<p>দীর্ঘকাল ধরেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের যে অঞ্চলটি বাউলগান কিংবা লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার হিসেবে সমাদৃত, সেটি বর্তমান নেত্রকোনা জেলা। এই জেলায় জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য সাধক, কবি ও লোকগীতির সমঝদার ব্যক্তিরা। আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ও তৎকালীন জমিদার কেদারনাথ বাবুর নির্দেশনায় নেত্রকোনার আইথর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করা স্বল্পশিক্ষিত ও লোকসংস্কৃতি অন্তপ্রাণ চন্দ্রকুমার দে এই অঞ্চলের লোকগীতি সংগ্রহ করার কাজে হাত দেন। ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি মৈয়মনসিংহ গীতকা নামক এক অসামান্য সাহিত্যভাণ্ডার। এই সাহিত্য প্রকাশের পরই ওই অঞ্চলের বিভিন্ন কবিগান, বাউলগান, পালা, সর্বোপরি বিভিন্ন সংগীত কালক্রমে লিপিবদ্ধ করার একটা প্রয়াস আমরা লক্ষ করি। </p> <p>যাকে নিয়ে এই লেখা—বাউলকবি রশিদ উদ্দিন নেত্রকোনারই মানুষ। ১৮৮৯ সালের ২১ জানুয়ারি মা ফজর বানুর কোলজুড়ে আসেন ভাটিবাংলার বাউলকুলের শিরোমণি বাউলকবি রশিদ উদ্দিন। তাঁর বাবার নাম মশ্রব উদ্দিন। বাউল রশিদ উদ্দিন নেত্রকোনা সদর উপজেলার বহিরচাপড়া গ্রামে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মল্লিক উদ্দিন ও নিজাম উদ্দিন নামে তাঁর আরো দুই ভাই ছিলেন। বড় ভাই মল্লিক উদ্দিন এন্ট্রাস পাস করে গৌরীপুর জমিদারের কাচারিতে কেরানির চাকরি করতেন। বাউল রশিদ উদ্দিনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। বড় ভাই মল্লিক উদ্দিনের কাছে তিনি বাল্য শিক্ষার হাতেখড়ি নেন। বাউল রশিদ উদ্দিনের বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক এবং তাঁর দাদার নাম আজম আলী মোড়ল। তিনি ছিলেন ওই সময়ের একজন নামকরা পালোয়ান ও কুস্তিগির। তাঁর দাদা কুস্তিগির হিসেবে গৌরীপুরের জমিদারের কাছ থেকে বাড়িসহ একখণ্ড লাখেরাজ কৃষিজমি প্রাপ্ত হন। একসময় ওই জমিতেই  রশিদ উদ্দিনের বাবা মরহুম মশ্রব উদ্দিন তার তিন ছেলেকে নিয়ে গড়ে তোলেন এক ছোট্ট সংসার।</p> <p>বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বড় অংশজুড়েই হাওর। চারদিকে অথই পানি, সারি সারি হিজলের গাছ, যোগাযোগহীনতা, আকাশের মেঘ কিংবা তারা, তার সঙ্গে মিতালি করে জল-জ্যোৎস্নার খেলা, বর্ষার উত্তাল ঢেউ, ‘আফালের’ গর্জন, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, অভাব- অনটনহীন দিনের প্রশান্তি, পরিবেশ-প্রতিবেশ সব মিলিয়ে এখানকার মানুষদেরকে ভাবুক করে তুলত। সারা দিন পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় তারা গান-বাজনা নিয়ে মেতে উঠত। এখানকার লিলুয়া বাতাস  ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের মনকে উদাস করে তুলত। তাই রাতের বেলায় তাঁরা বাউল গানের আসর বসাত। তাঁদের আঞ্চলিক ভাষায় তাঁরা একে বলত বাউলা গান। এই গান ভাটিবাংলার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এমন এক পরিবেশেই এই ভাটি বাংলায় জন্ম নেন অনেক বাউল সাধক। বাউলকবি রশিদ উদ্দিন সেখানে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উদাস প্রকৃতির মানুষ। স্কুলের লেখাপড়ায় তাঁর মন বসেনি। বড় ভাই মল্লিক উদ্দিনের কাছ থেকে প্রাথমিকের হাতে খড়ির পরেই তিনি এর পাঠ চুকান। </p> <p>বাল্যকাল থেকেই রশিদ উদ্দিন ছিলেন আত্মভোলা গোছের একজন মানুষ; কিন্তু গানের প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। তাঁর সংগীতের হাতে খড়ি ঘটে পার্শ্ববর্তী গ্রামের টকনা মিস্ত্রির সান্নিধ্যে এসে। তাঁর বয়স যখন পনেরো-ষোলো, তখন তিনি টকনা মিস্ত্রির কাছ থেকে একতারা বাজানোসহ গান ও সুরের তালিম নিতে শুরু করেন। তখন বহিরচাপড়া গ্রামে কৃষ্ণলীলা গান হতো। গান ও সুরের প্রতি তার অত্যন্ত দরদের কারণে দ্রুত তিনি অধিকাংশ যন্ত্র বাজানো আয়ত্ত করেন এবং অত্যন্ত মধুর সুরে তাল লয়ে গান গাইতে শুরু করেন। যেকোনো গানের আসরে তিনি তখন  শ্রোতা হয়ে ছুটে যেতেন, শুনতেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। এভাবে তিনি খুব দ্রুত গানের সঙ্গে পালাগানও শিখতে থাকেন। গানের পাশাপাশি একসময় তিনি কৃষ্ণলীলা পালাগানে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেন। </p> <p>বাউলকবি রশিদ উদ্দিন ছিলেন অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী। দীর্ঘদেহী রশিদ উদ্দিন যৌবনে যাত্রা অনুষ্ঠানে ভালো অভিনয় করতেন এবং অত্যন্ত মধুর সুরে বাঁশি বাজাতেন। বাউল হয়ে ওঠার আগে প্রায়ই তিনি গানের আসরে বাঁশি বাজাতেন। গানের আসর ছাড়াও তিনি রাত নিশিতে পুকুরপাড়ে কিংবা ঝিলের ধারে উদাস হয়ে বাঁশিতে সুর তুলতেন। চারপাশের বিস্তীর্ণ অথই পানি, রাতের নিস্তব্ধতা, নীল আকাশের তারার সঙ্গে জল- জ্যোৎস্নার মিতালি আর সেই সঙ্গে মন উদাস করা রশিদ উদ্দিনের বাঁশির জাদুকরী সুর মানুষকে ব্যাকুল করে তুলত। বাঁশি যেন মনের অস্ফুট বেদনাগুলোকে বের করে নিয়ে আসত তার সুরের মাধ্যমে। অন্য অনেকের সঙ্গে তাঁর বাঁশির সুরে উদাসী হয়েছিলেন বহিরচাপড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার জলিল উদ্দিন শেখের কন্যা দৌলতেননেছা। রশিদ উদ্দিনের বাঁশির সুরে পাগল হয়ে দৌলতেননেছা ঘর ছাড়েন। পরবর্তী সময়ে সেই দৌলতেননেছার সঙ্গেই অনেক ঘটনাপ্রবাহের পর রশিদ উদ্দিনের বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে আরশাদ মিয়া ও বোরহান উদ্দিন নামে দুটি ছেলের জন্ম হয়। বাউল রশিদ উদ্দিন তখন ধীরে ধীরে পুরোপুরি বাউল সাধনায় মনোযোগী হয়ে পড়েন। আধ্যাত্ম সাধনার আশায় তিনি আমিরজান নামক এক নারীকে বিয়ে করেন। এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। সেই ঘরে চার ছেলে ও চার মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেদের নাম কুতুব উদ্দিন, আল-আমিন, আল-ছাদেক ও আবু আনসার কালা মিয়া এবং মেয়েদের নাম জোবেদা খাতুন, পদিনা আক্তার, সুরাইয়া আক্তার ও মারিয়া আক্তার। </p> <p>১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোনা শহরের গরহাট্টায় প্রথম তত্ত্বভিত্তিক ও তর্কভিত্তিক মালজোড়া গানের যাত্রা শুরু হয়। এর আগে বাউলগান মূলত ওই অঞ্চলে বৈঠকি আসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাউল কবি রশিদ উদ্দিনই প্রথম এই তত্ত্বভিত্তিক ও প্রশ্নোত্তরভিত্তিক বাউল গানের সূচনা করেন। এই গানই মালজোড়া গান হিসেবে পরবর্তী সময়ে পরিচিতি পায়। তাই বাউলকবি রশিদ উদ্দিনকে মালজোড়া গানের জনক বা প্রবর্তক বলা হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে তখন বাউল গানই ছিল মানুষের সুখ-দুঃখ-বেদনার রূপ রস গন্ধ বিলানো, নিজেকে হারিয়ে নিজেকে খোঁজা ও আত্মোপলব্ধির একমাত্র মাধ্যম। বাংলার ভাটি অঞ্চলখ্যাত ময়মনসিংহ ছিল দেশের অবহেলিত একটা অঞ্চল। মানুষগুলো ছিল সহজ, সরল ও দরিদ্র।  বাউলকবি রশিদ উদ্দিন গানে সেই রূপ-রস বিলানোর কাজটি করে গেছেন। ধীরে ধীরে তাঁর বাড়ি বাউল গানের মিলনমেলায় পরিণত হয়।</p> <p>শুধু গানের আসরই নয়, বাউল রশিদ উদ্দিনের বাড়িতে বাউল গানের প্রশিক্ষণ হতো। তখন খালিয়াজুড়ি থানার বাউল সাধক ও বিরহী উকিল মুন্সি এ সময় রশিদ উদ্দিনের এই মালজোড়া ও কবিগানে যোগদান করেন। প্রখ্যাত বাউল জালাল উদ্দিন খাঁ এই সময় বাউল রশিদ উদ্দিনের বাড়িতে লজিং থেকে পড়ালেখা করতেন। বাউল রশীদ উদ্দিনের নেতৃত্বে মালজোড়া গানের চর্চা হতে থাকে এবং জালাল উদ্দিন খাঁ নিয়মিত সেই গানবাজনার আসরে অংশগ্রহণ করতেন এবং বাউল রশিদ উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শুধু বাউল জালাল উদ্দিন খাঁই নন, ভাটিবাংলার অধিকাংশ প্রখ্যাত বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের শিষ্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাধক উকিল মুন্সি, বাউল আলী হোসেন, বাউল জাবেদ আলী, বাউল পিতাম্বর নাথ, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল তৈয়ব আলী, বাউল মিরাজ আলী, বাউল তাহের উদ্দিন, উমেদ আলী ফকির, বাউল চান মিয়া ফকির, বাউল ইদ্রিস মিয়া এবং বাউল শাহ আব্দুল করিম ছিলেন অন্যতম শিষ্য।  একসময় তাঁর শিষ্যদের দিয়ে মালজোড়া গান শুরু করিয়ে দিয়ে বিচারকের আসনে বসতেন ওস্তাদ বাউল রশিদ উদ্দিন। </p> <p>এই মালজোড়া গানের আসর বসিয়ে বাউলকবি রশিদ উদ্দিন ও তৎকালীন বাউলরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষে মানুষে বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণের কথা গানের সুরে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। কিন্তু পথটি খুব মসৃণ ছিল না। কট্টরপন্থী আলেম-উলামা, গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণরা তাদের এই সুর ও সংগীত সাধনায় অনেক বিপত্তি ঘটান। এ ঘটনা অবশ্য এ অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। তখন বাউলদের ছন্নছাড়া, পাগল, উন্মাদ হিসেবে অবজ্ঞা করা হতো। সেই সমাজ ও পরিবেশে সম্ভবত রশীদ উদ্দিনই প্রথম তাঁর নামের আগে ‘বাউল’ শব্দটি যোগ করেন। পূর্বসূরি লালন শাহ যেভাবে সাঁইজি হলেন, ঠিক সেভাবেই রশীদ উদ্দিন হলেন বাউল। পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ শিল্পীও নিজেদের নামের আগে এ বাউল শব্দটি জুড়ে দেন। রশিদ উদ্দিন বাউল শিল্পী ছাড়াও লোকজ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও সাম্যবাদী মরমি সাধক ছিলেন। সেই সময়ে ওই অঞ্চলে লেংটা ফকিরদের জলসা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। </p> <p>ওই সময়ে  কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থেকে নেত্রকোনার বহিরচাপড়া গ্রামে এক লেংটা পীর ফকিরের আগমন ঘটে। ১৯০৯ সালে রশিদ উদ্দিন এই লেংটা পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার পর থেকে তাঁর মধ্যে ভীষণ পরিবর্তন দেখা যায়। সেই সময়ে তিনি আধ্যাত্ম সাধনায় উন্নতি লাভ করেন, প্রচুর গান রচনা ও সুরারোপ করেন। নিজ বাড়িতে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে জলসা বসানো শুরু করেন। সেই জলসায় উপস্থিত থাকতেন সাধক উকিল মুন্সী, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল তৈয়ব আলী, বাউল আলী হোসেন, বাউল জাবেদ আলী, বাউল পিতাম্বরনাথ, বাউল মিরাজ আলী, বাউল তাহের উদ্দিন, বাউল ইদ্রিস মিয়া, বাউল শাহ আব্দুল করিম প্রমুখ।</p> <p>রশিদ উদ্দিন ছিলেন একজন খাঁটি সাধক। স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য সন্ধানে এবং মানবদেহ, গুরুসাধন, সৃষ্টিতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, জীবাত্মা-পরমাত্মা প্রভৃতির রহস্যভেদ নিয়ে তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে যান। সে সময় গৃহত্যাগী হয়ে তিনি প্রথমে আসেন তাঁর ওস্তাদ কটিয়াদির ল্যাংটা শাহর আখড়ায়। সেখান থেকে তিনি ল্যাংটা শাহকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান আসামের লাউরের পাহাড়ে। এক বছর সেখানে অবস্থানের পর চলে আসেন সিলেটের শাহ পরানের মাজারে। দীর্ঘদিন অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরেও তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস পর বহু জায়গায় তাঁকে খোঁজ করার পর তাঁর শিষ্য বাউল জালাল উদ্দিন খাঁ শারফিনের মাজারে তাঁকে ‘ফানাফিল্লাহ’ অবস্থায় উদ্ধার করেন এবং তাঁকে সঙ্গে করে বালুয়াখালী ফিরে আসেন। মাজারে ভ্রমণ রশিদ উদ্দিনের আধ্যাত্মিক সাধনা ও বাউলতত্ত্ব চর্চায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। তখন তিনি বিভিন্ন হাদিস, পুঁথি, রামায়ণ, বেদ পড়তেন এবং কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি তখন দিনে দুইবার নামাজ পড়তেন, ফজরের ও মাগরিবের নামাজ। পরিধান করতেন সবুজ রঙের পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। </p> <p>বাউলকবি রশিদ উদ্দিন অসংখ্য গান লিখে গেছেন। কিন্তু তার খুব কম অংশই সংগ্রহে আছে। বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলোভাবে তাঁর লেখা হয়তো দুই শ থেকে আড়াই শ গান সংগ্রহে আছে।  তাঁর জীবদ্দশায় ১৯২৯ সালে তাঁর গানের একমাত্র পাণ্ডুলিপি ‘স্বররাজ লহরী’ নামে নেত্রকোনা শহরের কালীবাবুর প্রেস থেকে পুস্তক আকারে প্রথম সংস্করণ এবং ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয়। কিন্তু এই স্বরাজ লহরী বইটি এখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বাউলকবি রশিদ উদ্দিনের লেখা একটি অতি জনপ্রিয় গান প্রখ্যাত গায়ক আব্দুল আলীমের দরাজ কণ্ঠে আমরা শুনেছি, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই গানের গীতিকবির কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বিধায় এত জনপ্রিয় একটি গানের গীতিকার কে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা জানতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ‘মানুষ ধর, মানুষ ভজ, শুন বলি রে পাগল মন’, মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন’ নামক গানটি শ্রোতাদের সম্মুখে তুলে না ধরলে এত সুন্দর একটি গান মানুষের কাছে অজানাই থেকে যেত হয়তো। বাউলকবি রশিদ উদ্দিন এই গানের জন্য ১৯৯৯ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার (মরণোত্তর) হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পুরস্কার লাভ করেন। এর পর থেকে নতুন প্রজন্মের কাছে বাউলকবি রশিদ উদ্দিন ও তাঁর গান নিয়ে আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়।<br /> <br /> যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে রশিদ উদ্দিনের গান লিপিবদ্ধ ছিল না, তাই অনেকে তাঁর গান নিজের নামে প্রচার করার অপচেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন বাউল গানের ভনিতায় নিজের নাম জুড়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি মনোবেদনায় ভোগেন। অবশেষে তাঁর অনুরোধে কবি রওশন ইজদানি কর্তৃক বাংলা ১৩৬২ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় ‘বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটিতে তাঁর গান নিয়ে অনধিকার চর্চার বিষয়টি লেখা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, তা আজও বন্ধ হয়নি। ঢাকা ফোক ফেস্টের মতো একটি বিশাল প্ল্যাটফর্মে জনৈক বাউল ‘মাগো মা ঝি গো ঝি করলাম কি রঙে/ ভাঙা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙে’ নামক বাউল রশিদ উদ্দিন রচিত গানটি পরিবেশন করেন, কিন্তু ভণিতায় তিনি প্রখ্যাত বাউল খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করেন। সংগ্রহের অভাবে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে বা ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে ভাটিবাংলার গানের গুরু বাউলকবি রশিদ উদ্দিনের গান। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো- শ্রাবণ মেঘের দিনে ব্যবহৃত  ‘সোয়াচাঁন পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’- এই গানটি শতকরা নিরানব্বইজন শ্রোতা জানেন যে এটা সাধক উকিল মুন্সির গান। কিন্তু এরও  প্রকৃত রচয়িতা হলেন বাউলকবি রশিদ উদ্দিন। </p> <p>আজ থেকে প্রায় ষাট বছর পূর্বে এই প্রখ্যাত বাউল আমাদের ছেড়ে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। পরিতাপের বিষয় যে প্রখ্যাত এই বাউলের মৃত্যুর পর সংরক্ষণের অভাবে তাঁর সৃষ্টিকর্ম, তাঁর কালজয়ী গানগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে বাউল রশিদ উদ্দিনের গানগুলো অতি  পরিচিত ও জনপ্রিয় হলেও গানের গীতিকারের নাম তারা জানেন না, রয়েছে নানা ধরনে বিভ্রান্তি। আরেকটি বিষয় স্পষ্টই বলতে চাই যে, স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই রশিদ উদ্দিন সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না, অথচ তিনি বাউল গানের একজন দিকপাল, ভাটিবাংলার প্রখ্যাত বাউলদের ওস্তাদ।  আর্থিক দীনতায় তিনি এবং পরে তাঁর পরিবার তাঁর সব গান প্রকাশ করতে পারেনি। তাঁর বেশির ভাগ গান মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত এবং শিষ্যদের কাছে সংরক্ষিত ছিল। আর এই সুযোগটি গ্রহণ করে তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো অনেকে নিজ নামে চালিয়ে দিয়েছেন কিংবা অনেকে নিজে গেয়ে ‘সংগৃহীত’ বলে উল্লেখ করেছেন। এখন এই প্রখ্যাত বাউলের গান ও স্মৃতি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ খ্রি. বাহিরচাপড়া গ্রামে রশিদ উদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে  ‘বাউল রশিদ একাডেমি’ স্থাপিত হয়। </p> <p>জীবনভর আত্মভোলা ও এলোমেলো এই মানুষটি ভাটি বাংলায় অসংখ্য বাউল শিষ্য তৈরি করে গিয়েছেন, যা আমাদের লোকসংগীত/লোকসাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। অসংখ্য গানের এই স্রষ্টা ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সকালে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ওপারে পাড়ি দেন। মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাঁর বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে। কিন্তু সেই স্থানটির মালিকানাও বাউল রশিদ উদ্দিন বা তাঁর পরিবারের কেউ নন। কারণ কবরের জায়গা কেনার মতো আর্থিক সঙ্গতি তাঁদের ছিল না। বৈষয়িক বিষয়ে তিনি কতটা উদাসীন ছিলেন তা এই বিষয় থেকেও বোঝা যায়। ওপারে ভালো থাকবেন হে মহাজন। <br /> <br /> আজ আপনার জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার প্রতি রইল এই প্রজন্মের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।</p> <p>তথ্যসূত্র : <br /> ১) ব্রাত্য লোকায়ত লালন :  সুধীর চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।<br /> ২) বাউল ধ্বংস ফত্ওয়া ও অন্যান্য : আবুল আহসান চৌধুরী, লালন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।<br /> ৩) বাংলাদেশের বাউল : সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত, ড. আনোয়ারুল করিম, বর্ণায়ন, ঢাকা, বাংলাদেশ।<br /> ৪) নেত্রকোনার বাউলগীতি : গোলাম এরশাদুর রহমান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৪।<br /> ৫) বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন ও তাঁর গান : আবু দায়েন, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১৩।<br /> ৬) বাউল রশিদ উদ্দিন সমগ্র : সাইফুল ইসলাম শাহীন, উৎস প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০।</p> <p><strong>লেখক : </strong>কবি, বাউল গবেষক ও ডেপুটি কমিশনার (অব.) বাংলাদেশ কাস্টমস</p>