ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

স্মার্ট বাংলাদেশ কী এবং কিভাবে অর্জিত হতে পারে

  • নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
স্মার্ট বাংলাদেশ কী এবং কিভাবে অর্জিত হতে পারে

ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। কেননা উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তো এরই মধ্যে স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও স্মার্ট দেশে রূপান্তরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই দেশের উন্নতি এবং অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে দেশকে অনেকটাই উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে।

ভবিষ্যতে যেসব দেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকবে তারাই ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের মতোই আজ থেকে দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশের শতভাগ সফলতা এখনো অর্জিত হতে পারেনি, কিন্তু যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তাতেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারি বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও যে কম ক্ষয়ক্ষতি মেনে সুন্দরভাবে সামাল দিতে পেরেছে তার অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল।

ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, দেশের সব কিছু উন্নত বিশ্বের মতো প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা, যাকে এককথায় ডিজিটালাইজেশন বলা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিনির্ভর ডকুমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। একসময় আমাদের দেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা অনেক দেশেই কম ছিল। সেই পাসপোর্ট যখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে রূপান্তর করা হলো তখন এর গ্রহণযোগ্যতাও অনেক গুণ বেড়ে গেল।

ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) চালু করেছে। যেহেতু এনআইডি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর একটি ডকুমেন্ট, তাই এর গ্রহণযোগ্যতা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বাইরেও অনেক বেশি। কিছুদিন আগে এখানকার সরকারি অফিস থেকে আমার কাছে এনআইডির কপি চেয়ে বসেছিল এবং সেই কপি জমা দেওয়ার কারণে আমাকে অনেক আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দিতে হয়নি, অথচ এরাই আগে আমাদের দেশের কোনো কাগজপত্রই খুব সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না। এখানেই ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং সুবিধা। আবার বর্তমান যুগে সব কিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর না করতে পারলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয় তার বড় উদাহরণ আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত।
দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা হলেও আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত সেভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে একেক ব্যাংক একেক রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করছে ঠিকই, কিন্তু তাতে প্রকৃত ডিজিটাল ব্যাংকিং থেকে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক দূরে। আজ বিশ্বের নামকরা সব ব্যাংক যে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করছে তার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের ব্যাংকগুলোর পিছিয়ে থাকা।

ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক উন্নত হতে হবে এবং সেই উদ্যোগ সফল করতে হলে স্মার্ট বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী এক কর্মপরিকল্পনা। অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন যে দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ নামের স্লোগানের কী প্রয়োজন। প্রয়োজন অবশ্যই আছে। স্মার্ট বাংলাদেশ তো শুধু একটি স্লোগান নয়। আগামী দুই যুগ ধরে চলবে এমন এক বিশাল কর্মযজ্ঞের নাম স্মার্ট বাংলাদেশ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে সাধারণ মানুষ কী বুঝবে এবং এটি অর্জিতই বা হবে কিভাবে। এই নতুন কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে মাত্র। ফলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সরকার যখন স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরে কোনো পুস্তিকা বা প্রকাশনা বের করবে, তখনই হয়তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তবে প্রধানমন্ত্রী যে অনুষ্ঠানে স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি মূলভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এগুলো হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। বর্তমান সরকার তাদের ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে এবং এই কর্মসূচির অংশ হিসেবেই স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে সরকারপ্রধান স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে যে চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে দেশের এই চারটি খাতকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট খাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

এ কথা সত্যি যে স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ এই নয় যে স্মার্টফোন হাতে স্মার্টলি ঘুরে বেড়ানো বা সব সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা খুশি তাই মন্তব্য করা। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ দেশের যে অঞ্চলেই বসবাস করুক না কেন, সে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমতার ভিত্তিতে পেতে পারবে। তখন শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে জীবনযাপন এবং সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। ঢাকা শহরের নাগরিক যেমন ঘরে বসেই সব কিছু করতে পারবে, তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও তাই করতে পারবে। যেমনপ্রত্যন্ত গ্রামের একজন নাগরিককে তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কোনো অবস্থায়ই অন্য কারো দারস্থ হতে হবে না। সে তার গ্রামে বসেই আবেদন করবে, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আবেদনকারীর নতুন পাসপোর্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে তার কাছে পৌঁছে যাবে। এখানে ডাক বিভাগের ডেলিভারিম্যান ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির ভূমিকা রাখার প্রয়োজন হবে না। তেমনি আয়কর রিটার্ন দাখিলব্যবস্থা এমন হবে যে মানুষ তার এলাকায় বসে নিজেই রিটার্ন জমা দেবে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যায়িত হয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমেই অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ করদাতার কাছে পৌঁছে যাবে। আয়কর কর্মকর্তার তেমন কোনো ভূমিকার প্রয়োজন এখানে হবে না। তাঁরা অবশ্য স্পষ্টই বুঝতে পারবেন যে কারা আয়কর রিটার্ন জমা দেয়নি। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশেও গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ চাইলেও কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না, কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা একেবারে শুরুতেই আটকে যায়। কিন্তু সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশে খুব সহজেই এটি সম্ভব হবে, যেমনটা উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে। কেননা এসব দেশ সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেই তো আর স্মার্ট বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটবে না। এটি হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যেখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের এবং উপযুক্ত লোকবল নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে থাকা চাই সঠিক এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোনো কমতি থাকবে না। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত থাকবেন তাঁদের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং মুনশিয়ানার ওপরই নির্ভর করবে ২০৪১ সাল নাগাদ সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ হবে, নাকি না সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর, না ম্যানুয়াল পদ্ধতির এক এলোমেলো স্মার্ট বাংলদেশ হবে, যেমনটা হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে। দেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক দূর এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তা থেকে দেশ এখনো অনেক দূরে। তাই সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপূর্ণতা দিতে হবে সবার আগে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হবে।

অনেকে ভাবতে পারেন যে ২০৪১ সাল অনেক দেরি আছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে প্রকৃত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য আগামী দুই দশক মোটেও কোনো দীর্ঘ সময় নয়, কেননা এ জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছরব্যাপী এক মহাকর্মপরিকল্পনা। প্রযুক্তিনির্ভর সফল ব্যবস্থা, তা সে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশই হোক, তা নির্মাণের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্ভুল ডাটাবেইস। ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশের সব বিষয়ের নির্ভুল ডাটাবেইস তৈরি করতেই লেগে যাবে প্রায় ১০ বছর, তা-ও যদি পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ করা হয়। এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এটি করতে হবে নিখুঁতভাবে, সবার আগে। নির্ভুল ডাটাবেইস নিশ্চিত না করায় ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কী অবস্থায় এসেছে তা অনেকেই খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছেন। তাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে না হয় সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। নির্ভুল এবং পরিপূর্ণ ডাটাবেইস নির্মাণের পর কমপক্ষে পাঁচ বছর লেগে যাবে প্রয়োজনীয় সব ইন্টিগ্রেটেড এবং কমপ্রিহেনসিভ সফটওয়্যার তৈরি করতে। অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে ডাটাবেইস তৈরি এবং সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ পাশাপাশি চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সেটা করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ ডাটাবেইসের ধরনের ওপর ভিত্তি করেই মানসম্পন্ন সফটওয়্যার নির্মাণ করা হয়। এরপর সেই সফটওয়্যারের ভুল সংশোধন, প্রয়োগ এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এর পরিপূর্ণতা দিতে গেলে আরো পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যাবে। এ কারণেই আগামী ২৫ বছরের মতো সময় লেগে যাবে সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।

উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি ব্যবহারে আজ যে পর্যায়ে এসেছে তার কাজটা শুরু করেছিল আজ থেকে ৩০ বছর আগে। তার পরও এসব দেশ যে শতভাগ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি। সেই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়েই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। এখন প্রয়োজন এর কাজ শুরু করে এই উদ্যোগকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

Nironjankumar_roy@yahoo.com

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

    ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
শেয়ার
বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যু। দীর্ঘদিন ধরে ঘটছে এমন ঘটনা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এ দায় কার? বিদ্যুৎ বিভাগ অবশ্য নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য আবরণযুক্ত তার ব্যবহার করছে। বন্যপ্রাণীর মৃত্যু।

নানাভাবেই এর মৃত্যু ঘটছে। দিন দিন বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় একটি প্রাণীর মৃত্যুও এখন ভাবিয়ে তোলে পরিবেশবিদদের। বিষয়টি আরো বড় হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।

২০২১ সালে একটি পত্রিকায় খবর এসেছিল, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, পাকা ধান রক্ষা করার জন্য ধানক্ষেতে অবৈধভাবে বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এটি বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখার কারণে ঘটেছে। এতে যে হাতি মারা গিয়েছিল, তার বয়স ছিল প্রায় ৫০ বছর। মা হাতি।
হাতিটির শুঁড়ের নিচে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও দেখা গিয়েছিল। 

২০২২ সাল। একটি পত্রিকায় খবর আসে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত বনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বানর ও চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটে। বনের ভেতরে রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। এই লাইনে জড়িয়ে অনেক বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটে।

এখানকার ঘটনাটি ছিল ভিন্ন। বনের ভেতর অবৈধভাবে সহস্রাধিক মানুষ বসবাস করছিল। তারা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে বনের ভেতরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০০ পরিবারকে বিদ্যুত্সংযোগও দেওয়া হয়। এর ফলে শুধু বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটেনি, স্থানীয় বন্যপ্রাণীরা বিভিন্নভাবে হুমকির মুখে পড়েছিল।

২০২২ সালেরই মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ঘটনা এটি। ওই বছর মার্চের ১৩ তারিখে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে গত দুই সপ্তাহেই সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারটি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটেছে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমানসহ ৯টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্টের কাছে একটি লজ্জাবতী বানর মারা যায় বিদ্যুতায়িত হয়ে। একই বছরের ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের কাছে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনায় সেখানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে খোলা তারের পরিবর্তে আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপনের চিঠি দেয়।

একটি পত্রিকার তথ্য মতে, মৌলভীবাজারের পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১১টি প্রাণী মারা গেছে। চারটি লজ্জাবতী বানর মৃত পাওয়া যায় জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলায়, তিনটি চশমাপরা বানরও মৃত পাওয়া যায় সেখানে। এ ছাড়া বড়লেখা রেঞ্জের মাধবকুণ্ড ইকোপার্কেও চারটি লজ্জাবতী বানর মারা যায়। এসব ক্ষেত্রেও আবরণহীন বৈদ্যুতিক তারের কারণে এমন ঘটছে বলে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দাবি করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দায় এড়াতে কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়েছে। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, বনের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বৈদ্যুতিক তারের কোনো আবরণ নেই। 

এভাবে বিদ্যুতায়িত হয়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ভারতেও ঘটে। সেখানকার ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ২২টি। ২০২০ সালে একইভাবে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ১০টি এবং ২০২১ সালে ১৬টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এভাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আমরাও প্রয়োগ করতে পারি। তারা বন্যপ্রাণী চিকিৎসা পরিকাঠামো গঠন করেছে। উদ্ধার হওয়া বন্যপ্রাণীদের জন্য বিশেষ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বৈদ্যুতিক তারগুলো ভূমি থেকে বিশেষ উচ্চতায় স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে।

প্রতিটি বন্যপ্রাণীই আমাদের দেশের জন্য একেকটি সম্পদ। এসব সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার-আপনার সবার। এ ক্ষেত্রে কেউই আমাদের দায় এড়াতে পারি না। তা বন বিভাগই হোক বা বিদ্যুৎ বিভাগ হোক বা হোক স্থানীয় জনগণ। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এসব বন্যপ্রাণীকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক   

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

নেতার নাম নেতানিয়াহু

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
নেতার নাম নেতানিয়াহু

আমাদের শৈশবে (উনিশ শ পঞ্চাশের দশক) যেসব বিশ্বনেতার নাম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছি, জার্মানির একনায়ক অ্যাডল্ফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে। তাঁর মতো আর কেউ বোধ করি মানবজাতির ইতিহাসে এত ধ্বংস ও অকল্যাণের জন্ম দেয়নি। ইহুদিদের প্রতি ছিল তাঁর এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। তিনি মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) জার্মানরা ইহুদিদের কারণেই পরাজয় বরণ করেছিল।

একই ভূমিকায় মুসলিম নিধনে অবতীর্ণ হয়েছেন হাল আমলের হিটলার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই ভদ্রলোক (?) বোধ হয় রোজ কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হত্যার সংবাদ না পেলে পানিটুকুও পান করেন না! বিশেষ করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনের গাজা নামক মুসলিম জনপদে অসহায় নারী ও শিশুদের মৃত্যুবরণ তাঁকে বোধ হয় এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দান করে। তাঁর এই চরম মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর মর্মমূলে আঘাত হানছে। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা এক শ ভাগ আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।

ফলে এ কথা এখন মোটামুটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ইসরায়েলকে এই অঘোষিত যুদ্ধে শিখণ্ডী বানিয়ে পেছন থেকে ঘুঁটি চালাচ্ছে বিগ ব্রাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র না হয় বোধগম্য কারণে ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত বড় যে মুসলিম বিশ্ব তার ভূমিকা কী? তার সদস্যরা কি কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন? তাঁদের সংগঠন ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব মুসলিম কনফারেন্স) কি অদ্যাবধি ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, যা দেখে ইসরায়েল তার হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে? উত্তর নিশ্চয়ই না। অথচ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই মুসলিম দেশ। তাদের এক ভ্রুকুটিতে ইসরায়েলের ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা।

আফসোস! এই যে প্রতিনিয়ত গাজা উপত্যকায় শত শত অসহায় মানুষ, যাদের মধ্যে অসহায় নারী-শিশু ও হাসপাতালের শয্যায় শায়িত মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়ঘাতক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছে, তাদের করুণ আর্তি কি প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের ও তাদের শাসককুলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না? খাদ্যাভাবে মরণোন্মুখ শিশুদের জন্য প্রেরিত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি ঘাতকরাএই দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ কাঁদে, কাঁদে না শুধু ওআইসির নেতাদের। তাহলে লোকে যে বলে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব দেশ, সব মানুষ যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হিসাব কষতে শুরু করে নিজের লাভক্ষতিরএটাই কি তবে সত্যি? ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলকে ধমক দিতে গেলে বড় মিয়া নাখোশ হয়ে পাল্টা ধমক দেবেনএই ভয়ে এবং নানা রকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দিতে পারেন এমন আশঙ্কার কথা ভেবে মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো মনে হয় চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা নীতি অনুসরণ করছে। আর তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের মতো জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে না। ফলে অবস্থানটা কী দাঁড়াল? তুমুল বোমাবৃষ্টির মধ্যে ফিলিস্তিন তুমি জনহীন প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকো, বজ্রাঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও তুমি, স্যরি, আমরা কেউ তোমার মাথার ওপর ছাতা ধরতে আসতে পারছি না, সরিয়ে নিতে পারছি না তোমাকে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-rb-1a.jpgএই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের অন্দরমহলে একটু ঢু মারার চেষ্টা করা যাক।

সেখানে কি ইসরায়েলিরা তাদের বহুল আলোচিত নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে খুশির চোটে কাঁধে তুলে অহোরাত্র নৃত্য করছে আর স্লোগানে স্লোগানে দশ দিগন্ত প্রকম্পিত করছে : নেতা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে। দুঃখিত, না, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। পত্রপত্রিকায় যা দেখা যায়, তাতে মনে হয় ইসরায়েলিরা বরং নেতাজি নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে রীতিমতো তিতিবিরক্ত। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে তারা বেশি আগ্রহী তাদের ভাই-বেরাদর যারা ফিলিস্তিনিদের হাতে বন্দি হয়ে আছে, তাদের ফেরত পেতে, যদিও তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। এ নিয়ে তারা রাজধানী তেল আবিব ও অন্য শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। নেতাজি নাকি নিজভূমের জনগণের কাছে দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন। কী কপাল! বেচারা নিজের শক্তিমত্তা জাহির করার জন্য সেদিন বেমক্কা আক্রমণ করে বসলেন ইরান, কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল শূন্য। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ইরানিরা ফিলিস্তিনিদের মতো অসহায় এতিম। কিন্তু তাঁর হিসাবে যে দারুণ ভুল ছিল, তা হয়তো তিনি টের পেলেন সপ্তাহ দুয়েকের যুদ্ধে ইরানিদের হাতে দারুণ মার খেয়ে, যদিও বিশ্ববাসীকে তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি নাকি যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তাঁর মতো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। (পাদটীকা : বাংলাদেশের গত প্রায় দেড় যুগের দৃশ্যপট।)

নেতানিয়াহু যে কেবল একজন হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতা তা-ই নয়, তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর একজন, যিনি দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আসামির কাঠগড়ায় নিয়মিত দাঁড়াচ্ছেন। বিজ্ঞজনদের অভিমত, নিজ দেশের মানুষের দৃষ্টি তাঁর পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি থেকে অন্যদিকে ফেরানোর মতলবেই তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সে যা-ই হোক, তিনি দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানান আর পর্বত বানান, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, আমাদের প্রাণ কাঁদে ওই সব মৃত্যুপথযাত্রী ক্ষুিপপাসায় কাতর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জন্য, বিশেষ করে কুসুমকলি অবুঝ শিশুদের জন্য, যাদের উদ্দেশে প্রেরিত ত্রাণটুকুও ইসরায়েলি পাশব বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে যেতে দেয় না। হায়! একদিকে গাজায় হয় বোমার আঘাতে, না হয় খাদ্যাভাবে প্রতিদিন অকালে ঝরে পড়ছে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু আর অন্যদিকে এই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো শান্তির ললিত বাণী গেয়ে শোনায় বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত।...ঠাট্টা আর কাকে বলে!

ভালো কথা, শেষ করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে দেখে নিই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের এই দেশের। এ দেশের মানুষ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশে অন্যায়-অত্যাচার করে কেউই পার পেতে পারেনি। বিশ্বের কোথাও অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ উত্তোলিত হতে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আশ্বর্য, সেই বাংলাদেশ ইসরায়েলের ব্যাপারে কেমন জানি উদাসীন। এই যে প্রতিনিয়ত শত শত অবোধ শিশু ও অসহায় নারী-পুরুষ বলি হচ্ছে ইসরায়েলি যূপকাষ্ঠে, তারা মুসলমান না ইহুদি, খ্রিস্টান না হিন্দু, আস্তিক না নাস্তিক, সেটা বড় কথা নয়, তাদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তারা মানুষ। তারা অসহায় নিরপরাধ মানুষ। এই পৃথিবীতে আপনার, আমার এবং ওই নরখাদক নেতানিয়াহুর যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তাদেরও আছে সেই সমান অধিকার। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে সদা সোচ্চার বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে এই নির্লিপ্ত আচরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। ইসরায়েলের, বিশেষ করে তার খুনি নেতা নেতানিয়াহুর, এই নরমেধযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও তেমন সোচ্চার হতে দেখি না। কেসটা কী? তাহলে এখানেও কি সেই বড় মিয়া ফ্যাক্টর কাজ করছে? কী জানি! বলতেই হয়, বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি!

অগত্যা অগতির গতি দয়ামত আল্লাহপাকের দরবারে অসহায় ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে শেষ করছি। আমিন। সুম্মা আমিন। সুধী পাঠক-পাঠিকা, আশা করি, আপনারাও নিশ্চয়ই এই প্রার্থনায় শরিক হবেন। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব ও কবি

mkarim06@yahoo.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

    ড. জাহাঙ্গীর আলম
শেয়ার
স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

আম, লিচু, আনারস ও কলা প্রচুর পরিমাণে বাজারজাতকরণ হচ্ছে। কাঁঠালও প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করেছে বাজারে। কৃষি অর্থনীতিতে এই ফলগুলোর গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গরমে অতিষ্ঠ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মনে এ সময় শান্তির পরশ বোলায় বিভিন্ন রসালো ফলের বিপুল জোগান।

জ্যৈষ্ঠ মাসে সুস্বাদু ফলের সরবরাহ থাকায় একে অনেকেই বলে মধুমাস। আভিধানিক অর্থে মধুমাস হলো চৈত্র মাস। কবিগুরু তাঁর ১৩০৪ বাংলা সনে লেখা গানে চৈত্র নিশীথশশী এবং উন্মাদ মধুনিশি অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। তবে ব্যবহারের আধুনিকতা ও জনপ্রিয়তায় এখন মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠকেই নির্দেশ করে।
জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আসে আষাঢ়। পরে শ্রাবণ। তখনো থাকে রকমারি ফলের প্রাচুর্য। বিভিন্ন দেশীয় ফল আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার বড় অংশ।

এ দেশে ফলের উৎপাদন হয় প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টন। এর ৫০ শতাংশই উৎপাদিত হয় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ৯ মাসে। কয়েকটি ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০ বছর ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১২.৫ শতাংশ।

দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। এতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। তবু ঘাটতি আছে ফলের। এ দেশে মোট ৭২ জাতের ফল সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয়। এর মধ্যে ৯টি প্রধান এবং ৬৩টি অপ্রধান। প্রধান ফলগুলোর মধ্যে রয়েছেআম, কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, নারকেল, কুল ও লিচু। এগুলো মোট ফল এলাকার প্রায় শতকরা ৭৯ ভাগ জমি দখল করে রয়েছে। অবশিষ্ট শতকরা ২১ ভাগ জমিতে অপ্রধান ফলগুলোর চাষ। অপ্রধান ফলগুলোর মধ্যে যেগুলো সচরাচর দৃশ্যমান, সেগুলো হলো সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবি লেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, খেজুর, তাল, তেঁতুল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙ্গি, তরমুজ ইত্যাদি। বাকি ফলগুলো খুবই কম চাষ হয়, যেগুলো আমরা অনেকে চিনি আবার অনেকেই চিনি না। এগুলোর মধ্যে আছে অরবরই, গাব, বিলেতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈ কর, চালতা, ডুমুর, পানিফল, মাখনা, বকুল, লুকলুকি, ডেউয়া, করমচা, কাঠবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, মনফল ইত্যাদি। ইদানীং কিছু নতুন ফলের আবাদও হচ্ছে। এর মধ্যে রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো ও মালটা অন্যতম। এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসছে। কিছুদিন আগেও প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের দাম ছিল ৬০০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফল আমদানির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ নাশপাতি, আপেল ও আঙুর কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে আম, লিচু, পেয়ারা ও বরই বেশি করে কিনে নিচ্ছে। ভোক্তারা মনে করে, দেশি ফল কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত। দামেও সস্তা। তাই পারিবারিক চাহিদা পূরণে এবং মেহমান আপ্যায়নে ফলই প্রধান ভরসা।

বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আম। ১৫ মে থেকে শুরু হয়েছে আম পাড়া। প্রথমেই গুটি, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, মিশ্রিভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া ইত্যাদি আগাম জাতের আম পেড়ে নেওয়া হয়। এরপর বাজারে আসে হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও ফজলি আম সামনে বাজারে আসছে। বারি আম-৪, আশ্বিনা ও গৌরমতি আসবে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। কাটিমন ও বারি ১১ জাতের আম সরবরাহ হয় বছরব্যাপী। ক্ষীরশাপাতি আম বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই আম শ্বাস ও আঁশবিহীন, রসালো। গন্ধে বেশ আকর্ষণীয় এবং স্বাদে মিষ্টি। হাঁড়িভাঙ্গা আমও অত্যন্ত সুস্বাদু ও আঁশবিহীন। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্যান্য আমের মধ্যে আছে ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ফজলি ও নাক ফজলি। এগুলোর বিশেষত্ব আলাদা। আগে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরেই ভালো জাত ও মানের আম হতো বেশি। এখন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেশেই ভালো জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দুই বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে। গত বছর আম রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩২১ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের মাত্র ০.০৫৫ শতাংশ। এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার টন। বিশ্বে আম রপ্তানি হয় প্রায় এক বিলিয়ন মেট্রিক টন। এতে বাংলাদেশের শরিকানা ১.৫ শতাংশ। বৈশ্বিক আমের বাজারের আকার প্রায় ৬৭.৪ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশের হিস্যা অনুল্লেখযোগ্য।

মোট উৎপাদনের দিক থেকে আমের পর কাঁঠালের অবস্থান। উৎপাদন প্রায় ২০ লাখ টন। আরো আছে কলা, যার উৎপাদন প্রায় ১৯ লাখ টন। পেঁপে, পেয়ারা ও আনারসের উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় ১১ লাখ, পাঁচ লাখ ও ছয় লাখ টন। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় এবং আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছি। স্বাদে ও জনপ্রিয়তায় আমাদের দেশে লিচুর অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মোট উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। তবে আম সবার প্রিয় ও সুস্বাদু। এবার আমের উৎপাদন ভালো। লক্ষ্যমাত্রা ২৭ লাখ টন।

আম উৎপাদনকারীরা এখন খুবই দুশ্চিন্তায়। উৎপাদিত ফল উপযুক্ত দামে বিক্রি করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, বাগানের খরচ উঠে আসবে কি নাএসবই দুশ্চিন্তার কারণ। মৌসুমি ফল পাকা ও পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করতে হয়। নতুবা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সাধারণত মৌসুমি ফল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অপচয় হয়। অনেক সময় বাজারজাতকরণের ধীরগতির কারণে তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের বর্তমান ভরা মৌসুমে আমাদের কৃষি বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে খামারপ্রান্ত থেকে আম, কাঁঠাল ও আনারস কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে তা বাজারজাত করা যেতে পারে। গরিব মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসেবেও আম-কাঁঠাল বিতরণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল ও আনারস পরিবহনের জন্য বিআরটিসির উদ্যোগে ট্রাক চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ইদানীং অনলাইনেও ফল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের গাফিলতির জন্য তা সুনাম হারাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সড়কপথে বাধাহীন ফল পরিবহনকে উৎসাহিত করা উচিত। তদুপরি আম ও অন্যান্য মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত বৃহৎ কম্পানিগুলো এ সময় তাদের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়ে ফলের দরপতন ও অপচয় থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে পারে। তা ছাড়া দেশের ফল চাষিদের সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ফল রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমাদের মৌসুমি ফল এরই মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি করা ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জড়ালেবু, এলাচি লেবু, কুল, সাতকরা, আমড়া, সুপারি, জলপাই, পেয়ারা ও কলা। বিদেশে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি ফল রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সাত বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের আম রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহী ও সাতক্ষীরার চাষিরা অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং উত্তম কৃষি কার্যক্রম অনুসরণ করে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করছেন। এর উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য বেশি। দেশের সুপারমার্কেটগুলো উন্নতমানের আম বাজারজাতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির আয় হ্রাস পেয়েছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি প্রণোদনা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করায় সম্প্রতি ফল রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়নি। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশি ফলের আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বগামী হবে বলে আশা করা যায়।

 

এখন একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আম কূটনীতি। গত বছর জুন মাসে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের রাজশাহীর কিছু আমবাগান পরিদর্শন করানো হয়েছে। এতে তাঁরা বাংলাদেশের আম উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। উৎপাদন এলাকায় গিয়ে আমের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছেন। এরপর চীনসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এবার চীন থেকে ৫০ হাজার টন আম নেওয়ার কার্যাদেশ এসেছে। অন্যান্য দেশও আমদানির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া অতীতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে পাকা আম। এতে আমাদের আম রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে কর্মরত। আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই রেমিট্যান্স হিসেবে আসে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ওই সব দেশে আমাদের আম উপহার ভ্রাতৃত্ব ও আত্মার সম্পর্ক জোরদার করবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের আম কূটনীতি আরো জোরদার ও অর্থবহ হোক, এই কামনা সবার।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ

সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য

ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ