ঢাকা, সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১১ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১১ মহররম ১৪৪৭

এশিয়ান গেমস হোক সাফের প্রস্তুতি

  • ইকরামউজ্জমান
notdefined
notdefined
শেয়ার
এশিয়ান গেমস হোক সাফের প্রস্তুতি

এশিয়ান গেমস—‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন এশিয়া’। অলিম্পিকের পর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের অনুষ্ঠান। এশিয়ার ক্রীড়াচত্বরে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ সৃষ্টি আর কৃষ্টির।

গতি, শক্তি, শৈলী আর বীরপনার। এ ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাধুলার মাধ্যমে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সম্মিলিতভাবে এশিয়া ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই গেমসের লক্ষ্য। এই গেমস প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশের খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের দেশাত্মবোধ বাস্তবে প্রতিফলনের মঞ্চ।

এশিয়ান অলিম্পিয়াডের কথা উঠলে প্রথমেই আসবে ভারতের ভূমিকা।

ভারত এই গেমসের স্বপ্নদ্রষ্টা শুধু নয়, এশিয়ান গেমস ফেডারেশন গঠন করেছে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে। এরপর প্রথম গেমস সফলতার সঙ্গে আয়োজন করেছে (১৯৫১ সালে) নিজ দেশে। এশিয়ান গেমসের চিন্তা যে ভারতীয়র মাথা থেকে এসেছে তিনি হলেন গুরুদত্ত সোন্ধী—শিক্ষাবিদ, ক্রীড়ানুরাগী ও অলিম্পিকের আদর্শের পূজারি। ১৯৪৮ সালে লন্ডনে চতুর্দশ অলিম্পিক চলাকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এশিয়ান গেমস নিয়ে আলোচনা করেন গুরুদত্ত সোন্ধী।
খোলাখুলিভাবে জানান তাঁর চিন্তা। এশিয়ার ক্রীড়া সংগঠকরা তাঁর চিন্তাকে সমর্থন জানান। লন্ডনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৯৫১ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে প্রথম এশিয়ান গেমস। গঠিত হয় এশিয়ান গেমস ফেডারেশন। সবার সম্মতিতে গুরুদত্ত সোন্ধীকে মনোনীত করা হয় ফেডারেশনের প্রথম সম্পাদক।

দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ১৯৫১ সালের ৪ থেকে ১১ মার্চ প্রথম এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়। গেমস অনুষ্ঠানের পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর উৎসাহ ও সাহায্য স্মরণীয়। আনুষ্ঠানিকভাবে গেমসের উদ্বোধন করেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। অংশ নিয়েছিল ১১টি দেশ। প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত ছিল ফুটবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, সাইক্লিং ও ভারোত্তোলন।

ফুটবলের ফাইনালে ভারত ইরানকে ১-০ গোলে পরাজিত করে প্রথম এশিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়। কৃতী বাঙালি খেলোয়াড় শৈলেন মান্না এই দলের অধিনায়ক ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৫৮ সালে টোকিওতে তৃতীয় এশিয়াডে পূর্ব পাকিস্তানের কৃতী বাঙালি ফুটবলার নবী চৌধুরী পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো বাঙালি এই প্রথম পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়ক হন। নবী চৌধুরী ছাড়াও আরো পাঁচজন ফুটবলার টোকিও গেমসে ফুটবল দলে স্থান পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন আশরাফ চৌধুরী, চিংগা মং চৌধুরী, মারী, কবীর আহমেদ, মঞ্জুর হাসান মিন্টু ও আমির জং চৌধুরী গজনবী। পঞ্চাশের দশকে আমাদের এ অঞ্চলে বাঙালির ফুটবলের মান কোন পর্যায়ে ছিল, এই ‘সিলেকশন’ থেকেই এটা সহজে বোঝা যায়। পূর্বসূরিদের মাঠের সেই ফুটবলে এখন চলছে অমাবস্যা। ফুটবলে নেই সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

১৮তম এশিয়ান গেমস এবার ইন্দোনেশিয়ায়। আজ ১৮ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে সমাপ্তি ঘটবে ২ সেপ্টেম্বর। গেমসে ৪০টি খেলার ভেন্যু রাজধানী জাকার্তা ও পালেম বাংয়ে। অংশ নেবে ৪৫টি দেশ থেকে প্রায় ১১ হাজার ক্রীড়াবিদ ও খেলোয়াড়। বাংলাদেশ থেকে ১৪টি খেলার ডিসিপ্লিনে (ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, কাবাডি, বিচ ভলিবল, গলফ, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, শুটিং, আর্চারি, ভারোত্তোলন, কুস্তি, রোইং ও ব্রিজ) অংশ নেবেন ১১৭ জন খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ। গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করবেন ভারোত্তোলনকারী ক্রীড়াবিদ সাবিয়া আক্তার। সাবিয়া ভারতে অনুষ্ঠিত গত সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জিতেছেন এবং স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত (২০১৪) কমনওয়েলথ গেমসে আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো করেছেন।

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাকার্তা গেমস উদ্বোধনের আগেই গত ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে গেছে ফুটবল কম্পিটিশন। ‘বি’ গ্রুপে প্রথম খেলায় বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে ৩-০ গোলে। শক্তিশালী দল উজবেকিস্তানের বিপক্ষে এই পরাজয় অপ্রত্যাশিত নয়। বিজয়ী প্রতিপক্ষ আমাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দল থেকে ‘টেকনিক্যালি’ ও ‘ট্যাকটিক্যালি’ অনেক বেশি এগিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথমে গোল করে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র করেছে থাইল্যান্ডের সঙ্গে। সুযোগ কাজে লাগাতে না পেরে বাংলাদেশ জয় ধরে রাখতে পারেনি। শেষ ম্যাচটি খেলতে হবে কাতারের বিপক্ষে। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি খেলায় জিতেছে। প্রথমে ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১, ১৯৮৬ সালে নেপালকে ১-০ এবং ২০১৪ সালে আফগানিস্তানকে পরাজিত করেছে ১-০ গোলে।

বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের থাইল্যান্ডের ব্যাংককে (অষ্টম আসরে) প্রথম অংশ নেওয়ার পর থেকে বিগত সব এশিয়াডে অংশ নিয়েছে। দেশ প্রথম পদকের মুখ দেখেছে ১৯৮৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। সেবার বক্সিংয়ে ৮১ কেজি লাইট হেভিওয়েটে ব্রোঞ্জ জয় করেন মোশাররফ হোসেন। এরপর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আর কেউ এশিয়াডে ব্যক্তিগত পদক জিততে পারেননি। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। আর এই কাবাডিতে (দলীয় ইভেন্ট) প্রথম রৌপ্যপদক জয় করে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত এশিয়াডে ১২টি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে একটি স্বর্ণপদক (পুরুষদের ক্রিকেটে ২০১০ সালে) ২০১০ সালে চীনের গুয়ান জু এশিয়ান গেমসে। অন্যগুলো পুরুষ কাবাডি, নারী ক্রিকেট, নারী কাবাডিতে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক। কাবাডি দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি পদক এনে দিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়াডের আয়োজন। এর আগে চতুর্থ গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬২ সালে জাকার্তায়। সেই গেমসে স্বাগতিক দেশ ও এশিয়ান ক্রীড়া ফেডারেশনকে বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ কলুষিত হয়েছে মূলত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কারণে।

এশিয়ান গেমস আমাদের জন্য বড় শক্ত ও কঠিন—বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই বাস্তবতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে এই চত্বরে আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে আছি। তাই এই গেমসে যেসব ডিসিপ্লিনে এবার অংশ নেওয়া হবে এগুলোর একটিতেও আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং উজ্জীবিত হয়ে বলা সম্ভব নয় ব্যক্তিগত বা দেশীয় ইভেন্টে পদক জয় সম্ভব। বলা হয়েছে শুটিং, কাবাডি ও আর্চারিতে ভালো করার সম্ভাবনা আছে। তার মানে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। শুটিং, আর্চারি, কাবাডি লম্বা সময় ধরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিয়েছে। শুটিং আর আর্চারি তো ২০২০ অলিম্পিক সামনে রেখে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, এশিয়াডে শুটিং ও আর্চারিতে তো বিশ্বের সেরারা অংশ নেন। সেখানে লড়াই করে পদক জেতা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কাবাডি ৯-১০ মাস ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও আস্থার অভাবে ভুগছে। তাদের বক্তব্য হলো, প্রশিক্ষণ ভালো হয়েছে, তবে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। দেরিতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়ায় অন্যান্য খেলায় এক-দেড় মাসের বেশি প্রশিক্ষণের সুযোগ মেলেনি। খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের মুখে একই অভিযোগ—এত অল্প প্রশিক্ষণে এশিয়ান গেমসে তো কিছুই সম্ভব নয়। তবু নিজেদের সেরাটা দেওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের দোষারোপ করা যাবে না, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়টিই তো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিওএর মহাসচিব সব কিছু বুঝে, জেনে তো তাঁর অবস্থান থেকে অবাস্তব আশার কথা শোনাতে পারেন না। বিওএর বক্তব্য হলো, এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ আগামী বছর মার্চে সাফ গেমসে অংশগ্রহণেরই প্রস্তুতি। আঞ্চলিক গেমসে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থাও যে ভালো তা তো নয়। এখানেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হবে। ক্রীড়াবিদদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি না করতে পারলে এবং তাঁদের সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ না নিতে পারলে তো পুরো বিষয়টি আবার গতানুগতিক হতে বাধ্য। খেলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ও উদাসীনতা দেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পিছিয়ে রেখেছে। এর ফলে খেলার ব্যবস্থাগুলো গত ৪৬ বছরেও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মুখের কথা আর আশ্বাস দিয়ে তো ক্রীড়াঙ্গন চলে না। এগুলো এখন বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ্য ঠিক করেই ঝাঁপ দিতে হবে। নিরলস প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির জন্য পাঁচ-ছয় কোটি টাকার বেশি লাগে না। এটা বরাদ্দ করা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকম্প ঘটবে না। এই অর্থ সময়মতো বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন বরাবর বরাদ্দ করা হলে এবং তা সঠিকভাবে কাজে লাগালে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল চেহারা বের হয়ে আসতে সময় লাগবে না।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

    তুহিন খান
শেয়ার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।

সেদিন থেকে জুলাই ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট এবং এর প্রাপ্তির দিকটি অনেক বড়। কিন্তু জুলাই-পরবর্তী সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে এই মহাকাব্যিক ঘটনা কাঠামোগতভাবে কতটা অনূদিত হতে পারল, আমরা নানা রকম ভাঙার পাশাপাশি কতটা গড়তে পারলামসেদিক বিবেচনায় অপ্রাপ্তিও কম না।

গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।

ফলে এ সরকারের ধরনটি ঠিক কী, তার মেয়াদ ও ম্যান্ডেট কতটুকু হওয়া সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আগে এক টক শোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এই সরকারের সবকিছু করারই ম্যান্ডেট আছে; তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এই দাবিটি খুব জোরালো বাস্তব ভিত্তি নিয়ে হাজির নেই। গেল বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বহুমুখী জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার মূলেও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন নিয়ে এই তর্ক। ঘোষিতভাবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হলেও সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই একে একটি বিপ্লবী সরকার করে তুলতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমাজে স্পষ্টভাবে হাজির নেই।
পুরনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিকএই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানএই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কার ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কারসেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।

কিন্তু এসব সংস্কার প্রস্তাবের ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে বা গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

মব শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবেএসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

মন্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

    ড. নিয়াজ আহম্মেদ
শেয়ার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।

আমরা অনেকে জুলাই মাসেও সেশন শুরু করতে পারছি না। আমাদের যেখানে সচরাচর মাস্টার্সসহ পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা, সেখানে সব সময় ছয়টি ব্যাচ থাকছে। শিক্ষার্থীরা যেমন সেশনজটে পড়ছে, তেমনি আমাদেরও বেশি লোড নিতে হচ্ছে। কার্যত কমবেশি সবার ক্ষতি হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সময় অপচয় ও আর্থিক ক্ষতি, অভিভাবকদের কষ্ট ও দুচিন্তা, সরকারের আর্থিক ক্ষতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যাসহ অন্য অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে জুলাই মাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমরা জানুয়ারি মাসেও তা শুরু করতে পারছি না।

আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

আমাদের কারিকুলাম এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনসহ আরো কিছু ব্যবস্থা নিতে পারলে আমরা আগাতে পারব। আমাদের সিলেবাস কমানো এবং সিলেবাসের একটি বড় অংশ আগেই মূল্যায়ন করা, যাতে ফাইনাল পরীক্ষা মূল্যায়ন সহজ এবং সময়সাপেক্ষ না হয় তার দিকে নজর দেওয়া। বোর্ডগুলো পরীক্ষককে বোর্ডে এনে সহজে এবং কম সময়ে খাতা মূল্যায়ন করাতে পারলে এক মাসের মধ্যে ফলাফল দেওয়া সম্ভব। মাসব্যাপী পরীক্ষা না নিয়ে আরো কম সময়ে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা, শিক্ষকদের আগ্রহ এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতা আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সহায়তা করতে পারে।

উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।

আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

nahmed1973@gmail.com

মন্তব্য

কজন জানে জুলাই সনদ কী

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
কজন জানে জুলাই সনদ কী

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংস্কারের প্রশ্নে একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর কথিত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা সংস্কারের দাবিগুলো দল-মত-নির্বিশেষে একটি জাতীয় কর্মসূচির রূপ পরিগ্রহ করে। এতে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্র মেরামত কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যের প্রশ্নে আর কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমতের অবকাশ থাকে না। এবং সেভাবেই বিভিন্ন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতির তুলনায় অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির মতো বড় দল দৃশ্যত ধৈর্য হারাতে থাকে এবং ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠে। বারবার একটি কথা অত্যন্ত বড় হয়ে জনসমক্ষে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। তা হলো বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যেন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত কিংবা সঞ্চিত ঐক্য, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিকল্পনা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বাসনাই যেন অনেককে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।
এর ফলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হচ্ছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের আবেদন কিংবা আকাঙ্ক্ষাটি এখন যেন তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে না ফেললেও ধূসর গোধূলির মতো ক্রমেই অপসৃত হচ্ছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/06-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgএ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।

আমাদের অতীত গণ-আন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ২০২৪ সালে সংগঠিত ছাত্র-জনতার সে মহান জাগরণ, আত্মত্যাগ কিংবা সাফল্যকে চিরভাস্বর করে রাখা আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। কারণ সেটি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের একটি সাদামাটা আন্দোলন ছিল না। ছিল না কোনো যেনতেন ফ্যাসিবাদী সরকার হটিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদ জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত। এই সত্যটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতিসচেতন জনগণ অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণা কিংবা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সজ্ঞানে অগ্রাহ্য করছি? সংগ্রামী ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কৌশল কিংবা কর্মসূচিতে কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। এতে সম্ভবত সাংগঠনিক দিক ছাড়াও অভিজ্ঞতা ও সময়ের আলোকে ত্রুটিপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তেরও প্রতিফলন ঘটতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় নিঃসংশয়ে একটি কথা বলতে হবে যে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির প্রশ্নে মোটামুটি সবাই ছিলেন নিঃস্বার্থ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বহু ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও আপসহীন থাকতে হবে। নতুবা এ ক্ষেত্রে শুধু তারা নয়, জুলাই-আগস্টের সব আন্দোলন ও আত্মত্যাগ মূল্যহীন হয়ে পড়বে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।

ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ