ঢাকা, সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১১ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১১ মহররম ১৪৪৭

সাম্প্রদায়িকতা কী ও কেন

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
সাম্প্রদায়িকতা কী ও কেন

সাম্প্রদায়িকতা কী সে তো আমরা অবশ্যই জানি। দেখিও। আমরা ভুক্তভোগীও বটে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারণে আমাদের এ দেশে দাঙ্গা হয়েছে।

দাঙ্গার পরিণতিতে একসময়ে অবিভক্ত বঙ্গ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, এক খণ্ড যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে, অন্য খণ্ড ভারতের। কিন্তু তার পরও দাঙ্গা থেমেছে কি? দুই বঙ্গের কোনো বঙ্গেই থামেনি। সাম্প্র্রদায়িকতারও অবসান হয়নি। শেষ পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বন্ধন ছিন্ন করে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তার পরও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটেছে কি?

না, ঘটেনি। শুধু যে মানসিক সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে তা নয়, সাম্প্র্রদায়িক নির্যাতনও ঘটেছে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু স্থানে নানা রকম নিপীড়নের খবর আমাদের লজ্জিত করেছে। সম্পত্তি দখল, নারী ধর্ষণ সব কিছুই ঘটেছে।

কাজেই সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা যে কেমন নির্মম, কদর্য ও ক্ষতিকারক, সেটা আমরা অবশ্যই জানি। না জানার কারণ নেই। সাম্প্র্রদায়িকতাকে চিনিও বটে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে যে কী তা সব সময় খেয়াল করি না। কেন ঘটছে তা-ও বুঝি না।

আমরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কথাই বলছি। এই সাম্প্রদায়িকতার কারণে দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ পরস্পরকে ঘৃণা করে। ঘৃণা পারস্পরিক সংঘর্ষেরও জন্ম দেয়। রক্তপাত ঘটে। আমাদের দেশে যেমনটা ঘটেছে।

কিন্তু আমাদের দেশে তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করেও এসেছে। হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষকের মধ্যে সংঘর্ষ বাধেনি। তারা একে অপরকে উৎখাত করতে চায়নি। নদীতে হিন্দু জেলে ও মুসলমান জেলে একসঙ্গে মাছ ধরেছে। তাঁতিরা তাঁত বুনেছে। সাধারণ মানুষ একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ও মসজিদের আজান একসঙ্গে মিশে গেছে। মানুষ একই পথ ধরে হেঁটেছে, একই বাজার-হাটে গিয়ে কেনাবেচা করেছে, থেকেছে একই আকাশের নিচে। কে হিন্দু, কে মুসলমান তা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করেনি, নাক সিটকায়নি। তাহলে? সাম্প্রদায়িকতা তৈরি করল কারা? তৈরি হলো কিভাবে? কেন?

শুধু করল দুই দিকের দুই মধ্যবিত্ত, হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত। ব্রিটিশ যুগেই এ ঘটনার সূচনা। তার আগে সম্প্রদায় ছিল, কিন্তু সাম্প্র্রদায়িকতা ছিল না। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু মধ্যবিত্ত শিক্ষায় ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠায় উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্তের তুলনায় অন্তত ৫০ বছর এগিয়ে ছিল। মুসলিম মধ্যবিত্ত দেখল জায়গা তেমন খোলা নেই, অন্যরা দখল করে নিয়েছে। শুরু হলো দুই পক্ষের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যারা দখল করে রেখেছে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। শাসক ব্রিটিশরা এ ব্যাপারে দুই পক্ষকেই উসকানি দিল, যাতে তাদের রেষারেষিটা আরো বাড়ে। বাড়লে ব্রিটিশের সুবিধা। কেননা ঝগড়াটা তখন শাসক-শাসিতের থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে হিন্দু-মুসলমানের।

ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু সেই সংগ্রামে হিন্দু ও মুসলিম ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি, পারেনি ওই সাম্প্রদায়িক বিরোধের কারণে। অবিভক্ত বঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে দুই সম্প্রদায়কে কাছে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ কিছুটা এগিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগে দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে চাকরির সুযোগ-সুবিধা অর্ধেক অর্ধেক ভাগাভাগিতে তাঁরা সম্মত হন। এই চুক্তি তৈরি হয় ১৯২৩ সালে। এর দুই বছর পর চিত্তরঞ্জন পরলোকগমন করেন এবং বলা বাহুল্য ওই চুক্তি মোটেই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, একের পর এক দাঙ্গা ঘটেছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মূল কারণ দুই মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্ব, যাতে ব্রিটিশের উসকানি খুব কাজে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা ওপর থেকে নিচে নেমেছে। নিচ থেকে ওপরে ওঠেনি।

চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর বাংলায় সর্বভারতীয় রাজনীতির অবাধ প্রবেশ ঘটে। ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। কংগ্রেস নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলত, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটি ছিল হিন্দুপ্রধান প্রতিষ্ঠান। গান্ধী নিজে অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করতে চাননি। ফলে ধর্মীয় ধ্বনি তুলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজটা মোটেই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। কংগ্রেসে কট্টর সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লোকেরা ছিল এবং তারাই শেষ পর্যন্ত মূল শক্তি হয়ে ওঠে, পরে তারা গান্ধীকে পর্যন্ত হত্যা করে। এদিকে মুসলিম লীগ তো মুসলিমদের প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে উঠেছে, তার নেতা জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, অর্থাৎ ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি এই মতবাদের ওপর তাঁর রাজনীতিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কংগ্রেস ও লীগ উভয়ের রাজনীতিই হয়ে দাঁড়াল সাম্প্র্রদায়িক রাজনীতি।

ভারতবর্ষ ভাঙল, বাংলাও দুই টুকরো হলো, মূল কারণ ওই সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশের উসকানি। কিন্তু তার পরও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটল না। অবসান হবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। কেননা ভারত হয়ে দাঁড়াল হিন্দুপ্রধান এবং পাকিস্তান মুসলিমপ্রধান। দুই রাষ্ট্রে দুই সম্প্রদায়ের প্রাধান্য এমন প্রবল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হবে, এটা মোটেই সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার পূর্বতন যে ভিত্তি ছিল সেটা আর রইল না। দ্বন্দ্বের শেষ হলো। কিন্তু তবু যে সাম্প্রদায়িকতা শেষ হয়ে গেল না তার কারণ কী? কারণটা হলো বৈষয়িক লালসা। আরো স্পষ্ট করে বললে সম্পত্তির লোভ। সম্পত্তি বলতে এ ক্ষেত্রে জমি, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরি, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুই বোঝাবে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা সংখ্যালঘুদের উৎখাত করে তাদের সম্পত্তি দখল করতে তৎপর হয়ে উঠল। আসলে এ হচ্ছে দুর্বলের ওপর প্রবলের অত্যাচার। প্রবল অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা দুর্বলের অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি কেড়ে নিতে থাকল। ব্যাপারটি ছিল লুণ্ঠন, কিন্তু তার ওপর একটা আচ্ছাদন দেওয়া হলো, সেটা ধর্মীয়। ধর্মীয় আচ্ছাদনে দুটি সুবিধা। এক. এতে লুটপাটের ব্যাপারটাকে পবিত্র কর্তব্য বলে সাজানো যায়। দুই. ধর্মের জিগির তুললে মানুষের মধ্যে উন্মাদনাও তৈরি করা সম্ভব হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আমরা মানিনি। আমরা তার জিঞ্জির ছিঁড়ে বের হয়ে এসেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জায়গায় এসেছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। কিন্তু তবু সাম্প্রদায়িকতা শেষ হয়নি। না হওয়ার কারণ অন্য কিছু নয়, ওই যে সম্পত্তি দখল করা সেটাই। সংখ্যালঘু হিন্দুরা এখানে দুর্বল, সংখ্যাগুরু মুসলমানরা তাই তাদের সম্পত্তি কবজা করতে তৎপর। শুধু যে হিন্দু সম্পত্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে তা নয়, মুসলমানদের সম্পত্তিও চলে যাচ্ছে ধনীদের হাতে। কিন্তু হিন্দুদের সম্পত্তি বিশেষভাবে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। প্রথমত বেশির ভাগ হিন্দুই দরিদ্র; দুই. তারা আবার সংখ্যায় কম। তিন. তাদের সম্পত্তি দখল করার সময় ধর্মকে ব্যবহার করা যায়।

সাম্প্র্রদায়িকতা তাই ধর্মের ব্যাপার নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাপার বটে। ধর্মব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান আমলেও ধর্মকে ব্যবহার করে লুণ্ঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে। যে জন্য সাম্প্র্রদায়িকতার অবসান ঘটছে না।

সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটা বোঝা গেল। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এর প্রতিকার কী? প্রতিকার খোঁজার আগে রাষ্ট্রের ভূমিকার দিকে তাকানো দরকার। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক বিরোধকে উসকানি দিয়েছে। পাকিস্তানের কালে রাষ্ট্র হিন্দুদের শত্রু বলে বিবেচনা করতে চেয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রও যে ধর্মনিরপেক্ষ, তা বলা যাবে না। এই রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার কথা ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই এর অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু সংবিধানে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা আর নেই। আমেরিকানরা আমাদের রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র বলছে, আমরা প্রতিবাদ করছি না। বলছি না যে আমাদের রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক। এখানে সব নাগরিকের রয়েছে সমান অধিকার। আমরা প্রতিবাদ করছি না কথাটার অর্থ হলো, আমাদের যারা শাসন করে তারা প্রতিবাদ করছে না। বড় দুই দলের কেউই এ ব্যাপারে উৎসাহী নয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে কোনো দলেরই উদ্যোগ নেই। বরং উভয় দলই ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। আর তারাই হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে আমাদের মুখপাত্র।

সংখ্যালঘুরা নিরাপদ বোধ করে না। নীরবে তাদের দেশত্যাগ যে ঘটছে এটা মিথ্যা নয়। আমাদের রাষ্ট্রে বলতে গেলে কোনো নাগরিকেরই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বিশেষভাবে বিপন্ন। মূল কারণ হলো রাষ্ট্রের চরিত্র। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, যার জন্য সংগ্রাম করেছি, সেই রাষ্ট্র আমরা পাইনি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য রয়েছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্যই প্রধান, সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের বৈষম্যও স্পষ্ট এবং সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মধ্যকার পুরনো বৈষম্য শেষ হয়ে যায়নি।

রাষ্ট্রকে তাই গণতান্ত্রিক করা চাই। শ্রেণি-ধর্ম-নারী-পুরুষ-জাতিসত্তা-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তা না হলে শোষণ, লুণ্ঠন, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিসত্তার নিপীড়ন কোনো ব্যাধিরই শেষ হবে না। আমরা ভুগতে থাকব এবং ভুগতে ভুগতে শুধুই দুর্বল হব।

কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনটা কিভাবে আসবে? নির্বাচনের মধ্য দিয়ে? সে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কেননা নির্বাচনে বড় দুই দলের একটি কিংবা অপরটি ক্ষমতায় আসবে। তারা রাষ্ট্রের চরিত্রে বদল আনতে চাইবে না, চাইবে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে লুণ্ঠন করতে। সে জন্য যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক তাদেরই কর্তব্য হবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করা। আন্দোলন ছাড়া মুক্তির অন্য কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারটা আমাদের বুঝতে হবে।

আমরা সামরিক শাসন দেখেছি, নির্বাচনও দেখেছি এবং দেখব। সামরিক সরকার অবৈধ, নির্বাচিত সরকার বৈধ। কিন্তু বৈধ-অবৈধ যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, দুর্বল মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আসে না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক দল ক্ষমতায় যায়, আরেক দল ক্ষমতা ছাড়ে। কিন্তু দুর্বলের ভাগ্য প্রসন্ন হয় না। তাই সাধারণ মানুষের স্বার্থ যারা দেখবে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অবস্থা এ কথাই বলছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

    ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
শেয়ার
বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যু। দীর্ঘদিন ধরে ঘটছে এমন ঘটনা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এ দায় কার? বিদ্যুৎ বিভাগ অবশ্য নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য আবরণযুক্ত তার ব্যবহার করছে। বন্যপ্রাণীর মৃত্যু।

নানাভাবেই এর মৃত্যু ঘটছে। দিন দিন বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় একটি প্রাণীর মৃত্যুও এখন ভাবিয়ে তোলে পরিবেশবিদদের। বিষয়টি আরো বড় হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।

২০২১ সালে একটি পত্রিকায় খবর এসেছিল, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, পাকা ধান রক্ষা করার জন্য ধানক্ষেতে অবৈধভাবে বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। এটি বিদ্যুত্সংযোগ দিয়ে রাখার কারণে ঘটেছে। এতে যে হাতি মারা গিয়েছিল, তার বয়স ছিল প্রায় ৫০ বছর। মা হাতি।
হাতিটির শুঁড়ের নিচে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও দেখা গিয়েছিল। 

২০২২ সাল। একটি পত্রিকায় খবর আসে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত বনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বানর ও চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটে। বনের ভেতরে রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। এই লাইনে জড়িয়ে অনেক বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটে।

এখানকার ঘটনাটি ছিল ভিন্ন। বনের ভেতর অবৈধভাবে সহস্রাধিক মানুষ বসবাস করছিল। তারা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে বনের ভেতরে অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০০ পরিবারকে বিদ্যুত্সংযোগও দেওয়া হয়। এর ফলে শুধু বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটেনি, স্থানীয় বন্যপ্রাণীরা বিভিন্নভাবে হুমকির মুখে পড়েছিল।

২০২২ সালেরই মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ঘটনা এটি। ওই বছর মার্চের ১৩ তারিখে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে গত দুই সপ্তাহেই সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারটি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটেছে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমানসহ ৯টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্টের কাছে একটি লজ্জাবতী বানর মারা যায় বিদ্যুতায়িত হয়ে। একই বছরের ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের কাছে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনায় সেখানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে খোলা তারের পরিবর্তে আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপনের চিঠি দেয়।

একটি পত্রিকার তথ্য মতে, মৌলভীবাজারের পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১১টি প্রাণী মারা গেছে। চারটি লজ্জাবতী বানর মৃত পাওয়া যায় জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলায়, তিনটি চশমাপরা বানরও মৃত পাওয়া যায় সেখানে। এ ছাড়া বড়লেখা রেঞ্জের মাধবকুণ্ড ইকোপার্কেও চারটি লজ্জাবতী বানর মারা যায়। এসব ক্ষেত্রেও আবরণহীন বৈদ্যুতিক তারের কারণে এমন ঘটছে বলে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দাবি করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দায় এড়াতে কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়েছে। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, বনের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বৈদ্যুতিক তারের কোনো আবরণ নেই। 

এভাবে বিদ্যুতায়িত হয়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ভারতেও ঘটে। সেখানকার ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ২২টি। ২০২০ সালে একইভাবে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ১০টি এবং ২০২১ সালে ১৬টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এভাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আমরাও প্রয়োগ করতে পারি। তারা বন্যপ্রাণী চিকিৎসা পরিকাঠামো গঠন করেছে। উদ্ধার হওয়া বন্যপ্রাণীদের জন্য বিশেষ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বৈদ্যুতিক তারগুলো ভূমি থেকে বিশেষ উচ্চতায় স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে।

প্রতিটি বন্যপ্রাণীই আমাদের দেশের জন্য একেকটি সম্পদ। এসব সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার-আপনার সবার। এ ক্ষেত্রে কেউই আমাদের দায় এড়াতে পারি না। তা বন বিভাগই হোক বা বিদ্যুৎ বিভাগ হোক বা হোক স্থানীয় জনগণ। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এসব বন্যপ্রাণীকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক   

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

নেতার নাম নেতানিয়াহু

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
নেতার নাম নেতানিয়াহু

আমাদের শৈশবে (উনিশ শ পঞ্চাশের দশক) যেসব বিশ্বনেতার নাম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছি, জার্মানির একনায়ক অ্যাডল্ফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে। তাঁর মতো আর কেউ বোধ করি মানবজাতির ইতিহাসে এত ধ্বংস ও অকল্যাণের জন্ম দেয়নি। ইহুদিদের প্রতি ছিল তাঁর এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। তিনি মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) জার্মানরা ইহুদিদের কারণেই পরাজয় বরণ করেছিল।

একই ভূমিকায় মুসলিম নিধনে অবতীর্ণ হয়েছেন হাল আমলের হিটলার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই ভদ্রলোক (?) বোধ হয় রোজ কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হত্যার সংবাদ না পেলে পানিটুকুও পান করেন না! বিশেষ করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনের গাজা নামক মুসলিম জনপদে অসহায় নারী ও শিশুদের মৃত্যুবরণ তাঁকে বোধ হয় এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দান করে। তাঁর এই চরম মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর মর্মমূলে আঘাত হানছে। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা এক শ ভাগ আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।

ফলে এ কথা এখন মোটামুটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ইসরায়েলকে এই অঘোষিত যুদ্ধে শিখণ্ডী বানিয়ে পেছন থেকে ঘুঁটি চালাচ্ছে বিগ ব্রাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র না হয় বোধগম্য কারণে ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত বড় যে মুসলিম বিশ্ব তার ভূমিকা কী? তার সদস্যরা কি কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন? তাঁদের সংগঠন ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব মুসলিম কনফারেন্স) কি অদ্যাবধি ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, যা দেখে ইসরায়েল তার হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে? উত্তর নিশ্চয়ই না। অথচ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই মুসলিম দেশ। তাদের এক ভ্রুকুটিতে ইসরায়েলের ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা।

আফসোস! এই যে প্রতিনিয়ত গাজা উপত্যকায় শত শত অসহায় মানুষ, যাদের মধ্যে অসহায় নারী-শিশু ও হাসপাতালের শয্যায় শায়িত মুমূর্ষু রোগীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়ঘাতক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছে, তাদের করুণ আর্তি কি প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের ও তাদের শাসককুলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না? খাদ্যাভাবে মরণোন্মুখ শিশুদের জন্য প্রেরিত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি ঘাতকরাএই দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ কাঁদে, কাঁদে না শুধু ওআইসির নেতাদের। তাহলে লোকে যে বলে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব দেশ, সব মানুষ যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হিসাব কষতে শুরু করে নিজের লাভক্ষতিরএটাই কি তবে সত্যি? ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলকে ধমক দিতে গেলে বড় মিয়া নাখোশ হয়ে পাল্টা ধমক দেবেনএই ভয়ে এবং নানা রকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান বন্ধ করে দিতে পারেন এমন আশঙ্কার কথা ভেবে মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো মনে হয় চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা নীতি অনুসরণ করছে। আর তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের মতো জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে না। ফলে অবস্থানটা কী দাঁড়াল? তুমুল বোমাবৃষ্টির মধ্যে ফিলিস্তিন তুমি জনহীন প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকো, বজ্রাঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও তুমি, স্যরি, আমরা কেউ তোমার মাথার ওপর ছাতা ধরতে আসতে পারছি না, সরিয়ে নিতে পারছি না তোমাকে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-rb-1a.jpgএই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের অন্দরমহলে একটু ঢু মারার চেষ্টা করা যাক।

সেখানে কি ইসরায়েলিরা তাদের বহুল আলোচিত নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে খুশির চোটে কাঁধে তুলে অহোরাত্র নৃত্য করছে আর স্লোগানে স্লোগানে দশ দিগন্ত প্রকম্পিত করছে : নেতা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে। দুঃখিত, না, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। পত্রপত্রিকায় যা দেখা যায়, তাতে মনে হয় ইসরায়েলিরা বরং নেতাজি নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে রীতিমতো তিতিবিরক্ত। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে তারা বেশি আগ্রহী তাদের ভাই-বেরাদর যারা ফিলিস্তিনিদের হাতে বন্দি হয়ে আছে, তাদের ফেরত পেতে, যদিও তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। এ নিয়ে তারা রাজধানী তেল আবিব ও অন্য শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। নেতাজি নাকি নিজভূমের জনগণের কাছে দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন। কী কপাল! বেচারা নিজের শক্তিমত্তা জাহির করার জন্য সেদিন বেমক্কা আক্রমণ করে বসলেন ইরান, কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল শূন্য। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ইরানিরা ফিলিস্তিনিদের মতো অসহায় এতিম। কিন্তু তাঁর হিসাবে যে দারুণ ভুল ছিল, তা হয়তো তিনি টের পেলেন সপ্তাহ দুয়েকের যুদ্ধে ইরানিদের হাতে দারুণ মার খেয়ে, যদিও বিশ্ববাসীকে তিনি জানিয়ে দিলেন তিনি নাকি যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তাঁর মতো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থেকে ধরাকে সরাজ্ঞান করার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। (পাদটীকা : বাংলাদেশের গত প্রায় দেড় যুগের দৃশ্যপট।)

নেতানিয়াহু যে কেবল একজন হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতা তা-ই নয়, তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর একজন, যিনি দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আসামির কাঠগড়ায় নিয়মিত দাঁড়াচ্ছেন। বিজ্ঞজনদের অভিমত, নিজ দেশের মানুষের দৃষ্টি তাঁর পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি থেকে অন্যদিকে ফেরানোর মতলবেই তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সে যা-ই হোক, তিনি দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানান আর পর্বত বানান, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, আমাদের প্রাণ কাঁদে ওই সব মৃত্যুপথযাত্রী ক্ষুিপপাসায় কাতর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জন্য, বিশেষ করে কুসুমকলি অবুঝ শিশুদের জন্য, যাদের উদ্দেশে প্রেরিত ত্রাণটুকুও ইসরায়েলি পাশব বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে যেতে দেয় না। হায়! একদিকে গাজায় হয় বোমার আঘাতে, না হয় খাদ্যাভাবে প্রতিদিন অকালে ঝরে পড়ছে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু আর অন্যদিকে এই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো শান্তির ললিত বাণী গেয়ে শোনায় বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত।...ঠাট্টা আর কাকে বলে!

ভালো কথা, শেষ করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে দেখে নিই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের এই দেশের। এ দেশের মানুষ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশে অন্যায়-অত্যাচার করে কেউই পার পেতে পারেনি। বিশ্বের কোথাও অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ উত্তোলিত হতে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আশ্বর্য, সেই বাংলাদেশ ইসরায়েলের ব্যাপারে কেমন জানি উদাসীন। এই যে প্রতিনিয়ত শত শত অবোধ শিশু ও অসহায় নারী-পুরুষ বলি হচ্ছে ইসরায়েলি যূপকাষ্ঠে, তারা মুসলমান না ইহুদি, খ্রিস্টান না হিন্দু, আস্তিক না নাস্তিক, সেটা বড় কথা নয়, তাদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তারা মানুষ। তারা অসহায় নিরপরাধ মানুষ। এই পৃথিবীতে আপনার, আমার এবং ওই নরখাদক নেতানিয়াহুর যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তাদেরও আছে সেই সমান অধিকার। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে সদা সোচ্চার বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে এই নির্লিপ্ত আচরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। ইসরায়েলের, বিশেষ করে তার খুনি নেতা নেতানিয়াহুর, এই নরমেধযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও তেমন সোচ্চার হতে দেখি না। কেসটা কী? তাহলে এখানেও কি সেই বড় মিয়া ফ্যাক্টর কাজ করছে? কী জানি! বলতেই হয়, বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি!

অগত্যা অগতির গতি দয়ামত আল্লাহপাকের দরবারে অসহায় ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে শেষ করছি। আমিন। সুম্মা আমিন। সুধী পাঠক-পাঠিকা, আশা করি, আপনারাও নিশ্চয়ই এই প্রার্থনায় শরিক হবেন। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব ও কবি

mkarim06@yahoo.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

    ড. জাহাঙ্গীর আলম
শেয়ার
স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার

আম, লিচু, আনারস ও কলা প্রচুর পরিমাণে বাজারজাতকরণ হচ্ছে। কাঁঠালও প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করেছে বাজারে। কৃষি অর্থনীতিতে এই ফলগুলোর গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গরমে অতিষ্ঠ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মনে এ সময় শান্তির পরশ বোলায় বিভিন্ন রসালো ফলের বিপুল জোগান।

জ্যৈষ্ঠ মাসে সুস্বাদু ফলের সরবরাহ থাকায় একে অনেকেই বলে মধুমাস। আভিধানিক অর্থে মধুমাস হলো চৈত্র মাস। কবিগুরু তাঁর ১৩০৪ বাংলা সনে লেখা গানে চৈত্র নিশীথশশী এবং উন্মাদ মধুনিশি অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। তবে ব্যবহারের আধুনিকতা ও জনপ্রিয়তায় এখন মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠকেই নির্দেশ করে।
জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আসে আষাঢ়। পরে শ্রাবণ। তখনো থাকে রকমারি ফলের প্রাচুর্য। বিভিন্ন দেশীয় ফল আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার বড় অংশ।

এ দেশে ফলের উৎপাদন হয় প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টন। এর ৫০ শতাংশই উৎপাদিত হয় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ৯ মাসে। কয়েকটি ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০ বছর ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১২.৫ শতাংশ।

দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। এতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। তবু ঘাটতি আছে ফলের। এ দেশে মোট ৭২ জাতের ফল সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয়। এর মধ্যে ৯টি প্রধান এবং ৬৩টি অপ্রধান। প্রধান ফলগুলোর মধ্যে রয়েছেআম, কলা, কাঁঠাল, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, নারকেল, কুল ও লিচু। এগুলো মোট ফল এলাকার প্রায় শতকরা ৭৯ ভাগ জমি দখল করে রয়েছে। অবশিষ্ট শতকরা ২১ ভাগ জমিতে অপ্রধান ফলগুলোর চাষ। অপ্রধান ফলগুলোর মধ্যে যেগুলো সচরাচর দৃশ্যমান, সেগুলো হলো সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবি লেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, খেজুর, তাল, তেঁতুল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙ্গি, তরমুজ ইত্যাদি। বাকি ফলগুলো খুবই কম চাষ হয়, যেগুলো আমরা অনেকে চিনি আবার অনেকেই চিনি না। এগুলোর মধ্যে আছে অরবরই, গাব, বিলেতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈ কর, চালতা, ডুমুর, পানিফল, মাখনা, বকুল, লুকলুকি, ডেউয়া, করমচা, কাঠবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, মনফল ইত্যাদি। ইদানীং কিছু নতুন ফলের আবাদও হচ্ছে। এর মধ্যে রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো ও মালটা অন্যতম। এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসছে। কিছুদিন আগেও প্রতি কেজি ড্রাগন ফলের দাম ছিল ৬০০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বিদেশি ফল আমদানির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। মানুষ নাশপাতি, আপেল ও আঙুর কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে আম, লিচু, পেয়ারা ও বরই বেশি করে কিনে নিচ্ছে। ভোক্তারা মনে করে, দেশি ফল কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত। দামেও সস্তা। তাই পারিবারিক চাহিদা পূরণে এবং মেহমান আপ্যায়নে ফলই প্রধান ভরসা।

বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আম। ১৫ মে থেকে শুরু হয়েছে আম পাড়া। প্রথমেই গুটি, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, মিশ্রিভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া ইত্যাদি আগাম জাতের আম পেড়ে নেওয়া হয়। এরপর বাজারে আসে হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও ফজলি আম সামনে বাজারে আসছে। বারি আম-৪, আশ্বিনা ও গৌরমতি আসবে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। কাটিমন ও বারি ১১ জাতের আম সরবরাহ হয় বছরব্যাপী। ক্ষীরশাপাতি আম বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই আম শ্বাস ও আঁশবিহীন, রসালো। গন্ধে বেশ আকর্ষণীয় এবং স্বাদে মিষ্টি। হাঁড়িভাঙ্গা আমও অত্যন্ত সুস্বাদু ও আঁশবিহীন। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্যান্য আমের মধ্যে আছে ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ফজলি ও নাক ফজলি। এগুলোর বিশেষত্ব আলাদা। আগে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরেই ভালো জাত ও মানের আম হতো বেশি। এখন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেশেই ভালো জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দুই বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে। গত বছর আম রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩২১ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের মাত্র ০.০৫৫ শতাংশ। এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার টন। বিশ্বে আম রপ্তানি হয় প্রায় এক বিলিয়ন মেট্রিক টন। এতে বাংলাদেশের শরিকানা ১.৫ শতাংশ। বৈশ্বিক আমের বাজারের আকার প্রায় ৬৭.৪ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশের হিস্যা অনুল্লেখযোগ্য।

মোট উৎপাদনের দিক থেকে আমের পর কাঁঠালের অবস্থান। উৎপাদন প্রায় ২০ লাখ টন। আরো আছে কলা, যার উৎপাদন প্রায় ১৯ লাখ টন। পেঁপে, পেয়ারা ও আনারসের উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় ১১ লাখ, পাঁচ লাখ ও ছয় লাখ টন। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় এবং আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছি। স্বাদে ও জনপ্রিয়তায় আমাদের দেশে লিচুর অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মোট উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। তবে আম সবার প্রিয় ও সুস্বাদু। এবার আমের উৎপাদন ভালো। লক্ষ্যমাত্রা ২৭ লাখ টন।

আম উৎপাদনকারীরা এখন খুবই দুশ্চিন্তায়। উৎপাদিত ফল উপযুক্ত দামে বিক্রি করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, বাগানের খরচ উঠে আসবে কি নাএসবই দুশ্চিন্তার কারণ। মৌসুমি ফল পাকা ও পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করতে হয়। নতুবা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সাধারণত মৌসুমি ফল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অপচয় হয়। অনেক সময় বাজারজাতকরণের ধীরগতির কারণে তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের বর্তমান ভরা মৌসুমে আমাদের কৃষি বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে খামারপ্রান্ত থেকে আম, কাঁঠাল ও আনারস কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে তা বাজারজাত করা যেতে পারে। গরিব মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসেবেও আম-কাঁঠাল বিতরণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল ও আনারস পরিবহনের জন্য বিআরটিসির উদ্যোগে ট্রাক চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ইদানীং অনলাইনেও ফল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের গাফিলতির জন্য তা সুনাম হারাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সড়কপথে বাধাহীন ফল পরিবহনকে উৎসাহিত করা উচিত। তদুপরি আম ও অন্যান্য মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত বৃহৎ কম্পানিগুলো এ সময় তাদের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়ে ফলের দরপতন ও অপচয় থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে পারে। তা ছাড়া দেশের ফল চাষিদের সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ফল রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমাদের মৌসুমি ফল এরই মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি করা ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জড়ালেবু, এলাচি লেবু, কুল, সাতকরা, আমড়া, সুপারি, জলপাই, পেয়ারা ও কলা। বিদেশে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি ফল রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সাত বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের আম রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহী ও সাতক্ষীরার চাষিরা অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং উত্তম কৃষি কার্যক্রম অনুসরণ করে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করছেন। এর উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য বেশি। দেশের সুপারমার্কেটগুলো উন্নতমানের আম বাজারজাতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির আয় হ্রাস পেয়েছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি প্রণোদনা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করায় সম্প্রতি ফল রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়নি। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশি ফলের আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বগামী হবে বলে আশা করা যায়।

 

এখন একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আম কূটনীতি। গত বছর জুন মাসে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের রাজশাহীর কিছু আমবাগান পরিদর্শন করানো হয়েছে। এতে তাঁরা বাংলাদেশের আম উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। উৎপাদন এলাকায় গিয়ে আমের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছেন। এরপর চীনসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এবার চীন থেকে ৫০ হাজার টন আম নেওয়ার কার্যাদেশ এসেছে। অন্যান্য দেশও আমদানির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া অতীতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে পাকা আম। এতে আমাদের আম রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে কর্মরত। আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই রেমিট্যান্স হিসেবে আসে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ওই সব দেশে আমাদের আম উপহার ভ্রাতৃত্ব ও আত্মার সম্পর্ক জোরদার করবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের আম কূটনীতি আরো জোরদার ও অর্থবহ হোক, এই কামনা সবার।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ

সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য

ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ