বাংলাদেশ বিশ্বে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এর মূল কারণ রাষ্ট্রের মূলনীতি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং প্রধানমন্ত্রীর অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনায় বাংলাদেশ আজ জঙ্গিমুক্ত দেশে পরিণত হয়েছে। আমরা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের শতভাগ মূলোৎপাটন না করতে পারলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনা সরকার
- আসাদুজ্জামান খান, এমপি
অন্যান্য

বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে তারা অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের যে কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আমরা তা প্রমাণ করতে পেরেছি। বাংলাদেশে তৎপর সব জঙ্গিগোষ্ঠীই দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী। তারা কখনো জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), কখনো হরকাতুল জিহাদ, কখনো আল্লাহর দল ইত্যাদি নাম ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে অভূতপূর্ব নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাস এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়, সুদক্ষ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।
বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতাদর্শের অনুসারী এ দেশীয় নব্য জেএমবির সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালায়। বিশ্লেষণ-পর্যালোচনায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের আইএসের উদ্দেশ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের তৎপরতার বেশ ফারাক দেখা যায়।
প্রকৃতপক্ষে আইএসের সঙ্গে এ দেশীয় জঙ্গিদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ গোষ্ঠীগুলো যতটা না দেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার চেয়ে বেশি চায় দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। দেশকে অস্থিতিশীল করাই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশে বসবাসরত অথবা এ দেশের উন্নয়নকাজের অংশীদার বিদেশি নাগরিকদের ‘টার্গেট কিলিং’ শুরু করে। কোথাও কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটলে কিংবা হামলার চেষ্টা হলেই রিটা কাটস নামের এক ইহুদি নারীর সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে ঘোষণা করা হয় যে এটা আইএস করেছে। কিন্তু তা সত্য নয়। আসলে এসব অপতৎপরতা একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপচেষ্টা।
তারা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি এবং ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে হামলাসহ বেশ কিছু হামলা চালিয়েছে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী কিছুদিন পর পর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে; কিন্তু গোয়েন্দাদের তৎপরতার কারণে সক্ষম হয়নি। তাদের ছোট স্লিপিং সেলগুলো মাঝেমধ্যে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন সহজ হয়েছে। আমাদের সুদক্ষ ও চৌকস আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাদের সফলভাবে দমন করেছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার আকস্মিকতা পর্যালোচনায় সরকার জঙ্গিদের দমনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয় বলেই তারা এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জঙ্গিরা এখন বিভিন্ন স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করছে, যাতে তাদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া সহজ হয়।
সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন রোল মডেল। সন্ত্রাসবাদ আঞ্চলিক সমস্যা নয়, একটি বৈশ্বিক সংকট। উগ্রবাদের বিস্তার ও জঙ্গিবাদ দমনে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের বিস্তারের নেপথ্যে ছিল বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার। আমরা জঙ্গিবাদের উত্থানের আলামত প্রথম উপলব্ধি করি ১৯৯২ সালে। ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’—এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে ১৯৯২ সালে। তারা রাষ্ট্রীয় মদদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ২৪ জন মানুষ নিহত হন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হামলাকারীদের অনেকে দেশ ত্যাগ করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থানের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবির ৬১টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার কাজে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করারও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা উল্টো চিত্র দেখি। তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশের জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বানে শিক্ষক-ছাত্র, শ্রমিক, ইমাম-পুরোহিত, সব ধর্মের গুরু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণ এগিয়ে এসেছে। জনগণ সহযোগিতা করেছে বলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জঙ্গিদের দমন করতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা সব ধর্মীয় নেতাকে জঙ্গি দমনে একত্র করতে সক্ষম হয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সর্বস্তরের জনবল নিয়ে প্রতিটি বিভাগে জঙ্গিবিরোধী মহাসমাবেশের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছিলাম যে এ দেশের মানুষ জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না; সন্ত্রাসীদের ঘৃণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করা হয়; মসজিদে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়। এতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ; কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা ধর্মান্ধ হলে পাকিস্তান থেকে দেশকে স্বাধীন করত না। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষিত দেশটি ধর্মের মায়াজাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছিল। পেয়েছিল একটি নতুন সংবিধান, যার শুরু হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে। সুতরাং এ দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতা তথা জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়নি, কখনো দেবে না। বাঙালির মানসেই প্রগতিশীলতার বীজ লুক্কায়িত আছে। জনগণের জঙ্গিবিরোধী মানসিকতার কারণেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে জঙ্গিবাদ দমনের কাজ সহজ হয়ে যায়।
জঙ্গিবাদ দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাব এবং তাদের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হলি আর্টিজান হামলার ব্যাপকতা লক্ষ করে প্রথমে জঙ্গি প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সব ইউনিটকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার জন্য একত্র করতে নির্দেশনা দেন। এই প্রচেষ্টা বেশ কার্যকর হয়। র্যাব, পুলিশ, এনটিএমসি, সাইবার টিম—সবার পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জঙ্গিদের মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা এসব কাজ করি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় জঙ্গি দমনে পুলিশে নতুন দুটি ইউনিট প্রস্তুত হয়েছে। এখন পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ল-ফুল ইন্টারসেপশন ইউনিট জঙ্গি দমনে সরাসরি কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত জেএমবি, শাহাদাত-ই আল-হিকমা, জেএমজেবি, হিযবুত-তাহ্রীর, হুজিবি, এবিটি, আনসার আল ইসলাম ও আল্লাহর দল নামে আটটি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর সদস্যরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে কাজ করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জঙ্গিদের ডেরায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের আস্তানা ধ্বংস করা হয়। আক্রমণের মুখে তাদের অনেকেই আত্মহত্যা করে; প্রায় সাত হাজার ২০০ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়। সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি আস্তানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে ৮০ জন জঙ্গি নিহত হয়। এসব অভিযান চালাতে গিয়ে এ পর্যন্ত পুলিশের ছয়জন, র্যাবের একজন ও ফায়ার সার্ভিসের একজন শাহাদাতবরণ করেন। গুরুতর আহত হন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কমপক্ষে ৬২ সদস্য।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা ও কাউন্সেলিংয়ের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক জঙ্গি সরকারের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বিভিন্ন মামলায় বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আসাদুজ্জামান পনিরসহ অনেকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শুধু জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনই নয়, শেখ হাসিনার সরকারের আরো সফলতা হলো চরমপন্থী, মাদক চোরাকারবারি ও বনদস্যু দমন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর দেশের শ্বাসতন্ত্র বলে খ্যাত সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত এলাকা ঘোষণা করেছেন। বনদস্যুরা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিশেষ সহায়তা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরই মধ্যে তারা প্রায় সবাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
জঙ্গিদের আস্তানায় অভিযানের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কিন্তু ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কারাগারের ভেতরে জঙ্গিবাদী ভাবাদর্শ থেকে সরিয়ে আনা বা ডির্যাডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে তাদের বোঝানো হয়, তারা ভুল করছে বা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে। কারাগারে তাদের কাউন্সেলিং করা হয়। এ ছাড়া স্কুল-কলেজে লিফলেট-ফেস্টুন বিতরণ; বেতার, টেলিভিশন, পত্রিকায় ফিলার-অ্যাড, সচেতনতামূলক প্রচার উল্লেখযোগ্য।
পাশাপাশি মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সোয়া এক লাখ আলেমকে নিয়ে জঙ্গিবিরোধী যে ফতোয়া দেন, সেটিও ব্র্যান্ডিং করা হয়। সেটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিনা প্রয়োজনে একটি গাছের পাতা ছেঁড়াও যে ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ তা প্রচার করা হয়। এ ছাড়া জঙ্গিদের দ্বারা ধর্মের অপব্যাখ্যায় মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয় সে জন্য স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকেও দেশের মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ইমাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। এই ধর্ম বিনা কারণে মানুষ হত্যা সমর্থন করে না, সেটা বোঝানো হয়। সরকার এভাবে মানুষকে সচেতন করতে পেরেছে বলেই আজ জঙ্গিরা কোণঠাসা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে কোনো জঙ্গি মারা গেলে তাদের নিকটাত্মীয়রা, এমনকি মা-বাবাও তাদের লাশ গ্রহণ করছেন না। এসব দেখে অনেক জঙ্গি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। তবে এখনো আত্মতৃপ্তির কোনো কারণ নেই, আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে দেশে জঙ্গিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে : ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে অসংখ্য দেশপ্রেমিক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। জঙ্গি তৎপরতাও বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার একটি অপচেষ্টামাত্র। নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গির মতো যেকোনো চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। নিকট অতীতে দেশের মানুষের জঙ্গিবিরোধী যে তৎপরতা দেখা গেছে, এতে নিঃসন্দেহে আশা করা যায়, জঙ্গিদের ‘স্লিপিং সেল’গুলোও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট অবরোধের নামে নাশকতা চালায়। ক্ষমতার লোভে মানুষ কতটা হিংস্র ও বর্বর হতে পারে বাংলাদেশের মানুষ তা দেখেছে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালজুড়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যযুগীয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলায়। তারা অগ্নিসন্ত্রাস করে চলন্ত বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, গৃহপালিত প্রাণী পুড়িয়েছে। রাস্তায় গাছ কেটে মধ্যযুগীয় কায়দায় কুপিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এমনকি একজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঘোষণার পর সারা দেশে সহিংসতা চালানো হয়। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করতে গিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ১৫ সদস্য নিহত হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনিপুণ পরিচালনায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করা হয়েছে। জনগণ এসব সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন টেকসই শান্তি আর টেকসই শান্তির জন্য দরকার টেকসই নিরাপত্তা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নেপথ্যে রয়েছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পেরেছেন বলেই এখন পৃথিবীর এক অপার বিস্ময়ের নাম বাংলাদেশ। মানুষের জীবন হয়েছে নিরাপদ। জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি হয়েছে শান্তিময়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক উদার স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন তাঁরই উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লীগ টেবিল ২০২১ অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে হবে। এটা সম্ভব শেখ হাসিনার মতো দূরদর্শী নেতা দ্বারা দেশ পরিচালিত হলে।
লেখক : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd