কাজী নজরুল ইসলাম উন্নত মানবিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে লেখার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প—এই বোধজাত তাঁর লেখকদর্শন নয়। সামাজিক দায়জাত তাঁর লেখা। আঙ্গিকের পরিবর্তে তাই তাঁর বিষয় প্রাধান্য লাভ করেছে অনেক ক্ষেত্রে।
নজরুলজয়ন্তী
কাজী নজরুল ইসলাম ও জুলাই অভ্যুত্থানের পূর্বাপর
- তুহিন ওয়াদুদ

আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট দেখা দেয়, তখনই নজরুল সাহিত্য-সংগীত আমাদের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিককালে ভারতবর্ষে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই করলে বন্দি করা হতো, শাস্তি দেওয়া হতো।
সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ফিরে আসি। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনো জন? কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ সাম্প্রদায়িক শক্তি বেড়ে গেলে ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধ পাঠ আমাদের সেসব থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে। যে সমাজ পরিবর্তন করার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, সেই সমাজবাস্তবতার বহিরাঙ্গন বদলালেও অন্তরাঙ্গনে আছে পূর্ববর্তী সমাজের ছায়া। কাজী নজরুল ইসলামের কাঙ্ক্ষিত সমাজে পৌঁছতে এখনো অনেক পথ বাকি। সেই পথে আমরা হাঁটছি কি না, সেটিও ভাবনার।
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম কিভাবে আরো প্রাসঙ্গিক, সেটি উল্লেখ করা যেতে পারে। ব্রিটিশ পর্বে লিখিত নজরুল রচনার প্রধানতম দিক বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের মূলোৎপাটন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সমাজ থেকে ব্রিটিশ পর্বের অবসান হয়েছে। পাকিস্তানি শোষণ-পর্বের পরিসমাপ্তি হয়েছে। দেশ প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাধিক বছর হয়েছে, কিন্তু আজও কুলি-মজুরররা মার খেয়ে চলছে। আজও পোশাক কারখানার শ্রমিকরা যে সামান্য বেতন পান, তার জন্য রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম করে চলেছেন। জুলাই-পরবর্তী এটি আমাদের কাম্য নয়। কাজী নজরুল ইসলাম সেই সময়ে লিখেছেন, ‘দেখিনু সেদিন রেলে,/কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এলো এলো জল।/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
জুলাই আন্দোলনে আমাদের নারীরাও সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আন্দোলনের পরই নারীদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কালে কালে দেশে দেশে নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখার ইতিহাস সুদূরের নয়। এখনো সমাজে তার ব্যত্যয় ঘটছে না। পূর্বাপর নারীর অবস্থান সমাজে অভিন্ন থাকতে পারে না। কাজী নজরুল ইসলাম নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেভাবে কলম ধরেছেন, এতে নারীবাদী চরিত্রের গভীরতর রূপ উন্মোচিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘সেদিন সুদূর নয়—যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে ওদের জয়।’ আরো অনেকবার তিনি নারীদের পক্ষে লিখেছেন।
নজরুলযুগে পুরুষ-নারীর সামাজিক মর্যাদা সমপর্যায়ে ছিল না। সে কারণে কাজী নজরুল ইসলাম নারীদের পক্ষ নিয়ে অনেক আলাপ করে গেছেন। জুলাই অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে তাই নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা জুলাই-উত্তর সময়ে নারীদের নিজেদের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন করতে দেখছি। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গোটা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ কাজ করে গেছেন। নারীরাও অবরুদ্ধ জীবন থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছেন। জনকল্যণাকামী সমাজ বিনির্মাণে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া বাঞ্ছনীয়। জুলাই অভ্যুত্থানে যে ধারাবাহিক কর্মসূচি, সেখানে নারীরা কোনো অংশে কম ভূমিকা পালন করেননি। নারীদের পূর্ণমর্যাদা পাওয়া তাঁদের অধিকার।
লেখক রাষ্ট্র পরিচালনা করেন না। দর্শন সৃষ্টি করেন। লেখনী দ্বারা সমাজকে আলোকিত করার পথ দেখান। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই রাষ্ট্র যদি জনস্বার্থপন্থী রাষ্ট্র না হয়, তাহলে লেখকরা যত আলোকসম্ভাবী লেখাই লিখুন না কেন, সমাজ বদলাবে না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের দেশে প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যক্রমভুক্ত। এই গুরুত্বটুকু তাঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর লেখকদর্শন বাস্তবায়নের চেষ্টা কার্যত কখনোই হয়নি।
ব্রিটিশ শাসনামলে কাজী নজরুল ইসলামকে শত্রু ভাবা হয়েছিল। পাকিস্তান পর্বে কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা বাস্তবায়নের পথ রচনা করা হয়নি। স্বাধীন দেশে কাজী নজরুল ইসলামের রচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও তাঁর চেতনা প্রতিষ্ঠা করার কোনো তৎপরতা ছিল না। জুলাই অভ্যুত্থান-উত্তর সমাজে কাজী নজরুল ইসলামের দেখানো পথে হাঁটা সম্ভব। এ পথে রাষ্ট্রকাঠামো হবে আদর্শ রাষ্ট্রকাঠামো। রাষ্ট্রে ধর্ম, নারী, বিত্তহীন মানুষ থাকবে নিরাপদ। এতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত খবর

চালের মূল্যবৃদ্ধি : ব্যবস্থাপনা সমস্যা ও ব্যবসায়ীদের কারসাজি দায়ী
- ড. জাহাঙ্গীর আলম

বেশ কয়েক মাস ধরে চালের বাজার অস্থির। বোরো ধান কাটার সময় দাম কিছুটা কমেছিল। মৌসুম পার না হতেই আবার বাড়ছে চালের দাম। অথচ এ সময় চালের দাম স্থিতিশীল থাকার কথা, কিন্তু চালের বাজার চলছে উল্টো পথে।
অনেকেই মনে করেন, এটি অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি।
এবার দেশে চালের কোনো সংকট নেই। সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ আছে ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৭৭৫ টন। গমসহ মোট খাদ্যশস্য আছে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬ টন। এ ছাড়া ধানের মজুদ আছে দুই লাখ ২৪ হাজার ৭৪৫ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল। গম আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫ লাখ ৪০ হাজার টন। চালের মোট সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হচ্ছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ টন। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চালের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল সর্বোচ্চ। এরপর এভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণই নেই।
এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে চালের দামে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত এক মাসে চালের দাম কমেছে ১০.১৮ শতাংশ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদনকারী দেশগুলোতে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ায় এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় চালের দর নিম্নমুখী হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের পর বিশ্ববাজারে এখন চালের দাম সর্বনিম্ন। অথচ বাংলাদেশের বাজারে বাড়ছে চালের দাম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা এখন বেশি দামে ধান কিনেছেন, তাই চালের দাম পড়ছে বেশি। প্রকৃত প্রস্তাবে বড় মিলাররা ধান কিনে নিয়েছেন উৎপাদনের পরপরই। তখন ভেজা ধান প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দামে। সরকার নির্ধারিত এক হাজার ৪৪০ টাকা দর কখনোই কৃষকদের দেননি ব্যবসায়ীরা। পরে যখন ময়ালে ধানের দাম বেড়েছে, তখন কৃষকদের হাতে বিক্রির মতো ধান নেই। ধান চলে গেছে ব্যবসায়ীদের গুদামে।
এবার দেশে বোরোর উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। দেশের মোট চাল উৎপাদনে বোরোর হিস্যা প্রায় ৫৪ শতাংশ। অতএব, এই মৌসুমের গুরুত্ব বেশি। চলতি মৌসুমে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ২৬ লাখ টন অর্জন করা সম্ভব না হলেও গত বছরের দুই কোটি সাড়ে ১০ লাখ টনের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কমপক্ষে দুই কোটি ১৪ লাখ টন হবেই। এটি আমাদের বার্ষিক খোরাকির অর্ধেকের চেয়েও বেশি। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ আমন ধানের মৌসুম পর্যন্ত তাতে অনায়াসেই চলবে। অতএব, অদূর ভবিষ্যতে দেশে চালের কোনো সরবরাহ সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই। সামনের আউশ মৌসুমের উৎপাদন ভালো হলে এবার চাল আমদানির প্রয়োজন হবে না। বর্তমানে চালের দাম বাড়ছে অজুহাতে অনেকে চাল আমদানির পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে লাভবান হবেন চাল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা এবং বিদেশের চাল উৎপাদনকারী কৃষকরা। বাংলাদেশের কৃষকরা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভোক্তারাও লাভবান হবেন না। অতএব, আগামী আউশ ও আমন ধানের নিরাপদ উৎপাদনের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির মাধ্যমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
ওদিকে চালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আলুর দামও বেড়েছে। প্রকারভেদে কেজিতে বেড়েছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। সবজিতেও স্বস্তি নেই। বিভিন্ন প্রকার সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এতে বেশ অস্বস্তিতে আছেন ভোক্তারা। ঢাকা শহরে এখন পটোল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। বরবটির কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকা কেজি। টমেটোর কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। ডিমের দাম বেড়েছে ডজনে ১০ থেকে ২০ টাকা। মাছের দামও বেড়েছে। এভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। তাদের লাগাম টেনে ধরা উচিত। নিয়মিত বাজার মনিটরিং এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। বাজার পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পণ্যের যৌক্তিক মূল্য সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা উচিত। বাজার কারসাজির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াই উত্তম পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি হওয়া উচিত উৎপাদন খরচ। এর সঙ্গে বিপণন খরচ ও মুনাফা যোগ করে নির্ধারিত হবে ভোক্তা মূল্য। আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হবে আমদানি মূল্য। অভ্যন্তরীণ খরচ ও ব্যবসায়ীর লাভ যোগ করে হবে ভোক্তা মূল্য। বিপণন শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে তার ঘোষণা থাকা উচিত, যাতে কেউ চড়া দাম হাঁকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে গরিব ভোক্তাদের।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩.৮০ শতাংশ। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৯৩ শতাংশে। গেল জুনে তা আরো কমে ৭.৩৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তবে চাল, আলু ও সবজির সাম্প্রতিক উচ্চমূল্যের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনিটরিং জোরদার করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সিন্ডিকেটের কারসাজি থামাতে হবে। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ আরো দৃশ্যমান ও কার্যকর করতে হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ। সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

ব্রিকস সম্মেলনে নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়
- এ কে এম আতিকুর রহমান

ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরোতে গত ৬-৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হলো ১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা দুই দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সম্ভবত এবারই প্রথম চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করে তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্মেলনে ভাষণ দেন।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় (থিম) ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার করা’। চলমান বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্রিকস দক্ষিণ সহযোগিতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছুটা কাজ করতে পারে, সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বাস্তবতা অনুধাবন করে রাজনীতি, নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে ব্রিকস সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির এই আহবান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলেই নেতাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিন অর্থাৎ ৬ জুলাই উদ্বোধনী ভাষণে প্রেসিডেন্ট লুলা ব্রিকসকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) উত্তরসূরি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, যেহেতু বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ চলছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব নজিরবিহীন সংঘাত অতিক্রম করছে, তাই বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোকে জোরদার করার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও উন্নয়ন স্থাপনে ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উদ্বোধনীর দিনের বিবৃতিতে গাজায় দ্রুত, স্থায়ী ও শর্তহীন যুদ্ধবিরতির জন্য সব পক্ষকে সদিচ্ছার সঙ্গে আরো আলোচনার আহবান জানানো হয়।
রিও ডি জেনেইরো ঘোষণাপত্রে ১২৬টি প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, জলবায়ু সহযোগিতা ইত্যাদি। ঘোষণাপত্রটি কয়েক মাসের ফলপ্রসূ সমন্বয়কে প্রতিফলিত করে, যেখানে ২০০টিরও বেশি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্ষুধা নির্মূল, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং উদীয়মান প্রযুক্তি বিকাশের মতো ক্ষেত্রগুলোতে ২০০টি নতুন সহযোগিতা ব্যবস্থা তৈরি বা জোরদার করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি জোরদার করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, সেগুলোকে পাঁচটি ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে—(১) বহুপাক্ষিকতা জোরদার এবং বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার করা; (২) শান্তি, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা প্রবর্তন; (৩) আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও আর্থিক সহযোগিতা গভীরতর করা; (৪) জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং টেকসই, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রসারণ এবং (৫) মানব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন প্রসারণের জন্য অংশীদারি।
ব্রিকস দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা এবং দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংলাপ ও পরামর্শ প্রচেষ্টা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আইএমএফ কোটা এবং বিশ্বব্যাংকের শেয়ারহোল্ডিং বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের ঘোষণার পাশাপাশি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার দেওয়া আরো তিনটি নথি অনুমোদিত হয়েছে। সেগুলো ছিল জলবায়ু অর্থায়নের ওপর ব্রিকস নেতাদের কাঠামো ঘোষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্বব্যাপী শাসনের ওপর ব্রিকস নেতাদের ঘোষণা এবং সামাজিকভাবে নির্ধারিত রোগ নির্মূলের জন্য ব্রিকস অংশীদারি।
রিও শীর্ষ সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কিছুটা মতবিরোধের যে উপস্থিতি ছিল, তা লক্ষ করা গেছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রায়ই সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করলেও আবার জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে দেখা যায় অনেক সদস্যকেই। পশ্চিমাদের সম্পর্কে অবস্থানগত পার্থক্য ব্রিকস দেশগুলোর মুখোমুখি হওয়ার আরেকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ। তবে এসব মোকাবেলা করেই ব্রিকস ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়ে তার যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে।
ইরানের ওপর আক্রমণ এবং একতরফা শুল্কের সমালোচনা করা সত্ত্বেও ব্রিকস ঘোষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয়নি। মনে করা হয়, ব্রাজিল, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়াসহ জোটের মধ্যে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো এর পেছনে কাজ করেছে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রিকস নীতিগুলোকে ‘আমেরিকাবিরোধী’ বলে অভিহিত করেছেন।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আচরণে যে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রকৃতি কিছুটা হলেও দৃশ্যমান হয়েছে, তা দেখে অনেকের কাছেই ব্রিকসকে আগের চেয়ে কম ঐক্যবদ্ধ মনে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে তা সামলানোই বড় কথা। তবে সহযোগিতার দিকটিকে যেভাবে গভীর করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে হয়তো দুর্বলতা থাকলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। ব্রিকসের নতুন উন্নয়ন ব্যাংক অর্থবহ সফলতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে এআই শাসনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে নির্ধারিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই এবং পরিবেশ সুরক্ষার অর্থায়নে ব্রিকস সহযোগিতার জন্য উল্লেখযোগ্য ও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। যা হোক, চলমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ব্রিকসকে বেশ কিছু ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে এবং সময়ই বলে দেবে ব্রিকস সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটুকু সফল হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক সচিব

আন্তর্জাতিক নারী ফুটবল উৎসব বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়
- ইকরামউজ্জমান

এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে ‘সি’ গ্রুপে বাংলাদেশের তিন অচেনা প্রতিপক্ষের মধ্যে দুটিই ছিল ফিফার র্যাংকিংয়ে অনেক এগিয়ে। তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং মনঃসংযোগের সঙ্গে দলবদ্ধ লড়াইয়ের মঞ্চে কোচের ম্যাচ পরিকল্পনা পেশাদার মানসিকতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বলেই অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবারই প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি অতিক্রম করে এশিয়ার বড় গণ্ডিতে স্থান হয়েছে। নারী ফুটবলে এটি অনেক বড় ঘটনা। ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
নারী ফুটবলের সাফল্য নিয়ে পুরো দেশ মেতে উঠেছিল। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের সম্মানের জন্য আরেকটি লড়াইয়ে নামবে আজ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ নারী দল। এটি হলো ‘সাফ অনূর্ধ্ব-২০’ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫। বাংলাদেশ জাতীয় দল না হলেও অনূর্ধ্ব-২০ স্কোয়াডে আছেন অধিনায়কসহ ৯ জন ফুটবলার, যাঁরা সদ্যঃসমাপ্ত উইমেন্স এশিয়ান কাপে অংশ নেওয়া জাতীয় স্কোয়াডে ছিলেন।
সাফল্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আজ থেকে শুরু হওয়া (১১ থেকে ২১ জুলাই) চ্যাম্পিয়নশিপ ঘিরে প্রত্যাশা একটিই, শিরোপা। ফুটবল কি সব সময় প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া দেয়? তা তো নয়। মাঠে দল হয়ে প্রথম থেকে আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের সঙ্গে গেম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তা। কোচ পিটার বাটলার বাস্তববাদী। তাঁর কথা হলো প্রতিপক্ষকে ‘রেসপেক্ট’ করে খেলেই জিততে হবে। সুযোগ আছে নতুনদের পরখ করে নেওয়ার।
ভারত অংশ না নেওয়ায় টুর্নামেন্টের ‘ফরম্যাটে’ বদল এসেছে। এখন খেলা হবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ডবল লীগ পদ্ধতিতে। একটি দল ছয়টি করে ম্যাচ খেলবে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দল চ্যাম্পিয়ন হবে।
অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল উৎসব অনুষ্ঠিত হবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘এল ব্লকে’ ৩০০ বিঘা জমির ওপর মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মধ্যে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের নয়নাভিরাম প্রাইভেট সেভিয়াস। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে কোনো ক্লাবের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য এ ধরনের আধুনিক প্রাইভেট অ্যারেনা আর একটিও নেই। বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস। এটি কিংসের হোম ভেন্যু। গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে দেশে সুন্দর ফুটবল পরিবেশ সৃষ্টি এবং খেলার মানোন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। অ্যারেনাটি শুধু গ্রুপের নয়, দেশের ফুটবলের ভাবমূর্তি। মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের স্লোগান হলো ‘আগামী এখানেই’। কমপ্লেক্সের সব কাজ সম্পন্ন হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয়।
ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিত্ব, একসময়ের কৃতী হকি খেলোয়াড় এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের স্বপ্ন—‘স্পোর্টস কমপ্লেক্স’। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্য হলো দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলার চর্চা, মানোন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা। স্বপ্ন এখন একটির পর একটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অনূর্ধ্ব-২০ সাফ উইমেন্স ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, ‘আন্তর্জাতিক ফুটবল ইভেন্ট’ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। ১১ জুলাই দিনটি মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এর আগে কিংস অ্যারেনায় এএফসি ও ফিফার আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোনো টুর্নামেন্ট বা চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে রঙিন বেলুন উড়িয়ে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন ফুটবলপ্রেমিক দর্শক। দিনটি ফুটবল ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এ জন্য যে দেশে প্রথম ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত প্রাইভেট অ্যারেনার যাত্রা শুরু। উদ্বোধনী দিনে বসুন্ধরা কিংস তাদের হোম ম্যাচ খেলেছে পুলিশ এফসির বিপক্ষে এবং পরাজিত করেছে ৩-০ গোলে।
খেলার মধ্যবিরতির সময় গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাংবাদিকদের সঙ্গে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। কথা বলেছেন দেশের ফুটবল ও তার মানোন্নয়ন নিয়ে।
খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ এবং দুর্বলতা গ্রুপের এই শীর্ষ কর্মকর্তার আজন্ম। সব সময় সমতার ক্রীড়াঙ্গন নীতিতে বিশ্বাসী। মনে আছে, কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার আমাকে কমপ্লেক্সের মধ্যে মেয়েদের জন্য পৃথক প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নিশ্চিত করার জন্য বলেছেন। মেয়েদের ফুটবল ঘিরে তিনি দারুণ উৎসাহী এবং আশাবাদী। ঢাকা শহরে তো মেয়েদের খেলার জন্য কোনো পৃথক মাঠ নেই।’
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন এক প্রশ্নের উত্তরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি, সেখান থেকে মেয়েদের একটা বিশাল ভবিষ্যৎ আছে, ওদের ওখান থেকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যাবে। বসুন্ধরা গ্রুপ মেয়েদের ফুটবলকে প্রটেকশন দিচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা করছে।’ (হুইসেল এএফসি কাপ বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৬৬, মে ২০২২)
বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবলাররা গত ২ জুলাই ২০২৫ মায়ানমারে এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইংয়ের খেলায় স্বাগতিক মায়ানমারকে ২-১ গোলে পরাজিত করে চূড়ান্ত আসরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। স্থান করে নিয়েছেন স্বপ্নের ফুটবল ঘরে। এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা। অবাক হচ্ছি নারী ফুটবল ঘিরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ভেবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ
- এজাজ ইউসুফী

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থা ওলটপালট করে দেয়। এক বছর পরে এসে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, কাঠামোগত সংকট, সংস্কার প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করতে চাই।
১.
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পতিত সরকারের দমননীতি, বাকস্বাধীনতা হরণ, শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে চলে আসা সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
(২০২৩)-এ দেখিয়েছেন, কিভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দলীয়করণের শিকার হয়ে পড়ে এবং ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
২০২৩ সালের শেষ দিকে কোটা বাতিল, ন্যূনতম নিরাপদ ক্যাম্পাস, ন্যায়সংগত উপবৃত্তি এবং নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুত রূপ নেয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিবাদে। সমাজতাত্ত্বিক রহমান ও সুলতানা তাঁদের এক গবেষণায় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একে উল্লেখ করেছেন, ‘control of knowledge and control of political destiny’, যা এক সূত্রে মিলে গিয়েছে। ফলে একটি গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তির প্রয়াস হিসেবে।
২.
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি ‘সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। উদ্দেশ্য, রাজনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করা। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের দৃশ্যমান সাফল্য নেই।
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলারা পুরনো রীতি বজায় রেখেছেন।
সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব করেছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা উভয়ই রয়েছে।
৩.
জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা প্রায় স্তিমিত।
Transparency Watch (২০২৫)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনজন শীর্ষ ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে বিদেশি তহবিল অপব্যবহার এবং অবৈধ সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া সমাজের সর্বক্ষেত্রে মব সন্ত্রাস দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বও পুরনো দমননীতি গ্রহণ করেছে। আন্দোলনের সময় বাম-ডান-মধ্য সবাই একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যূথবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন ছাত্রনেতার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐক্য ভেঙে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ আদর্শিক সংগঠনে ফিরে যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এটি পরবর্তীকালে এমন কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্ম দেয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মূল ভিত্তি—মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তীব্র আঘাতের মুখে ফেলে। বিশেষ করে বিরাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী চেতনার বিপরীতে এক বিপজ্জনক স্খলন। প্রতীকী স্থাপনা ধ্বংস ও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে দুর্বল করে উগ্রপন্থী ও সুবিধাবাদী চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র দেখা দিতে থাকে।
৪.
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে একাধিক ধর্মীয় ও প্রান্তিক গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছে, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো ছাত্রসমাজের বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে নারী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের আন্দোলনও মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ‘ইনক্লুসিভনেস’ বা অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে সরকার, ছাত্র, রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্থাহীনতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে অনেকটা জটিল করে তুলতে পারে।
৫.
সরকার যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, তা কার্যত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেলেও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি, অভিযোগ এবং ‘গোপন এজেন্ডা’ নিয়ে সন্দেহ অব্যাহত রয়েছে।
দেশে এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে ঘায়েল করা এবং মব ভায়োলেন্সের দাপট চলছে। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সংস্কারে কিছুটা সাফল্য দেখালেও সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। পররাষ্ট্রনীতি বলতে তেমন কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বহুল প্রচারিত সফরের পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গতি আসেনি, উপরন্তু নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির জন্য মানবিক করিডরের (সরকারি ভাষ্যে মানবিক চ্যানেল) চিন্তা এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার কাজ বিদেশি সংস্থাকে দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা পরিস্থিতি জটিল করেছে। এটিকে অনেক রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে ভাবছে।
৬.
জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থান কেবল শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়নি, বরং রাষ্ট্রকাঠামোর গভীরে জমে থাকা সংকটকে উন্মোচিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভ্যুত্থান কি ইতিহাসে একটি ‘অপূর্ণ’ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটি ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি হবে?
রহমান ও সুলতানা (২০২৪) এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন, ‘Movements fail not just because of external repression, but due to internal contradictions.’
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন যে আন্তরিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। তবে আশার দিকও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নবীন নেতৃত্ব, বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও স্থানীয় পর্যায়ে গণসংগঠন গঠনের প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিকল্প পাঠচক্রের মাধ্যমে তারা নতুন বয়ান তৈরির আবহ সৃষ্টি করছে।
৭.
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরি করা, যা ‘জাতীয় সনদ’ হবে বলে উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইউনূস সরকার একে সময়োচিত ও সংকট উত্তরণে অপরিহার্য বলে দাবি করলেও জাতীয় সনদ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।
৮.
জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আন্তোনিও গ্রামসির ‘সংকট তত্ত্ব’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকটের সময়ে পুরনো গঠন মরে যায়, কিন্তু নতুনটি জন্মাতে না পারলে ‘নেতৃত্বশূন্যতা’ জন্ম নেয়। বাংলাদেশ আজ সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
সর্বশেষ বলা যায়, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, সুধী মুরব্বিরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক শক্তি যদি সঠিক আত্মসমালোচনার সাহস দেখায়, বর্তমান নেতৃত্বকে জবাবদিহির কাঠামোয় আনে এবং আদর্শিক স্পষ্টতা বজায় রাখতে পারে, তবে এখনো একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্য রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা অটুট রয়েছে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম
প্রেস ক্লাব, সাবেক সভাপতি, সিইউজে