ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

তুরস্ক কি ন্যাটো ত্যাগ করতে যাচ্ছে

  • গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
তুরস্ক কি ন্যাটো ত্যাগ করতে যাচ্ছে

এখনো সব কিছু চূড়ান্ত না হলেও তুরস্কে প্রবল জনমত তৈরি হয়েছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ত্যাগ করার ব্যাপারে। রাজনৈতিক নেতাদের কথায়ও তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি প্রায় সব মহলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যেও তেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

এরদোয়ান মনে করেন, ন্যাটো মূলত একটি সামরিক জোট, কোনো রাজনৈতিক জোট নয়। তা সত্ত্বেও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা ইসরায়েলপ্রীতি ও তার প্রতি অন্ধ সমর্থন গণতান্ত্রিক বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। এই বিষয়টি শুধু এখানেই থেমে নেই। পশ্চিমা সামরিক জোটের নেতৃত্বের আসনে বসা বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের সমর্থনের ব্যাপারে ন্যাটোর অন্য সদস্যদেরও বাধ্য করছে।
তা ছাড়া বিশ্বের অন্য শক্তিশালী দেশগুলোর ওপরও চাপিয়ে দিচ্ছে নিজের সাম্রাজ্যবাদী সিদ্ধান্ত। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল ন্যাটোর সদস্য নয়।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত একটি রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে ১০০ বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ বিশ্বের মোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারেনি।
ইসরায়েলের তুরস্ক কি ন্যাটো ত্যাগ করতে যাচ্ছে প্রতি নিজের পক্ষপাতিত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরপেক্ষতার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ফিলিস্তিনসহ আরববিশ্ব, বিশেষ করে সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত, কাতার, মিসর ও জর্দান কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈরী ছিল না। এ ক্ষেত্রে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার অবস্থান রাজনৈতিক দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতর হলেও প্রথমোক্তদের ভূমিকা কিংবা সম্পৃক্ততা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। পরাশক্তিগতভাবে অতীতে সোভিয়েতবলয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় সারির দেশগুলোর ঘনিষ্ঠতা কিংবা সম্পৃক্ততা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যাওয়া এবং চলমান ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসান হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করে।
একানব্বই-পরবর্তী ক্ষমতার এককেন্দ্রিক বিশ্বে অতীতের সব হিসাব-নিকাশ দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন নীতি ও কর্মকাণ্ডের কারণে তিন দশকেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্ব আবার একটি বহুকেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় গড়ে তোলার আবশ্যকতা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করতে শুরু করে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরববেষ্টিত ভূখণ্ডে ইসরায়েল নামক একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং তা থেকে উদ্ভূত ফিলিস্তিন সমস্যার কারণে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিশ্ব ক্রমেই দুটি শিবির কিংবা কারো কারো মতে বহু শিবিরে বিভক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নীতি ও আদর্শ ভুলে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানিসম্পদের ওপর কর্তৃত্ব ও বাজার দখলের প্রচেষ্টা যতই জোরদার করতে শুরু করে, মধ্যপ্রাচ্যও ততটাই বিভক্তির দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সৃষ্ট ইহুদিবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্র সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করে এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে তাদের অবৈধ দখল ও সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপের পরিমাণ সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের একতরফা সমর্থনের কারণে ইসরায়েল সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখলে তৎপর হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূখণ্ড ও অনারব ইরান ও তুরস্ককে সামরিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে, তার ফলে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। এ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সূচনা থেকেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ইরান। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার কারণে তুরস্ক কৌশলগত কারণে বলকান অঞ্চল ও আইএসবিরোধী অভিযান কিংবা আফগানিস্তানে পরিচালিত সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলেও তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল। সে ক্ষেত্রে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত তুরস্কের নিরাপত্তা-স্বার্থবিরোধী ভূমিকা এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের পর্যায়ক্রমিক সামরিক অভিযান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন করে তোলে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক বারবার তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন চলমান ইস্যুতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং হুঁশিয়ার করেছেন, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যথারীতি তার ইসরায়েলপ্রীতি ও দৃশ্যত মুসলিমবিরোধী ভূমিকা এবং কার্যক্রমকে অব্যাহত রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি ও সিদ্ধান্ত পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর বারবার চাপিয়ে দিয়েছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্য এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে চলমান ঘটনাগুলোর মূল উদ্দেশ্য এখন অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, জঙ্গিবিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করা নতুন নয়। ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বরাবরই জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে সোচ্চার প্রতিবাদ করে এসেছে তুরস্ক, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। এর আগে ২০১০ সালের ৩১ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে ছয়টি জাহাজের একটি বহর ১০ হাজার টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার দিকে যাচ্ছিল। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাতে আক্রমণ চালায় এবং সেই আক্রমণে তুরস্কের ৯ জন ত্রাণকর্মী প্রাণ হারান। এই বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তুরস্ক ক্ষতিপূরণ দাবি করে, কিন্তু আজও তার কোনো প্রতিকার হয়নি। গাজা যুদ্ধ নামে একের পর এক গাজা ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলিরা। তথাকথিত গাজা যুদ্ধে একমাত্র ২০১৪ সালেই ইসরায়েলি আক্রমণে নিহত হয়েছে দুই হাজার পাঁচ শর বেশি নিরীহ-নিরস্ত্র নাগরিক। এরই ধারাবাহিকতায় গাজায় চলতি বছর ইসরায়েলি আক্রমণে নিহত হয়েছে ১৭ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু। যুক্তরাষ্ট্র তার তাঁবেদার রাষ্ট্র ইসরায়েলের এই চলমান বর্বরতায় এখনো নিশ্চুপ। স্থায়ী যুদ্ধবিরতির কথা বলছে না যুক্তরাষ্ট্র, বরং জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে চলেছে। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণ, ফিলিস্তিনিদের হত্যা কিংবা চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি মুখে এই চলমান বিবাদের একটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বললেও বাস্তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বরং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো সদস্যদের ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই নারকীয় পরিস্থিতির অবসান চান। তিনি দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার একটি আশু সমাধান দাবি করেছেন। একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি দাবি করে এরদোয়ান গাজায় দ্রুত পর্যাপ্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, ইসরায়েল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তা ছাড়া হামাস সদস্যরা সন্ত্রাসী নয়, তারা মুক্তিযোদ্ধা। ফিলিস্তিন চলমান অবরোধ, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অন্যায় থেকে মুক্তি চায়। দীর্ঘ ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনজুড়ে চলেছে ইসরায়েলের এই তাণ্ডব, যার নজির ইতিহাসে নেই।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পশ্চিমা শক্তির ক্রমাগত দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি এবং সুবিধাবাদী আচরণের প্রতিবাদেই মূলত ন্যাটো ত্যাগের কথা ভাবছেন। আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদী ইসরায়েলকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ইসরায়েলের আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে চীন, রাশিয়া, ইরানসহ সব দেশ ও সব মুক্তিকামী মানুষের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এও ঘোষণা করেছেন যে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেওয়া হলে তিনি (তুরস্ক) সেই রাষ্ট্রের ‘গ্যারান্টর’ হতেও প্রস্তুত রয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, মুক্ত এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে মধ্যস্থতা করার জন্য তাঁর প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করার পরও যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। তবে এগিয়ে এসেছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন। কিন্তু এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। সেসব কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এরদোয়ান। তাঁর কাছে ন্যাটোর সদস্য পদ পশ্চিমা তাঁবেদারি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যেতে চান। ইসরায়েলসহ সমগ্র ফিলিস্তিন একদিন তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সেখানে তখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমরা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বাস করেছে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এসে বিশ্বে বিভিন্ন পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বহুমুখী পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মুখে পতন ঘটেছিল ৬০০ বছরের বেশি সময়ব্যাপী রাজত্ব করা উসমানীয় সাম্রাজ্যের।
চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এসে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের ১০০ বছর পূর্তি হলো। আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক উৎসবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, বিগত ১০০ বছর ছিল তুরস্কের পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের কাল। আর আগামী ১০০ বছর হবে তুরস্কের সমৃদ্ধি ও নতুন ইতিহাস রচনার সময়। তুরস্ক জ্ঞান-বিজ্ঞান, কৃষি-শিল্প ও সামরিক প্রযুক্তিতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এরদোয়ান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তুরস্ক আর কারো কাছে মাথা নত করবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে তুরস্ক। আবার ফিরে আসবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সেই আলোকোজ্জ্বল সময়, যখন তুরস্ক বিশ্বকে সমৃদ্ধি অর্জনের নতুন পথ দেখাবে। এর আগে তুরস্ককে যাবতীয় তাঁবেদারি থেকে মুক্ত হতে হবে। বন্ধন ছিন্ন করতে হবে সব অপশক্তি ও চক্রান্তকারীর সঙ্গে। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা এরদোয়ানের একটি বহুদিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি এখন চীন, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব, মিসর ও জর্দানের সঙ্গে একযোগে কাজ করছেন। ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে প্রয়োজন হলে তিনি যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও পিছপা হবেন না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

    ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
শেয়ার
বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যু। দীর্ঘদিন ধরে ঘটছে এমন ঘটনা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এ দায় কার? বিদ্যুৎ বিভাগ অবশ্য নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য আবরণযুক্ত তার ব্যবহার করছে। বন্যপ্রাণীর মৃত্যু।

নানাভাবেই এর মৃত্যু ঘটছে। দিন দিন বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় একটি প্রাণীর মৃত্যুও এখন ভাবিয়ে তোলে পরিবেশবিদদের। বিষয়টি আরো বড় হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।

২০২১ সালে একটি পত্রিকায় খবর এসেছিল, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, পাকা ধান রক্ষা করার জন্য ধানক্ষেতে অবৈধভাবে বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এটি বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখার কারণে ঘটেছে। এতে যে হাতি মারা গিয়েছিল, তার বয়স ছিল প্রায় ৫০ বছর। মা হাতি।
হাতিটির শুঁড়ের নিচে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও দেখা গিয়েছিল। 

২০২২ সাল। একটি পত্রিকায় খবর আসে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত বনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বানর ও চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটে। বনের ভেতরে রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। এই লাইনে জড়িয়ে অনেক বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটে।

এখানকার ঘটনাটি ছিল ভিন্ন। বনের ভেতর অবৈধভাবে সহস্রাধিক মানুষ বসবাস করছিল। তারা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে বনের ভেতরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০০ পরিবারকে বিদ্যুত্সংযোগও দেওয়া হয়। এর ফলে শুধু বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটেনি, স্থানীয় বন্যপ্রাণীরা বিভিন্নভাবে হুমকির মুখে পড়েছিল।

২০২২ সালেরই মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ঘটনা এটি। ওই বছর মার্চের ১৩ তারিখে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে গত দুই সপ্তাহেই সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারটি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটেছে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমানসহ ৯টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্টের কাছে একটি লজ্জাবতী বানর মারা যায় বিদ্যুতায়িত হয়ে। একই বছরের ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের কাছে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনায় সেখানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে খোলা তারের পরিবর্তে আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপনের চিঠি দেয়।

একটি পত্রিকার তথ্য মতে, মৌলভীবাজারের পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১১টি প্রাণী মারা গেছে। চারটি লজ্জাবতী বানর মৃত পাওয়া যায় জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলায়, তিনটি চশমাপরা বানরও মৃত পাওয়া যায় সেখানে। এ ছাড়া বড়লেখা রেঞ্জের মাধবকুণ্ড ইকোপার্কেও চারটি লজ্জাবতী বানর মারা যায়। এসব ক্ষেত্রেও আবরণহীন বৈদ্যুতিক তারের কারণে এমন ঘটছে বলে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দাবি করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দায় এড়াতে কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়েছে। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, বনের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বৈদ্যুতিক তারের কোনো আবরণ নেই। 

এভাবে বিদ্যুতায়িত হয়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ভারতেও ঘটে। সেখানকার ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ২২টি। ২০২০ সালে একইভাবে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ১০টি এবং ২০২১ সালে ১৬টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এভাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আমরাও প্রয়োগ করতে পারি। তারা বন্যপ্রাণী চিকিৎসা পরিকাঠামো গঠন করেছে। উদ্ধার হওয়া বন্যপ্রাণীদের জন্য বিশেষ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বৈদ্যুতিক তারগুলো ভূমি থেকে বিশেষ উচ্চতায় স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে।

প্রতিটি বন্যপ্রাণীই আমাদের দেশের জন্য একেকটি সম্পদ। এসব সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার-আপনার সবার। এ ক্ষেত্রে কেউই আমাদের দায় এড়াতে পারি না। তা বন বিভাগই হোক বা বিদ্যুৎ বিভাগ হোক বা হোক স্থানীয় জনগণ। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এসব বন্যপ্রাণীকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক   

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

নেতার নাম নেতানিয়াহু

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
নেতার নাম নেতানিয়াহু

আমাদের শৈশবে (উনিশ শ পঞ্চাশের দশক) যেসব বিশ্বনেতার নাম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছি, জার্মানির একনায়ক অ্যাডল্ফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে। তাঁর মতো আর কেউ বোধ করি মানবজাতির ইতিহাসে এত ধ্বংস ও অকল্যাণের জন্ম দেয়নি। ইহুদিদের প্রতি ছিল তাঁর এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। তিনি মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) জার্মানরা ইহুদিদের কারণেই পরাজয় বরণ করেছিল।

একই ভূমিকায় মুসলিম নিধনে অবতীর্ণ হয়েছেন হাল আমলের হিটলার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই ভদ্রলোক (?) বোধ হয় রোজ কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হত্যার সংবাদ না পেলে পানিটুকুও পান করেন না! বিশেষ করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনের গাজা নামক মুসলিম জনপদে অসহায় নারী ও শিশুদের মৃত্যুবরণ তাঁকে বোধ হয় এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দান করে। তাঁর এই চরম মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর মর্মমূলে আঘাত হানছে। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা এক শ ভাগ আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।

ফলে এ কথা এখন মোটামুটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ইসরায়েলকে এই অঘোষিত যুদ্ধে শিখণ্ডী বানিয়ে পেছন থেকে ঘুঁটি চালাচ্ছে বিগ ব্রাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র না হয় বোধগম্য কারণে ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত বড় যে মুসলিম বিশ্ব তার ভূমিকা কী? তার সদস্যরা কি কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন? তাঁদের সংগঠন ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব মুসলিম কনফারেন্স) কি অদ্যাবধি ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, যা দেখে ইসরায়েল তার হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে? উত্তর নিশ্চয়ই না। অথচ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই মুসলিম দেশ। তাদের এক ভ্রুকুটিতে ইসরায়েলের ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা।

আফসোস! এই যে প্রতিনিয়ত গাজা উপত্যকায় শত শত অসহায় মানুষ, যাদের মধ্যে অসহায় নারী-শিশু ও হাসপাতালের শয্যায় শায়িত মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়ঘাতক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছে, তাদের করুণ আর্তি কি প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের ও তাদের শাসককুলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না? খাদ্যাভাবে মরণোন্মুখ শিশুদের জন্য প্রেরিত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি ঘাতকরাএই দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ কাঁদে, কাঁদে না শুধু ওআইসির নেতাদের। তাহলে লোকে যে বলে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব দেশ, সব মানুষ যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হিসাব কষতে শুরু করে নিজের লাভক্ষতিরএটাই কি তবে সত্যি? ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলকে ধমক দিতে গেলে বড় মিয়া নাখোশ হয়ে পাল্টা ধমক দেবেনএই ভয়ে এবং নানা রকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দিতে পারেন এমন আশঙ্কার কথা ভেবে মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো মনে হয় চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা নীতি অনুসরণ করছে। আর তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের মতো জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে না। ফলে অবস্থানটা কী দাঁড়াল? তুমুল বোমাবৃষ্টির মধ্যে ফিলিস্তিন তুমি জনহীন প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকো, বজ্রাঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও তুমি, স্যরি, আমরা কেউ তোমার মাথার ওপর ছাতা ধরতে আসতে পারছি না, সরিয়ে নিতে পারছি না তোমাকে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-rb-1a.jpgএই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের অন্দরমহলে একটু ঢু মারার চেষ্টা করা যাক।

সেখানে কি ইসরায়েলিরা তাদের বহুল আলোচিত নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে খুশির চোটে কাঁধে তুলে অহোরাত্র নৃত্য করছে আর স্লোগানে স্লোগানে দশ দিগন্ত প্রকম্পিত করছে : নেতা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে। দুঃখিত, না, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। পত্রপত্রিকায় যা দেখা যায়, তাতে মনে হয় ইসরায়েলিরা বরং নেতাজি নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে রীতিমতো তিতিবিরক্ত। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে তারা বেশি আগ্রহী তাদের ভাই-বেরাদর যারা ফিলিস্তিনিদের হাতে বন্দি হয়ে আছে, তাদের ফেরত পেতে, যদিও তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। এ নিয়ে তারা রাজধানী তেল আবিব ও অন্য শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। নেতাজি নাকি নিজভূমের জনগণের কাছে দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন। কী কপাল! বেচারা নিজের শক্তিমত্তা জাহির করার জন্য সেদিন বেমক্কা আক্রমণ করে বসলেন ইরান, কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল শূন্য। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ইরানিরা ফিলিস্তিনিদের মতো অসহায় এতিম। কিন্তু তাঁর হিসাবে যে দারুণ ভুল ছিল, তা হয়তো তিনি টের পেলেন সপ্তাহ দুয়েকের যুদ্ধে ইরানিদের হাতে দারুণ মার খেয়ে, যদিও বিশ্ববাসীকে তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি নাকি যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তাঁর মতো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। (পাদটীকা : বাংলাদেশের গত প্রায় দেড় যুগের দৃশ্যপট।)

নেতানিয়াহু যে কেবল একজন হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতা তা-ই নয়, তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর একজন, যিনি দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আসামির কাঠগড়ায় নিয়মিত দাঁড়াচ্ছেন। বিজ্ঞজনদের অভিমত, নিজ দেশের মানুষের দৃষ্টি তাঁর পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি থেকে অন্যদিকে ফেরানোর মতলবেই তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সে যা-ই হোক, তিনি দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানান আর পর্বত বানান, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, আমাদের প্রাণ কাঁদে ওই সব মৃত্যুপথযাত্রী ক্ষুিপপাসায় কাতর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জন্য, বিশেষ করে কুসুমকলি অবুঝ শিশুদের জন্য, যাদের উদ্দেশে প্রেরিত ত্রাণটুকুও ইসরায়েলি পাশব বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে যেতে দেয় না। হায়! একদিকে গাজায় হয় বোমার আঘাতে, না হয় খাদ্যাভাবে প্রতিদিন অকালে ঝরে পড়ছে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু আর অন্যদিকে এই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো শান্তির ললিত বাণী গেয়ে শোনায় বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত।...ঠাট্টা আর কাকে বলে!

ভালো কথা, শেষ করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে দেখে নিই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের এই দেশের। এ দেশের মানুষ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশে অন্যায়-অত্যাচার করে কেউই পার পেতে পারেনি। বিশ্বের কোথাও অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ উত্তোলিত হতে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আশ্বর্য, সেই বাংলাদেশ ইসরায়েলের ব্যাপারে কেমন জানি উদাসীন। এই যে প্রতিনিয়ত শত শত অবোধ শিশু ও অসহায় নারী-পুরুষ বলি হচ্ছে ইসরায়েলি যূপকাষ্ঠে, তারা মুসলমান না ইহুদি, খ্রিস্টান না হিন্দু, আস্তিক না নাস্তিক, সেটা বড় কথা নয়, তাদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তারা মানুষ। তারা অসহায় নিরপরাধ মানুষ। এই পৃথিবীতে আপনার, আমার এবং ওই নরখাদক নেতানিয়াহুর যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তাদেরও আছে সেই সমান অধিকার। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে সদা সোচ্চার বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে এই নির্লিপ্ত আচরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। ইসরায়েলের, বিশেষ করে তার খুনি নেতা নেতানিয়াহুর, এই নরমেধযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও তেমন সোচ্চার হতে দেখি না। কেসটা কী? তাহলে এখানেও কি সেই বড় মিয়া ফ্যাক্টর কাজ করছে? কী জানি! বলতেই হয়, বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি!

অগত্যা অগতির গতি দয়ামত আল্লাহপাকের দরবারে অসহায় ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে শেষ করছি। আমিন। সুম্মা আমিন। সুধী পাঠক-পাঠিকা, আশা করি, আপনারাও নিশ্চয়ই এই প্রার্থনায় শরিক হবেন। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব ও কবি

mkarim06@yahoo.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

    ড. জাহাঙ্গীর আলম
শেয়ার
স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

আম, লিচু, আনারস ও কলা প্রচুর পরিমাণে বাজারজাতকরণ হচ্ছে। কাঁঠালও প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করেছে বাজারে। কৃষি অর্থনীতিতে এই ফলগুলোর গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গরমে অতিষ্ঠ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মনে এ সময় শান্তির পরশ বোলায় বিভিন্ন রসালো ফলের বিপুল জোগান।

জ্যৈষ্ঠ মাসে সুস্বাদু ফলের সরবরাহ থাকায় একে অনেকেই বলে মধুমাস। আভিধানিক অর্থে মধুমাস হলো চৈত্র মাস। কবিগুরু তাঁর ১৩০৪ বাংলা সনে লেখা গানে চৈত্র নিশীথশশী এবং উন্মাদ মধুনিশি অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। তবে ব্যবহারের আধুনিকতা ও জনপ্রিয়তায় এখন মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠকেই নির্দেশ করে।
জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আসে আষাঢ়। পরে শ্রাবণ। তখনো থাকে রকমারি ফলের প্রাচুর্য। বিভিন্ন দেশীয় ফল আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার বড় অংশ।

এ দেশে ফলের উৎপাদন হয় প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টন। এর ৫০ শতাংশই উৎপাদিত হয় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ৯ মাসে। কয়েকটি ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০ বছর ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১২.৫ শতাংশ।

দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। এতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। তবু ঘাটতি আছে ফলের। এ দেশে মোট ৭২ জাতের ফল সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয়। এর মধ্যে ৯টি প্রধান এবং ৬৩টি অপ্রধান। প্রধান ফলগুলোর মধ্যে রয়েছেআম, কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, নারকেল, কুল ও লিচু। এগুলো মোট ফল এলাকার প্রায় শতকরা ৭৯ ভাগ জমি দখল করে রয়েছে। অবশিষ্ট শতকরা ২১ ভাগ জমিতে অপ্রধান ফলগুলোর চাষ। অপ্রধান ফলগুলোর মধ্যে যেগুলো সচরাচর দৃশ্যমান, সেগুলো হলো সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবি লেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, খেজুর, তাল, তেঁতুল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙ্গি, তরমুজ ইত্যাদি। বাকি ফলগুলো খুবই কম চাষ হয়, যেগুলো আমরা অনেকে চিনি আবার অনেকেই চিনি না। এগুলোর মধ্যে আছে অরবরই, গাব, বিলেতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈ কর, চালতা, ডুমুর, পানিফল, মাখনা, বকুল, লুকলুকি, ডেউয়া, করমচা, কাঠবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, মনফল ইত্যাদি। ইদানীং কিছু নতুন ফলের আবাদও হচ্ছে। এর মধ্যে রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো ও মালটা অন্যতম। এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসছে। কিছুদিন আগেও প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের দাম ছিল ৬০০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফল আমদানির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ নাশপাতি, আপেল ও আঙুর কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে আম, লিচু, পেয়ারা ও বরই বেশি করে কিনে নিচ্ছে। ভোক্তারা মনে করে, দেশি ফল কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত। দামেও সস্তা। তাই পারিবারিক চাহিদা পূরণে এবং মেহমান আপ্যায়নে ফলই প্রধান ভরসা।

বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আম। ১৫ মে থেকে শুরু হয়েছে আম পাড়া। প্রথমেই গুটি, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, মিশ্রিভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া ইত্যাদি আগাম জাতের আম পেড়ে নেওয়া হয়। এরপর বাজারে আসে হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও ফজলি আম সামনে বাজারে আসছে। বারি আম-৪, আশ্বিনা ও গৌরমতি আসবে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। কাটিমন ও বারি ১১ জাতের আম সরবরাহ হয় বছরব্যাপী। ক্ষীরশাপাতি আম বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই আম শ্বাস ও আঁশবিহীন, রসালো। গন্ধে বেশ আকর্ষণীয় এবং স্বাদে মিষ্টি। হাঁড়িভাঙ্গা আমও অত্যন্ত সুস্বাদু ও আঁশবিহীন। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্যান্য আমের মধ্যে আছে ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ফজলি ও নাক ফজলি। এগুলোর বিশেষত্ব আলাদা। আগে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরেই ভালো জাত ও মানের আম হতো বেশি। এখন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেশেই ভালো জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দুই বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে। গত বছর আম রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩২১ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের মাত্র ০.০৫৫ শতাংশ। এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার টন। বিশ্বে আম রপ্তানি হয় প্রায় এক বিলিয়ন মেট্রিক টন। এতে বাংলাদেশের শরিকানা ১.৫ শতাংশ। বৈশ্বিক আমের বাজারের আকার প্রায় ৬৭.৪ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশের হিস্যা অনুল্লেখযোগ্য।

মোট উৎপাদনের দিক থেকে আমের পর কাঁঠালের অবস্থান। উৎপাদন প্রায় ২০ লাখ টন। আরো আছে কলা, যার উৎপাদন প্রায় ১৯ লাখ টন। পেঁপে, পেয়ারা ও আনারসের উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় ১১ লাখ, পাঁচ লাখ ও ছয় লাখ টন। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় এবং আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছি। স্বাদে ও জনপ্রিয়তায় আমাদের দেশে লিচুর অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মোট উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। তবে আম সবার প্রিয় ও সুস্বাদু। এবার আমের উৎপাদন ভালো। লক্ষ্যমাত্রা ২৭ লাখ টন।

আম উৎপাদনকারীরা এখন খুবই দুশ্চিন্তায়। উৎপাদিত ফল উপযুক্ত দামে বিক্রি করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, বাগানের খরচ উঠে আসবে কি নাএসবই দুশ্চিন্তার কারণ। মৌসুমি ফল পাকা ও পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করতে হয়। নতুবা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সাধারণত মৌসুমি ফল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অপচয় হয়। অনেক সময় বাজারজাতকরণের ধীরগতির কারণে তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের বর্তমান ভরা মৌসুমে আমাদের কৃষি বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে খামারপ্রান্ত থেকে আম, কাঁঠাল ও আনারস কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে তা বাজারজাত করা যেতে পারে। গরিব মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসেবেও আম-কাঁঠাল বিতরণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল ও আনারস পরিবহনের জন্য বিআরটিসির উদ্যোগে ট্রাক চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ইদানীং অনলাইনেও ফল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের গাফিলতির জন্য তা সুনাম হারাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সড়কপথে বাধাহীন ফল পরিবহনকে উৎসাহিত করা উচিত। তদুপরি আম ও অন্যান্য মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত বৃহৎ কম্পানিগুলো এ সময় তাদের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়ে ফলের দরপতন ও অপচয় থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে পারে। তা ছাড়া দেশের ফল চাষিদের সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ফল রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমাদের মৌসুমি ফল এরই মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি করা ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জড়ালেবু, এলাচি লেবু, কুল, সাতকরা, আমড়া, সুপারি, জলপাই, পেয়ারা ও কলা। বিদেশে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি ফল রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সাত বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের আম রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহী ও সাতক্ষীরার চাষিরা অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং উত্তম কৃষি কার্যক্রম অনুসরণ করে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করছেন। এর উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য বেশি। দেশের সুপারমার্কেটগুলো উন্নতমানের আম বাজারজাতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির আয় হ্রাস পেয়েছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি প্রণোদনা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করায় সম্প্রতি ফল রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়নি। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশি ফলের আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বগামী হবে বলে আশা করা যায়।

 

এখন একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আম কূটনীতি। গত বছর জুন মাসে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের রাজশাহীর কিছু আমবাগান পরিদর্শন করানো হয়েছে। এতে তাঁরা বাংলাদেশের আম উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। উৎপাদন এলাকায় গিয়ে আমের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছেন। এরপর চীনসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এবার চীন থেকে ৫০ হাজার টন আম নেওয়ার কার্যাদেশ এসেছে। অন্যান্য দেশও আমদানির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া অতীতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে পাকা আম। এতে আমাদের আম রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে কর্মরত। আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই রেমিট্যান্স হিসেবে আসে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ওই সব দেশে আমাদের আম উপহার ভ্রাতৃত্ব ও আত্মার সম্পর্ক জোরদার করবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের আম কূটনীতি আরো জোরদার ও অর্থবহ হোক, এই কামনা সবার।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ

সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য

ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ