<p>অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টাতে অর্থনীতির হালচাল নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করছেন। কী ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে—তা জানতে চেয়ে যেন তর সইছে না। অথচ ভুলে গেছেন যে একটা গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স মাত্র এক মাস কয়েক দিন। এত অল্প সময়ের হিসাব-নিকাশ নেওয়া অযৌক্তিক তো বটেই, রীতিমতো অসম্ভব একটা ব্যাপার। বিদেশে যেমনটি হয়, ন্যূনতম ১০০ দিন বা তিন মাস পার হলেও কথা ছিল; অর্থনীতি নিয়ে দুই-একটা কথা বলা হয়তো সম্ভব হতো। তার পরও তাঁরা নাছোড়বান্দা, পত্রিকায় লেখালেখি করি বলে কথা!</p> <p>অর্থশাস্ত্রের ঘরানায় লোকদের সুখবর এই যে, প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর—তাঁরা তিনজনই বাংলাদেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ তথা সমাজবিজ্ঞানী। সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন ‘ত্রিরত্নের’ উপস্থিতি আগে ছিল বলে মনে হয় না। অতএব অর্থনীতির স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম যদি না অর্থনীতির ওপর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ প্রকট আকার ধারণ করে।</p> <p>আপাতদৃষ্টে রাজনীতি সাইডলাইনে অবস্থান নিয়েছে, আর অর্থনীতি মূল মাঠে খেলছে। এ দৃশ্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নেহাতই দৈব একটা ঘটনা এবং অচিরেই যে রাজনীতি অর্থনীতির ওপর সওয়ার হবে, তার আলামতও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।</p> <p>২.</p> <p>সংকটসে কথা পরে হবে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ জনমনে সাড়া ফেলেছে। যেমন—কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস, বিভিন্ন উপায়ে অর্থ সাশ্রয়ের উদ্যোগ ইত্যাদি। তবে খুব দৃশ্যমান আর্থিক খাতে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো সম্ভবত একটু বিস্তারিত ব্যাখা দাবি করে।</p> <p>সবাই জানি যে গেল বছরগুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিমজ্জিত ছিল। সে সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। বিশেষত ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান ব্যাধিগুলো নিয়ে, এমনকি সরকার সমর্থক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরাও বারবার সাবধান করেছিলেন।</p> <p>সবার যুক্তি একই ছিল—অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বলে খ্যাত ব্যাংকিং খাতে চর দখল চলছে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সুশাসনের মাধ্যমে এর সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এক কান দিয়ে শোনা আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেওয়া যেখানে সরকারি ‘কঠোর’ অবস্থান হয়, সেখানে অর্থনীতিবিদদের উপদেশ ছিল উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর বৈ কিছু নয়।</p> <p>তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ব্যাংকিং খাত নিয়ে যত কেচ্ছাকাহিনি শুনছি এবং পড়ছি—তা রীতিমতো রোমহর্ষক বললে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ আছে যে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আর্থিক খাতের লুটপাটের মচ্ছবে মদদ দিয়েছিলেন। এমনি আরো অনেক কারণের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকিং খাতে প্রবল রাজনৈতিক এবং অলিগারকি প্রভাবের উপস্থিতি এবং সুশাসনের প্রকট অভাব বাংলাদেশের আর্থিক খাত খাদের কিনারে পতিত হয়, যখন আর্থিক খাত আইসিইউতে অক্সিজেন মাস্ক পরা মুমূর্ষু রোগীর মতো ছটফট করছিল।</p> <p>৩.</p> <p>অভিযোগ উঠেছে যে মাফিয়াদের একটা দুষ্টচক্র এই খাত থেকে দুই লাখ কোটি টাকা লোপাট করে। শুধু তাই নয়, বিদেশে নামে-বেনামে পাচার করেছে লুট করা অর্থের একটা বড় অংশ। অন্যদিকে ধারণা করা হয় যে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২-১৫ শতাংশ খেলাপি এবং সার্বিক বিবেচনায় ঋণ খেলাপের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে।</p> <p>ব্যক্তি খাতের ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে নিয়ম-কানুন শিথিল করে সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পুরো আর্থিক খাত মাত্র কয়েকটা পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ল।</p> <p>দুই. অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলাদা ব্যাংকিং ডিভিশন মারফত এই খাতে রাজনৈতিক নিয়োগের এবং সুপারিশের পথ প্রশস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংককে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়।</p> <p>তিন. অভিযোগ আছে বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর চাপে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া কিংবা সংকটে নিপতিত ব্যাংক বাঁচানোর কৌশল অবলম্বন করতেন সাবেক গভর্নর। এমন ছাপানো টাকার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা! অথচ মূল্যস্ফীতির সময় এই ছাপানো টাকা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার শামিল ছিল।</p> <p>চার. অর্থনীতিবিদদের জোর সুপারিশ সত্ত্বেও সুদের হার ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করে ‘ছয়-নয়’ এবং ‘নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার’ ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এবং অভ্যন্তরীণ অর্থ বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ ছাড়া সব শেষে এবং সম্ভবত সংগত কারণে, গেল কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণে যে কটা বড় দাগের কেলেঙ্কারি জন্ম নিয়েছে, তার পেছনের কুশীলবদের আইনের আওতায় আনার কিংবা এ সম্পর্কিত শ্বেতপত্র প্রকাশের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এই কুশীলবরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কিংবা ডিরেক্টর হয়ে দুষ্ট উদ্যোক্তাদের বিপুল ঋণ হাতিয়ে নিতে সাহায্য করেন।</p> <p>৪.</p> <p>তবে হতাশার মধ্যেও আশার আলো আছে যেমন, আছে মেঘের পর রোদ। আর্থিক খাতের সুস্থতা সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এরই মধ্যে বেশ প্রশংসনীয় এবং দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং নিতে চলেছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা সবার নজর কাড়ে। তিনি কতটুকু সফল হবেন সেই বিচার সময় করবে; কিন্তু তাঁর দৃঢ়চেতা, স্বাধীন এবং তপোনিষ্ঠ প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে অভিনন্দন।</p> <p>এরই মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটা বাণিজ্যিক ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ পর্ষদ বিলুপ্ত করে পুনর্গঠন করেছে; কিছু করণীয় নির্ধারণ করেছে কড়া ভাষায়। বন্দুকের নলের মাথায় ছিনতাই করা ব্যাংক যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সুসংবাদ যে, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে; আশা করা যায় চলমান সুদের হার বৃদ্ধি চাহিদা সংকোচনে অবদান রেখে মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করবে।</p> <p>অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথাও বলেছেন গভর্নর এবং আমরা আশা করব অচিরেই তা আলোর মুখ দেখবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না এবং লুট হওয়া জব্দ করা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা জানিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।</p> <p>৫.</p> <p>আর্থিক খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসতে পারছে এটাই সুখবর—অন্তত অবস্থা এমন নয় যে ‘রোম যখন পুড়ছে সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছেন’। অবশ্যই আগুন নেভাতে ফায়ার ব্রিগেড আসছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বসে নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রগুলোতে যত সমস্যা দেখা দিতে পারে তা বিচারিক ব্যবস্থাপনা বা আইন-আদালতে। পূর্ববর্তী সরকার বা সরকারগুলোও কিন্তু ঋণখেলাপি হ্রাস করতে উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে ‘ধড়িবাজ’ ঋণখেলাপিদের ধরা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ এমনও হয়েছে বলে শোনা যায়, এনবিআর কর ফাঁকির মামলা করেছে যাঁর বিরুদ্ধে, উচ্চ আদালত থেকে স্থিতাবস্থা নিয়ে বিবাদী বছরের পর বছর অপরাধমুক্ত থাকতে পেরেছেন এবং পারছেন।</p> <p>সুতরাং ব্যাংকিং খাতের সংস্কার যে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা বোধ করি অনুধাবনে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এমনকি বিশেষ করে দুর্নীতি কমিশন এবং বিচার বিভাগীয় সংস্কার ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে।</p> <p>৬.</p> <p>আর্থিক খাতের জন্য আমরা চাই শিষ্টের লালন এবং দুষ্টের দমন। আমাদের চাওয়া তখনই পাওয়া হবে যখন সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সংস্কারের কাজগুলো সম্পন্ন করবে। তাতে হয়তো কিছু সময় লাগতে পারে, কিন্তু সার্বিক সংস্কারের বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে। এ জন্য আমরা সংকটে থাকা আট ব্যাংককে প্রয়োজন অনুযায়ী তারল্য সহায়তা দিতে বলেছি। গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা সীমিত পরিসরে তারল্য সহায়তা দিতে চাই। সরকার আমানতকারীর কথা ভেবে তাদের পাশে দাঁড়াবে।’</p> <p>রাখঢাক না রেখে রক্তচক্ষু কিংবা চাকরির তোয়াক্কা না করে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে যায়, এর কম কিছুতেই নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। আমরা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটা আর্থিক খাতের অপেক্ষায় রইলাম এবং একই সঙ্গে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি তথা ব্যাংকের তারল্য সংকটের জন্য যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় এনে যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। যত দ্রুত তত মঙ্গল।</p> <p>৭.</p> <p>কিন্তু আগামী দিনগুলোতে, বিশেষত অচিরে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলো উপেক্ষা করলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন—ক. খুব দ্রুত অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা; খ. অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার ভাষায়, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটে এক দলের নির্গমন ও অন্য দলের আগমন প্রতিহত করা; গ. বাজার এবং ব্যাংক ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণ করতে আইনি কাঠামো পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা এবং ঘ. অতি দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে ছাত্রদের ক্লাসে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া। অতিসত্বর অন্তত এগুলোর সমাধান না এলে স্বল্প মেয়াদে সংকট তীব্রতর হতে পারে।</p> <p><em>লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</em></p>