দিয়ে তুই অন্য কাঁটাটি তুলতে যাচ্ছিস সেটা দিয়েও আহত হওয়ার একটা সম্ভাবনা পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে তুই যদি সেই কাঁটাটিকে একটু যুতসই করে তৈরি নিতে পারিস তবে হয়ত আহত হওয়ার সম্ভাবনাটিও আর থাকবে না। টিকাও ঠিক এভাবেই কাজ করে।'</p> <p>পুরো ক্লাসে হতাশার একটা ¯পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। সুবিদ হাসান সেটা বুঝতে পারলেন। একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, 'এত হতাশ হচ্ছিস কেন? আমি তোদেরকে আজ টিকার কাজকারবার সব জানাব। সাথে বোনাস হিসেবে এর পেছনের ইতিহাসও তোদেরকে বলব। তার আগে মফিজ ঘন্টীতে আওয়াজ না তুললেই হলো।'</p> <p>এতক্ষণ পর সকলকে কিছুটা শিথিল বলে মনে হলো। </p> <p>'সুরেশের প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। সুরেশ জিজ্ঞাসা করেছে, টিকা দেয়া হয় মানুষের উপকারের জন্য। সেই টিকাই আবার মানুষকে অসুস্থ করে কীভাবে?এর উত্তর পাওয়া যাবে, যদি তোরা জানিস যে টিকা কী দিয়ে তৈরি করা হয়। টিকা তৈরিই হয় ভাইরাস দিয়ে। কোন ভাইরাস দিয়ে? যে ভাইরাসকে ঠেকানোর জন্য টিকা তৈরি করা হচ্ছে, টিকাটা তৈরি হয় সেই ভাইরাস দিয়েই।'</p> <p>এবার পুরো ক্লাসে বিস্ময়ের পালা। সুবিদ হাসান দেখলেন ফাতেমার চোখ দুটোতে চরম বিস্ময় ফুটে উঠেছে। অন্যদের অবস্থাও একই রকম। সুবিদ হাসান বুঝলেন যে আমাদের শরীরে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভেবে ছেলেমেয়েগুলোর বিস্ময়ের সীমা নেই। অবশ্য বিস্মিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে ভাইরাস থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাচ্ছি, আমাদের দেহে কীনা আবার সেই ভাইরাসই ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কেমন কথা হলো! সুবিদ হাসান চিন্তা করলেন যে ওদেরকে আর বেশিক্ষণ অন্ধকারে রাখা ঠিক হবে না। তাই আবার বলতে শুরু করলেন।</p> <p>'আমরা যে ভাইরাসটা থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছি, সেই ভাইরাসটাকে যদি একটু যুতসই করা কাঁটার মতো করে ব্যবহার করি তবে একটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যেমন, ভাইরাস দিয়ে ভাইরাসকে আক্রমণ করার বিষয়টিও তেমন। তবে যে কাঁটা দিয়ে আমরা অন্য কাঁটাটিকে তুলেছিলাম সেই কাঁটাটিকে একটু যুতসই ও নিরাপদ করে তৈরি করতে বলেছিলাম। একই কথা টিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে ভাইরাসটিকে দিয়ে আমরা টিকা বানাব, সেই ভাইরাসটিকে প্রথমেই দুর্বল করে নিতে হবে যেন সেটা রোগ বাধাতে না পারে।'</p> <p>'সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু দুর্বল করা ভাইরাসটা দেহের ভেতরে গিয়ে কী এমন করে যে আমরা সেই ভাইরাস থেকে পরবর্তীতে নিরাপদ থাকি?’ প্রশ্ন করল ফাতেমা।</p> <p>'রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলে একটা কথা আছে। তোরা তোদের পাঠ্য বই থেকে হয়ত জেনে থাকবি।'</p> <p>'জ্বী স্যার। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে শক্তিশালী করতে হয় সে বিষয়ে পড়েছিলাম।' বললো আকাশ।</p> <p>'সেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ হচ্ছে রক্তকোষ। আমাদের দেহের রক্ত দেখতে লাল রঙের। এর জন্য একটা কোষ দায়ী। কেউ বলতে পারবি সেটা কোন কোষ?’</p> <p>উত্তরটা দিল আকাশই। 'স্যার, লোহিত রক্ত কণিকা। লোহিত মানে লাল। সেজন্য মনে আছে এটা।'</p> <p>হো হো করে হেসে উঠল পুরো ক্লাস। সুবিদ হাসানও মুচকি হেসে ওদের সাথে যোগ দিলেন। এরপর আবার নিজের কথায় ফিরে গেলেন।</p> <p>'রক্তের বিভিন্ন কোষের নানা রকম কাজ রয়েছে। যেমন- লোহিত রক্ত কণিকা আমাদের দেহের টিস্যুতে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। অণুচক্রিকা নামক এক ধরনের কোষ আছে, যার কাজ হচ্ছে রক্ত জমাট বাধা। আরেক ধরনের কোষ আছে, যাদের কাজ নিয়েই আমাদের এই আলোচনা। এরাই আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা দেখে। এদেরকে বলা হয় শ্বেত রক্তকণিকা। একটি রাষ্ট্রের জন্য যেরূপ পুলিশ, তেমনি আমাদের দেহের জন্য আছে শ্বেত রক্তকণিকা। অপরধাস্থলে যেমন পুলিশের আনাগোনা বেড়ে যায়, আমাদের দেহ বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে তেমনি শ্বেত রক্তকণিকারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে সমস্ত দেহজুড়ে। সে এক অস্থির অবস্থা। আমরা যদি সেই জগতে গিয়ে যুদ্ধের এই অবস্থা দেখতে পেতাম তবে নির্ঘাত ভয় পেতাম এতে কোন সন্দেহ নেই। শ্বেত রক্তকণিকা আবার বিভিন্ন ধরনের হয়। একেকটার একেক ধরনের কাজ। কেউ আর্মির রূপ ধারণ করে, কেউ হয় পুলিশ, কেউবা র‌্যাব। প্রত্যক্ষ আক্রমণের পাশাপাশি এরা এমন সব অণু তৈরি করে, যেগুলো শত্রুপক্ষের চেহারা মনে রাখতে ওস্তাদ। এরা জীবাণুর চেহারা মনে রেখে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। পরবর্তীতে যখনই সেই চেহারার জীবাণু দেহে ঢোকে তখনই শুরু হয় তাঁদের তীব্র আক্রমণ। এদেরকে আমি বলি বিশেষ ফোর্স, বইয়ের ভাষায় বলে "অ্যান্টিবডি"। জীবাণু ধ্বংসে এরা এতটাই সফল যে দেহে অ্যান্টিবডি বেশি করে তৈরি করার জন্যই মূলত আরও ভাইরাস দেহে ঢুকানো হয়। তবে ওই যে বললাম, ভাইরাসটাকে আগে দুর্বল বা রোগ প্রতিরোধে অক্ষম করে নেয়া হয়। একবার চিন্তা করে দেখ যে ভাইরাস না ঢোকালে সেই ভাইরাসের চেহারা মনে রাখার মতো অ্যান্টিবডিও তৈরি হবে না। আর অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে দেহ ভাইরাসের পরবর্তী আক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাহলে বিষয়টা কেমন মনে হচ্ছে তোদের কাছে?’</p> <p>'কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই।' কয়েকজন এক যোগে বলে উঠল।</p> <p>'হ্যা, বুঝতে পেরেছিস তাহলে। এবার আসি আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, বা খাদিজার বাবার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেই আলোচনায়। আমাদের দেহে একটু ভিন্ন উপায়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়েছে। আসলে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার জন্য আস্ত ভাইরাসই লাগবে এমন কোন কথা নেই। অ্যান্টিবডি যেহেতু এক প্রকারের রাসায়নিক উপাদান, সেহেতু এটি ভাইরাসের বিশেষ কোন রাসায়নিক উপাদানকে মনে রাখতে পারে। টিকার মাধ্যমে আমার দেহে অকেজো যে ভাইরাস উপাদানটি তৈরি করা হয়েছে সেই উপাদানের উপস্থিতিতে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ভাইরাসের উপাদান অকেজো হলে কী হবে, এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি আর তার অ্যাকশনের কারণে গায়ে জ্বর চলে আসছে। গায়ে জ্বর আসলে সব সময় মনে রাখবি যে দেহে কোন একটা জীবাণু ঢুকেছে। সেটা ভাইরাসও হতে পারে, আবার ব্যাকটেরিয়াও হতে পারে বা অন্য কোন জীবাণু। কিন্তু এই জ্বর আমার কোন ক্ষতি করবে না। টিকা প্রস্তুতকারী চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা টিকা তৈরিই করেছেন এমনভাবে যেন সেটা দেহে গিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সামান্য উত্তেজিত করলেও রোগ বাধাতে না পারে।'</p> <p>'এ তো চমৎকার এক বুদ্ধির কাজ। এইরকম একটা বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা প্রথম কার মাথা থেকে আসছে জানতে ইচ্ছে করছে। তার বদনখানাও একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।' বললো রাসেল। </p> <p>'চেহারা হয়ত তোদেরকে এখন দেখাতে পারব না, তবে টিকা আবিষ্কারের সেই বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীটা বলা যেতে পারে।' কথাটা বলেই হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে আবার শুরু করলেন সুবিদ হাসান।</p> <p>'টিকা আবিষ্কারের কাহিনী বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় জীবানুর কথা। জীবাণু কী জিনিস সে তো তোরা জানিসই- অতি ক্ষুদ্র জীব। কতটা ক্ষুদ্র? এতটাই ক্ষুদ্র যে এদেরকে খালি চোখে দেখাই যায় না; দেখতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। এই জীব যে আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করে সেটা জানা গেছে খুব বেশিদিন হয়নি। রোগ সৃষ্টির জন্য জীবাণুর একটা সম্ভাবনার কথা বলা হয় আঠার শতকে। তোদের মনে হতে পারে যে এটাও তো সেই কবেকার কথা, দুইশ বছরেরও বেশি সময় আগের। কিন্তু আমাদের মানব প্রজাতির বয়সের সাথে তুলনা করলে দুইশ বছর কিছুই না।'</p> <p>'তাহলে আমাদের প্রজাতির বয়স কত, স্যার?’</p> <p>'তা আনুমানিক দুই লক্ষ বছর তো হবেই।' ঠোঁটটা সামান্য বাঁকিয়ে বললেন সুবিদ হাসান। ক্লাসের সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। </p> <p>'১৮ শতকের আগে পর্যন্ত আধুনিক মানুষ মনে করত, আমাদের দেহের সংক্রামক রোগগুলো হয় বিষাক্ত গ্যাস আর দূষিত বাতাস থেকে। আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জের মুরুব্বীরা এখনও খারাপ বাতাস বলে কিছু একটার অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। ম্যালেরিয়ার নাম তো তোরা শুনেছিস বোধ হয়। সেই ম্যালেরিয়া নামটাও কিন্তু এসেছে এই দূষিত বাতাসের ধারণা থেকে। ইতালীয় ভাষায় ম্যালেরিয়া অর্থ হচ্ছে 'নষ্ট বাতাস'। তবে ঘটনার শুরু ম্যালেরিয়া দিয়ে না, কলেরা দিয়ে। কলেরার ভয়াবহতার কথা তোরা চাইলে তোদের দাদী-নানীর কাছ থেকে শুনতে পারিস। তবে তারাও যখন কলেরার ভয়াবহতা দেখেছে বিশ্বকর্তারা তখন কলেরা রোগটাকে মোটামুটি আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে এসেছে। কলেরার যে ঘটনার কথা এখন বলতে যাচ্ছি সেটা ঘটেছিল ১৮৫৪ সালে, লন্ডনে। ঘটনার কারণ কী হতে পারে সেটাই ভাবছিলেন জন স্নো নামক এক ভদ্রলোক। তিনি বুঝতে পারলেন যে রোগের উৎস সম্ভবত নগরীর খাবার পানি সরবরাহের মূল কেদ্রে থাকতে পারে। সন্দেহের কথাটা নগরীর শাসককে বলে তিনি সেই পানি সরবরাহ কেন্দ্র সাময়িক বন্ধ রাখার অনুরোধ করলেন। কেন্দ্রটি বন্ধ রাখার কয়েকদিনের মধ্যে রোগের প্রকোপও অনেকটা কমে আসতে শুরু করে। বিশ্ব থেকে কলেরা কীভাবে বিদায় নিয়েছিল সেটা অনুমান করে বলতে পারবি কেউ?’</p> <p>'টিকা?’ - উলটো প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে বলল সুরেশ। </p> <p>'হ্যা, ঠিক ধরেছিস। কলেরার টিকা আবিষ্কার হয়েছিল ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ লন্ডনের সেই ঘটনারও ৩০ বছর পর। কিন্তু জন স্নো কিন্তু টিকা আবিষ্কার করেননি, করেছিলেন এক ব্রিটিশ ডাক্তার; নাম এডওয়ার্ড জেনার। তোরা আবার মনে করিস না যেন এই জেনারই বুঝি কলেরার টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। জেনার আরেকটা মরনব্যধি 'বসন্তের' টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। এই বসন্ত রোগ এখনও আমাদের হয়, কিন্তু আমরা ভয় পাই না। আমাদের যে বসন্তটা হয় সেটাকে বলা হয় জল বসন্ত। যে বসন্তকে নির্মুল করা গেছে সেটাকে বলা হতো গুটিবসন্ত। এই বসন্তের ভয়াবহতার কথাও তোরা তোদের দাদী-নানীদের কাছ থেকে চাইলে শুনে নিতে পারিস। আমি নিজেও আমার মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি যে গুটি বসন্তে একটা সময় খোদ এই উপমহাদেশেই গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত।</p> <p>মানুষকে দাফন করার লোকও মিলত না ইত্যাদি। পরে অবশ্য টিকা আবিষ্কার করে এটাকে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিদায় করা সম্ভব হয়েছে। তারপরও আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে রোগটা বহুদিন পর্যন্ত ছিল। বিশ্বের শেষ ছোবলটাও ছিল এখানে, ১৯৭৪ সালে। জেনার অবশ্য গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন সতের শতকের শেষদিকে। এ সময় তিনি লক্ষ করেছিলেন যে গুটিবসন্ত গোয়ালিনীদের খুব একটা কাবু করতে পারে না। গোয়ালিনীদের এমন কী ক্ষমতা আছে সেটা জানার জন্য জেনার উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। গুটিবসন্তের মতো প্রায় একই ধরনের একটি বসন্ত গরুরও হয়। জেনার বুঝলেন যে গোয়ালিনীরা যখন গাভীর দুধ দোহন করে, তখন তো গাভীর দেহ থেকে বসন্ত গোয়ালিনীদের হাতে চলে যেতে পারে। তবে কি সেই বসন্তটাই ওদেরকে গুটিবসন্ত থেকে রক্ষা করছে। এর উত্তর পেতে জেনার একজন গোয়ালিনীর হাতের ক্ষত থেকে গোবসন্তের জীবাণু নিয়ে কখনই হয়নি এমন একটি ছেলের দেহে সেটা ঢুকিয়ে দিলেন। বিপদজনক পরীক্ষা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ওনারা যদি এরকম বিপদজনক পরীক্ষাগুলো না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন, তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ এ পর্যায়ে আসতে পারত না। যা হোক, ছেলেটা প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তোরা যদি একটু ভালোভাবে লক্ষ করে থাকিস তবে বুঝতে পারবি যে জেনারের সেই টিকাটা কিন্তু আমি তোদেরকে যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবেই কাজ করেছিল। গোবসন্ত গুটিবসন্তের তুলনায় কম শক্তিশালী। ফলে ছেলেটার শরীরে যখন রোগে দুর্বল বসন্ত ঢোকানো হয়েছিল তখন তার শরীরে এই রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ছেলেটির কোন ক্ষতি হয়নি।'</p> <p>'টিকাটা যে কাজ করেছিল সেটা জেনার পরে বুঝলেন কী করে? মানে বলতে চাচ্ছি যে ভবিষ্যতে যে ছেলেটার আর গুটিবসন্ত হয়নি সেটাই বা বলি কী করে?’ অমিতের জিজ্ঞাসা। সকলে বিস্ময়ের সাথে অমিতের দিকে তাকালো। অমিত লজ্জা পেল। </p> <p>'খুব ভালো একটা পয়েন্ট ধরেছিস তুই।' অমিতকে লক্ষ করে বললেন সুবিদ হাসান। 'অবশ্য তুই প্রশ্ন না করলেও এর উত্তরটা আমি বলতাম। এটা না বললে যে কাহিনীর কোন উপসংহারই হবে না।'</p> <p>'ছেলেটার দেহে গোবসন্তের জীবাণু ঢুকিয়ে দেয়ার দুই মাস পর জেনার আরও বিপদজনক এক কাজ করে বসলেন। তিনি ছেলেটার দেহে এবার ঢোকালেন সেই গুটিবসন্ত, যেটা মানুষের হয়। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন যে গুটিবসন্ত ছেলেটার কোনই ক্ষতি করতে পারল না। তিনি নিশ্চিত হলেন যে গোবসন্তের সেই টিকাটা ছেলেটার দেহে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে কিছু একটা তৈরি করেছে। জেনার অবশ্য তখন জানতেন না যে সেই কিছু একটাই হচ্ছে আজ আমাদের জানা সেই অ্যান্টিবডি।'<br /> হেডমাস্টারের রুমের সামনে রাখা ঘন্টীটা ঢং ঢং করে বেজে উঠলো, সঙ্কেত দিল ক্লাস শেষ হওয়ার। </p> <p>লেখক: চিকিৎসক ও বিজ্ঞান লেখক<br />  </p>