<p>বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সমপর্যায়ের অনেক দেশের তুলনায় কম কেন, তা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখেন না। তিন কারণে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। এক. আওতার সীমাবদ্ধতা, পরিধিগত ঘাটতি। মবযোগ্য করদাতা ও খাতকে করজালের মধ্যে আনতে পারার দীর্ঘসূত্রতা বা ক্ষেত্রবিশেষে অপারগতা, অক্ষমতা। দুই. ব্যাপক করছাড়, কর রেয়াত, কর ফাঁকি, মামলায় আটকানো, কর্তন কিংবা আদায়কৃত কর-রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়া। তিন. রাজস্ব বিভাগের দক্ষ লোকবলের অভাব, অদক্ষতা, অপারগতা,  মনিটরিংয়ের দুর্বলতা, কর আইন এবং আহরণ ও প্রদান পদ্ধতির জটিলতা, মনোভঙ্গি পরিবর্তনের আবশ্যকতা।</p> <p>করের আওতা সীমিত, জুরিসডিকশন আসলে বাঞ্ছনীয়ভাবে বাড়ছে না। অর্থাৎ সক্ষম সব করদাতা এবং প্রযোজ্য সব খাত করজালের আওতায় আসেনি। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। যেকোনো দেশে জিডিপির অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ কর হিসেবে আহরিত হয়। কিন্তু আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত ৭-৮-৯-১০ শতাংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ঘোরাফেরা করছে। এর মানে এখনো জিডিপির হিস্যা অনুযায়ী অর্জিতব্য কর অনাহরিত থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ৭-৬, ৫-৬ শতাংশের একটা ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। আমাদের জিডিপিতে কৃষির অবদান এখনো বেশি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধিতে সার্বিকভাবে কৃষির অবদানই বেশি। গত আট-দশ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হোক, বন্যা হোক বা ব্যাপক ফসলহানি হোক—এ রকম ঘটনা ঘটেনি। সিডর বা আইলার পরে আর বড় ধরনের অঘটন ঘটেনি। ফলে জিডিপিতে কৃষি অব্যাহতভাবে ঊর্ধ্বমুখী অবদান রেখে যাচ্ছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কৃষি খাতের বেশির ভাগ আয় কর আওতার বাইরে। কৃষির পরে জিডিপিতে অবদান শিল্পের। শিল্প থেকে কর আসছে বা আসবে, তা আহরণের আওতায় আনার প্রয়াস ও পদ্ধতি আছে। জিডিপিতে বড় অবদান সত্ত্বেও কৃষি খাত করের বাইরে থাকায় কর-জিডিপি অনুপাত হারাহারি মতে বাড়ল। কৃষি করের বাইরে কেন? আমরা মনে করেছি, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। এটি করের বাইরে যদি রাখা হয়, তাহলে তা গ্রো করবে। এটিও সত্য, ক্ষুদ্র কৃষককে করের আওতায় আনা বা না আনায় তেমন কিছু আসে-যায় না। কর-রাজস্বে তাঁর অবদান বা দেয় খুব একটা নেই। কিন্তু সেই সুবাদে কৃষির নাম করে, কৃষির উপায়-উপকরণ জাত অনেক আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড বা শিল্প করের বাইরে রয়ে গেছে। গ্রামের কৃষককে তিন লাখ পর্যন্ত করমুক্ত করা হয়েছে, সেটি ঠিক আছে। কিন্তু কৃষকের কৃষি খাতের কিছু সাবসেক্টরে ব্যাপক আয় আছে;  যেমন—মৎস্য চাষ, সার উৎপাদন, সেচ প্রভৃতি। এগুলো কৃষি খাতের, কিন্তু অর্থকরী শিল্প, বিরাট অঙ্ক, বিরাট অর্থনীতি। ঘোরানো-প্যাঁচানো ব্যাখ্যার বদৌলতে কোনো কোনো কর্মকাণ্ড করের বাইরে রেখে, ক্ষেত্রবিশেষে কর রেয়াত দিয়ে, সাবসিডি দিয়ে সুরক্ষার নামে কর-রাজস্ব আয়কে সীমিত করা হচ্ছে। কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যেসব শিল্প গড়ে উঠছে, সেগুলোও কৃষির নাম করে বরং করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। মৎস্য চাষ, পানি সেচের যন্ত্র থেকে শুরু করে অনেক কিছুকে বলা হয় কৃষি খাতের। করজালের আওতায় আনার ক্ষেত্রে কৃষি খাতে যেসব ছাড় বা সীমাবদ্ধতা আছে, সেটি ঠিক করে আনতে পারলে যারা কর দেওয়া এড়িয়ে যায় কিংবা ফাঁকি দিচ্ছে, সেটি ঠিক করা যাবে।</p> <p>আওতার ব্যাপারে আরেকটি কথা হলো, আমাদের অর্থনীতি হঠাৎ করে বড় হচ্ছে। এটি ধারাবাহিকভাবে গ্রো করেনি। নব্বইয়ের দশক থেকে হঠাৎ করে বড় হচ্ছে অর্থনীতি। আর বড় হচ্ছে যেসব খাত তা হলো তৈরি পোশাক, আবাসন, নির্মাণশিল্প, সেবা, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ, আর্থিক খাত, টেলিকম, ওষুধ ইত্যাদি। আরো কিছু খাত উঠতি। এসব খাতে অনেক মুনাফা হচ্ছে, মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ তাদের অনেকে করের আওতায় ভালো করে আসছে না। কর অবকাশের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে, শিল্প উৎপাদনক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আসতে কর অবকাশের সুযোগ ব্যবহার ইতিবাচক প্রবণতায় আসতে বিলম্ব হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের নাম করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখনো নানা ধাঁচের কর রেয়াত সুবিধা নিচ্ছেন এবং যথেষ্ট কম কর দিচ্ছেন। শুল্ক ও কর রেয়াতের মাধ্যমে উল্টো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। রিহ্যাবের কাছ থেকে বাড়ি বিক্রি বাবদ তেমন করই সরকার পায় না। তারা কত লাভ করছে, সেটিও স্পষ্ট হচ্ছে না। শহরের বাড়িগুলো জরিপ করার উদ্যোগ বারবার নেওয়া হয়। প্রত্যেক বাড়িওয়ালাকে করের আওতায় আনার কাজ শেষ হয়েও এখনো শেষ হয়নি এবং অনেককেই করের আওতায় আনা হয়নি। যেখানে যেখানে অর্থনীতি দৃশ্যমান হচ্ছে বা বড় হচ্ছে, সেগুলো আসলে করের আওতায় আনার ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের  প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার দুর্বলতা বা অপারগতার সুযোগে রাজস্ব আয় অর্জিত হচ্ছে না। আওতার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক একটি বিষয়ে অবশ্য অনেক উন্নতি হয়েছে, চাকরিজীবীদের সবাই করের আওতায় এসেছেন। আগে অনেকেই কর দিতেন না। দিতে চাইলেও তাগিদে ঘাটতি বা কমতি ছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি সবাইকে কর দিতে বলা হচ্ছে। না দিলে অফিস থেকে বেতন না দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কর মেলায় দেখা যাচ্ছে অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহজে কর দিতে ভিড় জমাচ্ছেন। কর সংস্কৃতিতে এটি একটি ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি। কখনোসখনো দেখা যাচ্ছে, অফিসে কর্মীর কাছ থেকে কর কাটা হচ্ছে ঠিকই, সেই অর্থ সরকারি খাতে নিয়মিত যথাযথভাবে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না। অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে, উৎস কর যারা কেটে নিয়েছে, তারা ঠিকমতো কোষাগারে তা জমা দিচ্ছে না, দিলেও বেশ বিলম্ব করছে। অর্থাৎ এখানেও উৎস কর কর্তনকারীর দায়িত্ববোধের ও কর বিভাগের তরফে মনিটরিংয়ের একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে।</p> <p>আওতার আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো, যাঁদের আয় বেশি এমন বড় বড় প্রফেশনের লোকজন ‘ন্যায্য দেয়’ করের আওতায় নেই। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উকিলসহ পেশাজীবী গোষ্ঠীর অনেকেই এখনো কর দেন না আবার যাঁরা দেন, সঠিক বা ন্যায্য পরিমাণে দেন না। এখানে করদাতা ও কর আহরণকারী উভয় পক্ষের দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। </p> <p>একই কথা প্রযোজ্য ভ্যাটের ক্ষেত্রেও। পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতা সবাই ভ্যাট দিচ্ছে। সার্ভিস নেওয়ার সময় ভ্যাট দিচ্ছে। তবে যারা ভ্যাট নিচ্ছে, তারা তা রাষ্ট্রকে দিচ্ছে না। জনগণ কর বা ভ্যাট দিচ্ছে, অথচ সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে না; যার জন্য নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, কিভাবে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো এবং সরকারি কোষাগারে জমা নেওয়া নিশ্চিত করা যায়। ২০১২ সালে জারি হওয়া ভ্যাট আইনটি এখনো সর্বৈবভাবে প্রবর্তন বা প্রয়োগযোগ্য হওয়ার পথে। এরই মধ্যে ৯ বছর পার হলো। এরই মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। এই ৯ বছরে নতুন-পুরনো উভয় পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও পরিমাণে ভ্যাট আহরিত হচ্ছে। কিন্তু নতুন আইন পুরোপুরি প্রবর্তিত না হওয়ায় বাড়তি রাজস্ব ঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে পৌঁছাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ একটি সম্পূরক বিষয়, ২০১৭ সালে বেশ ঘটা করে বলা হলো নতুন ভ্যাট আইন প্রবর্তন করা হবে। সব কিছু ঠিক। এনবিআর প্রাক্কলন করে দেখাল, এটি প্রবর্তন করা হলে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট বাবদ আয় হবে। শেষ মুহূর্তে যখন প্রবর্তন করা গেল না, তখন ২০ হাজার কোটি টাকা আহরণের সুযোগ বা উপায় এর কী হয়েছিল? এই বাড়তি আয় হবে ধরে নিয়ে কিন্তু ওই বছর ব্যয়ের বাজেট করা হয়েছিল। ওই পরিমাণ সম্ভাব্য রাজস্ব অনাদায়ি রয়ে গেছে কি না, এসব বিষয় ও ব্যাখ্যা রাজস্ব দপ্তরের কাছে নিশ্চয়ই আছে।</p> <p>ভ্যাট পণ্য বা সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে কাটা করের টাকা, কিন্তু সেটি রাষ্ট্র পাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে কর ব্যবস্থাপনাকে জবাবদিহিমূলক করা কর সংস্কৃতির উন্নয়ন, এমনকি রাজস্ব বিভাগের ভাবমূর্তির প্রশ্নেও প্রয়োজন। আওতাসংক্রান্ত ওপরে উল্লিখিত জটিলতা বা সীমাবদ্ধতার কাদায় কর আয়ের বিপুল সম্ভাবনা আটকে যাচ্ছে, অপারগতার অবয়বে লাপাত্তা হচ্ছে। জবাবদিহিবিহীন অবয়ব অবকাঠামোকে স্বশাসিত, স্বয়ংক্রিয় ও স্বতঃপ্রণোদিত করা আবশ্যক। কর-জিডিপি অনুপাত উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। </p> <p> </p> <p>লেখক : সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর</p>