<p>১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আজকের এই দিনে উত্তর কলকাতার ২২ ঈশ্বর মিত্র লেন, গোয়া বাগান অঞ্চলে কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকসের জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম। তার পরিবারের আদি নিবাস চব্বিশ পরগণার বড়োজাগুলিয়া গ্রামে।</p> <p>সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নর্মাল স্কুলে, পরে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে তিনি হিন্দু স্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাশে ভর্তি হন। এখানেই ১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রান্স পরীক্ষা (বর্তমানে মাধ্যমিক) পরীক্ষা দেন, যার ফল প্রকাশ হয় ১৯০৯ সালে। তিনি মেধা তালিকায় পঞ্চম হয়ে সেই বছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন, যেখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ আর শিক্ষক হিসেবে পান জগদীশ চন্দ্র বসু, সারদা প্রসন্ন দাশ এবং আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে, যাঁরা ছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানের দিকপাল। </p> <p>১৯১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বোস মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে পাস করেন। মাধ্যমিকের ফলাফলের জন্য তিনি হরিশ্চন্দ্র পুরস্কার এবং গণিতে সেরা হওয়ার জন্য মন্মথনাথ ভট্টাচার্য স্বর্ণপদক পান।</p> <p>সেই বছরই প্রেসিডেন্সি কলেজেই স্নাতকোত্তর পড়া শুরু করেন। এই কলেজে তিনি সান্নিধ্যে আসেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতন বিখ্যাত অধ্যাপকদের। এখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা মেঘনাদ সাহাকে। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক এবং ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে একই ফলাফলে মিশ্র গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।</p> <p>ওই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তখন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক তখন সেখানে রিসার্চ স্কলার হিসেবে যোগ দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরে তিনি সেখানে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান এবং বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। </p> <p>১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যেন বোস ঢাকা বিভাগে ‘রিডার’ হিসেবে যোগ দেন। যেহেতু ইতিমধ্যে প্রভাষক হিসেবে বোসের ৪ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েই বোস মাস্টার্সের ছাত্রদের কোয়ান্টাম থিওরি পড়ানোর সুযোগ পান। </p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা শ্রেণিকক্ষে সেই বিষয় পড়াতে গিয়েই বন্ধু মেঘনাদ সাহার মাধ্যমে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ (Black body radiation), কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি এসব গবেষণা পত্রের খোঁজ পান। </p> <p>এরমধ্যেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কর্তৃপক্ষে মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বরাদ্দ কমে যায়। ১৯২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে বোসকে দেন, তার মেয়াদ আর বাড়ানো হচ্ছে না। এইরকম একটি খারাপ সময়ের মধ্যেই বোস বিজ্ঞানের যুগান্তকারী প্রবন্ধ লিখেছিলেন।</p> <p>আর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের চেয়ারম্যানের কক্ষে বসে সত্যেন বোস প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তা নীতি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্রতিপাদন করে চার পাতার একটি ছোট্ট গবেষণাপত্র রচনা করে ফেললেন, যার শিরোনাম দিলেন Planck's Law and the Hypothesis of Light Quanta।</p> <p><br /> সেটি লিখে পাঠিয়ে দিলেন তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানের খ্যাতনামা এক জার্নাল - ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিনে।। কিন্তু, জার্নালের সম্পাদক ও সম্পাদনা ডেস্কের লোকজন ভাবলেন, বোস হয়তো একেবারে গোড়ায় গলদ করে এই পেপারটা লিখেছেন, তাই তারা আর্টিকেল রিভিউর জন্য না পাঠিয়ে সরাসরি বাতিল করে দিলেন।</p> <p>সেই সময় বিখ্যাত ‘ফিলোসোফিক্যাল ম্যাগাজিন’-এ পাঠিয়েছিলেন লেখাটা। এই ম্যাগাজিনে সেটা প্রকাশিত হয়নি। পরে ভাবলেন লেখাটা আইনস্টাইনকে একবার পাঠানো দরকার। আইনস্টাইন ইতিমধ্যেই বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত পদার্থবিদ হয়ে গিয়েছেন। বোস ভাবলেন, বিশ্বের সেরা প্রতিভা আইনস্টাইন নিশ্চয়ই তার কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।</p> <p>১৯২৪ সালের ৪ জুন বোস যে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইনকে। এই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটিও সবার জানা উচিত, তাই চিঠির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো—</p> <p>Respected Sir,<br /> “I have ventured to send you the accompanying article for your perusal and opinion. I am anxious to know what you think of it. You will see that I have tried to deduce the coefficient 8π ν2/c3 in Planck's Law independent of classical electrodynamics, only assuming that the ultimate elementary region in the phase-space has the content h3. I do not know sufficient German to translate the paper. If you think the paper worth publication, I shall be grateful if you arrange for its publication in Zeitschrift für Physik. Though a complete stranger to you, I do not feel any hesitation in making such a request. Because we are all your pupils though profiting only by your teachings through your writings. I do not know whether you still remember that somebody from Calcutta asked your permission to translate your papers on Relativity in English. You acceded to the request. The book has since been published. I was the one who translated your paper on Generalised Relativity.”</p> <p>বোসের প্রবন্ধ পড়ে আইনস্টাইন কিন্তু ঠিকই বুঝে ফেললেন এই বাঙালি বিজ্ঞানীর কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেরি না করে তিনি বোসের প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠালেন তৎকালীন জার্মানের প্রখ্যাত জার্নাল ‘Zeitschrift für Physik’ এ। সাথে যোগ করে দিলেন একটি ছোট নোট যেখানে তিনি এই কাজের প্রশংসা করেন এবং লিখেন তিনি খুব শিগগির এটি তিনি অন্যত্র ব্যবহার করবেন।</p> <p>বোসের আবিষ্কৃত এবং পরে আইনস্টাইনের দ্বারা পরিবর্ধিত এই পরিসংখ্যান বিদ্যার নাম দেওয়া হলো বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স এবং তারও অনেক পরে আসে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট তত্ত্ব।</p> <p>এ স্বীকৃতির কারণেই সত্যেন ইউরোপে গবেষণার সুযোগ লাভ করেছিলেন। এ সময় তিনি লুই ডি ব্রগলি, মেরি ক্যুরি, এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে কাজ করার সুবর্ণ সুযোগ পান।</p> <p>১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ সফর শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পান। বসু ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন এবং দেশবিভাগ আসন্ন হলে তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে অবসর গ্রহণের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করে। এবং ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বভারতীতে উপাচার্য হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এবং পরবর্তীতে ভারত সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করেন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে।</p> <p>ব্যক্তিজীবনে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নিরলস, কর্মঠ ও মানবদরদী মনীষী। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত ও সাহিত্যেও ছিল তার আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ ভালোলাগা। রবীন্দ্রনাথ তাকে নিজের ‘বিশ্বপরিচয়’ বিজ্ঞানগ্রন্থ, ‘অন্নদাশঙ্কর রায়’ তার জাপানে ভ্রমণ রচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।<br /> অত্যন্ত মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু শুধু বিজ্ঞান চর্চাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি দেশব্রতীও ছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগও রাখতেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন বসু ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থ বিজ্ঞান শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।</p> <p>কলকাতায় সত্যেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাকে অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করে গেছেন। </p> <p>বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি। তার নেতৃত্বে কলকাতায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদের মুখপাত্র হিসাবে বাংলা ভাষার বিজ্ঞান পত্রিকা জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-এ কেবলমাত্র মৌলিক গবেষণা নিবন্ধ নিয়ে ‘রাজশেখর বসু সংখ্যা’ প্রকাশ করে তিনি দেখান, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের মৌলিক প্রবন্ধ রচনা সম্ভব।</p> <p>কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকসের জনক এ বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল পুরস্কার না পেলেও, বসু-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান, বসু-আইনস্টাইন কন্ডেনসেটের ওপর গবেষণা ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মার্টিনাস ভেল্টম্যান, জেরার্ডাস’ট হুফট, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে এরিক কর্নেল, কার্ল উইম্যান ও উলফগ্যাং ক্যাটারলি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বোসকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। সত্যেন বোস পাননি, তার কারণ বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট তত্ত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হওয়ার আগেই সত্যেন বোস মারা গিয়েছিলেন।</p> <p>১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলো হন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদে মনোনীত করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেশিকোত্তম এবং ভারত সরকার পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে সত্যেন বসু অধ্যাপক (Bose Professor) পদ রয়েছে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা শহরে তার নামে সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌলিক বিজ্ঞান কেন্দ্র নামক গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হয়।</p> <p>আজ এ মহান বাঙালি বিজ্ঞানীর জন্মদিন। </p> <p>শুভ জন্মদিন কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ।</p> <p>লেখক: শিক্ষার্থী, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ, ময়মনসিংহ</p> <p>সুত্র: </p> <p>১. "Satyendra Nath Bose – Bengali physicist"। Encyclopædia Britannica Online</p> <p>২. "S.N. Bose Biography Project"। জুলাই ২০১২।</p> <p>৩. Mehra, J. (১৯৭৫)। "Satyendra Nath Bose 1 January 1894 – 4 February 1974"। Biographical Memoirs of Fellows of the Royal Society।</p> <p>৪. Mahanti, Dr Subodh। "Satyendra Nath Bose, The Creator of Quantum Statistics"</p>
