আজ ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সে থেকে ৭৫ বছর পার হয়ে গেল। মৃত্যুদিনে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা নানাভাবে চিন্তা করি।
সংকটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ
- করুণাময় গোস্বামী
notdefined

সুখের মরণ বলে একটি কথা আছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনবৃত্তান্ত সংক্ষেপেও যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন যে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের অনেক দুঃখ ও উদ্বেগকে অতিক্রম করে এসেছেন। তিনি দুঃখে-উদ্বেগে পড়েছেন, সেগুলোকে অতিক্রমও করেছেন শিল্পীর মতো, সান্ত্বনার আশ্চর্য সৃজনী শক্তি দিয়ে, নিজের বৃত্তান্তকে বিশ্বপ্রকৃতির বৃত্তান্তের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে। তবে জীবনের সর্বশেষ উদ্বেগ দিন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী নিয়ে। এর ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে সারা ভারতবর্ষ তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন টিকিট বিক্রি করে, নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে। তখন তিনি এতটাই অশক্ত ছিলেন যে ঠিকমতো কানে শুনতেন না, হাঁটতে কষ্ট হতো, কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতেন। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে লাহোর গেলেন চিত্রাঙ্গদার শো করে অর্থ সংগ্রহের জন্য। ফিরতি পথে দিল্লি পৌঁছলে মহাত্মা গান্ধী বিশ্বভারতীর তহবিলে ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং আশ্বাস দেন যে নেহরুকে তিনি বলবেন, ভারত স্বাধীন হওয়া মাত্র তিনি যেন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বভারতীর ব্যবস্থাপনা ব্যয়-নির্বাহের ব্যবস্থা করেন।
উদ্বেগ ছিল পৃথিবীর জন্য, উদ্বেগ ছিল ভারতবর্ষের জন্য। অন্তিম সময়ে ভারতবর্ষের জন্য উদ্বেগ কবির জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। স্মৃতিচারণায় শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে লেগে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন সে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার বেশ আগেই, তখনো যুদ্ধ লাগার কোনো কথাই হচ্ছিল না, অতি ঘনিষ্ঠজনদের তেমন কথা তিনি বলেও ছিলেন। শান্তিদেব এ বিষয়টিকে বলেছেন, দূরকে দেখার বিস্ময়কর শক্তি রবীন্দ্রনাথের। প্যারিস জ্বলছে বলে একদিন তিনি আকুল হয়ে উঠেছিলেন, যুদ্ধ তখনো লেগে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজেকে পৃথিবীর কবি বলেছেন। বলেছেন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই মানুষের কোনো আকুল আকাঙ্ক্ষা, কোনো আকুল ত্রাস মানুষকে আলোড়িত করুক না কেন, তাঁর কবিতায় সেসব ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবিকে পীড়িত করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনিয়ে আসা ছায়া তাঁকে আরো গভীরভাবে পীড়িত করে তুলছিল। অহিংসা ও শান্তির মহাদূত বুদ্ধ ও যিশুকে তিনি বারবার স্মরণ করেছেন, পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ‘বরিষ’ ধরার মাঝে শান্তির বারি। শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে। ঊর্ধ্ব মুখে নর-নারী। জীবন যত এগোল, সংকট যত ঘনিয়ে এলো রবীন্দ্রনাথের মনে হতে থাকল শান্তির জন্য প্রার্থনা যথেষ্ট নয়। এর জন্য সংগ্রাম চাই, শান্তির জন্য সংগ্রামের বিকল্প নেই। ১৯৩৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর, যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনে রচনা করলেন ছয় লাইনের উদ্দীপনাস্নাত কবিতা : নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস/বিদায় নেবার আগে তাই/ডাক দিয়ে যাই/দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে। এ দানব শুধু বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসদানব নয়, রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন সে দানব তার ভয়ংকর হাত বাড়াচ্ছে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ওপর। শৈশবকাল থেকে তিনি যে ভেবে আসছেন ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ভর করবে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের শক্তির ওপর, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠবে আধুনিক ভারতবর্ষের বিকাশের কাঠামো। এর জন্য এত গান, এক কবিতা, এত প্রবন্ধ, এত ভাষণ, এত উদ্যোগ। সবই দেখতে পাচ্ছেন ভেস্তে যাচ্ছে। জীবনের অন্তিম পর্বে এসে দেখতে পাচ্ছেন সব আকাঙ্ক্ষা, সব উদ্যোগ, সব আশা বিফল হয়ে যাচ্ছে। এই যন্ত্রণা নিয়ে মরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া, সুখের মরণ নয় নিশ্চয়ই।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ, ১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ অস্থির হয়ে উঠলেন শান্তিনিকেতনে জনসমাগমে ভাষণ দেওয়ার জন্য। তখন ভাষণ দেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নয় তাঁর। কানে শুনতে পাচ্ছেন কম, চোখে দেখতে পাচ্ছেন কম, আঙুলে জোর নেই, লিখতে পারেন না। ডিকটেশন দিয়ে বক্তৃতাটি তৈরি করলেন। রবীন্দ্রনাথ যে গৃহে থাকেন তার বারান্দায় বসে শান্তিদেব ঘোষ অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সাল করেন। শান্তিনিকেতনে বাংলা নববর্ষ ও একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানকে মিলিয়ে নিয়ে একত্রিত আয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিপুল আয়োজনের জন্য সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদনের দায়িত্ব শান্তিদেবের। তিন-চার দিন রিহার্সাল হয়েছে, উৎসবের দুদিন আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ডিকটেশন দিয়ে তৈরি করা নববর্ষ ভাষণের পাঠটি যেন তিনি দেখে দেন। শান্তিদেব জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বললেন, তিনি দেশবাসীর সামনে তাঁর জীবনের সর্বশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করতে চান। শরীরের যা অবস্থা, তাতে এর পরে তিনি আর কোনো বক্তব্য নিয়ে উপস্থিত হতে পারবেন না। এই বলে শান্তিদেব জানালেন যে রবীন্দ্রনাথ অদূর ভবিষ্যতে দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে কিছু কথা বললেন এবং এর পরে বক্তৃতার বিষয়ে এলেন। রবীন্দ্রনাথের এই বক্তৃতা নিয়ে আমার একটি বই বেরিয়েছে। তাতে আমি আক্ষেপ করে বলেছি, খুব ভালো হতো যদি আমরা জানতে পারতাম অদূর ভবিষ্যতে ভারতে কী ঘটতে যাচ্ছে বলে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। সে কথাগুলো অমিয় চক্রবর্তী কোথাও উল্লেখ করেননি, শান্তিদেব ঘোষও উল্লেখ করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ভয়ংকর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে রবীন্দ্রনাথ বলছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সেই ভয়ংকর কথাটি দেশের সামনে বলবেন বলে নিতান্ত দুর্বল শরীরে বক্তৃতা মঞ্চে গিয়েছিলেন। বক্তৃতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথ সেই ভয়ংকর কথাটি বলেছিলেন বক্তৃতার শুরুতেই। তিনি বলেছিলেন, জীবনের ৮০ বছর পূর্ণ করে পেছন দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে যখন নিবিষ্টভাবে তাকান, তখন দেখতে পান যে হিন্দু-মুসলমানের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে তাঁর নিজের জীবনের পরিণতিও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। তিনি এর দ্বারা বোঝাতে চাইছেন হিন্দু ও মুসলমান এই দুই বিবেচনায় ভারত দ্বিখণ্ডিত হতে চলছে। তিনি বলছেন, সেই দ্বিখণ্ডনে গভীর দুঃখের কারণ আছে। দুঃখ বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি বলছেন, এই দ্বিখণ্ডন নিয়ে নৃশংসতা হবে, সে হবে ভারতসভ্যতার অসভ্য অপমানকর পরিণাম। তিনি রাজনীতিবিদদের এ বিষয়ে সতর্ক করছিলেন, তাঁদের কেউই এ বিষয়ে সতর্ক হননি। বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা-নৃশংসতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপনকেই তাঁরা শ্রেয় মনে করেছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটা লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। সেদিন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্তে জীবন গঠনের ও বিকাশের লক্ষ্য; কিন্তু রাজনৈতিক জীবন শেষ করার আগে তাঁর মনে হলো, সে লক্ষ্য পূরণ হওয়ার মতো নয়, এর জন্য প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা কংগ্রেসে নেই, লীগেও নেই। তিনি তাঁর লক্ষ্যের ভগ্নাংশ নিয়ে খুশি থাকলেন। ভারতে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র স্থাপন করতে গিয়ে তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের অর্ধেক নিলেন পাকিস্তানে, অর্ধেককে নিতে পারলেন না, তারা হিন্দুদের সঙ্গে ভারতেই রয়ে গেল। নেহরু বললেন, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে অনেক হয়েছে, অনেক, আমি সে নিয়ে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি, মি. জিন্নাহ পাকিস্তান চাইলে, পাকিস্তান হয়ে যাক। রাজনীতিতে টায়ার্ড হয়ে যাওয়া বলে কোনো কথা নেই। রবীন্দ্রনাথ ভয়ংকর নৃশংসতা হবে জেনে মরণের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আপনাকে সতর্ক করছেন, আর আপনি-আপনারা আর পারি না, অনেক হয়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত দূরত্বে বসে রইলেন? কলকাতা রায়ট হলো, নোয়াখালী রায়ট হলো, রাওয়ালপিন্ডি রায়ট হলো, আগুনে আগুনে উত্তর ভারত পুড়ে ছাই, আপনি বলছেন টায়ার্ড হয়ে গেছি? দ্বিজাতিতত্ত্বের এই যে নৃশংস রাজনীতি, এর পরিণাম সম্পর্কে সবাই ভাবতেন না? সমাজ-সভ্যতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিশাহারা করে দেবেন?
এ সবই ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। তবে এমন ঘটবে বুঝতে পেরেই রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বার্তাটি রেখে গিয়েছিলেন ঐক্যের। ধর্ম যে মিলনের একমাত্র সেতু নয় সে কথাটি গভীরভাবে বোঝার। মানুষের মিলনের সর্বশ্রেষ্ঠ সেতু হচ্ছে মনুষ্যত্ববোধ। মনুষ্যত্ববোধ গড়ে তুলছে সংস্কৃতি, শিক্ষা হচ্ছে মনুষ্যত্ববোধ গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে তার মূলে আছে দ্বিজাতিতত্ত্বের অপপরিণামকে অস্বীকার করা ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে মনুষ্যত্ববোধকে যথার্থভাবে বিকশিত করে তোলা। রবীন্দ্রনাথ যদি ‘ভাব’ হন, বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই ভাব রূপায়ণের সংগ্রাম। বাংলাদেশ আজ যে সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছে, তাকে কাটিয়ে ওঠার যে পথটি আমরা দেখতে পাই সে হচ্ছে রবীন্দ্র-মুজিবুর ভাব-সংগ্রামের পথটিকে প্রশস্ত করে তোলা। উদারতা অর্জনই সর্বশেষ কথা। সংকীর্ণতার একটা ভয়াবহ বেগ আছে। সে ঘাবড়ে দেয়। মহত্ত্ববোধ মহত্তম শক্তিতে উদ্ব্বোধিত করে সবাইকে। ভয়ও হার মানে। রবীন্দ্রনাথ হার না মানার মালা পরাতে জানেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সম্পর্কিত খবর

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd

বিদ্যুতায়িত হওয়া থেকে বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর উপায় কী
- ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর মৃত্যু। দীর্ঘদিন ধরে ঘটছে এমন ঘটনা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এ দায় কার? বিদ্যুৎ বিভাগ অবশ্য নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য আবরণযুক্ত তার ব্যবহার করছে। বন্যপ্রাণীর মৃত্যু।
২০২১ সালে একটি পত্রিকায় খবর এসেছিল, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে।
২০২২ সাল। একটি পত্রিকায় খবর আসে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার সংরক্ষিত বনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বানর ও চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটে। বনের ভেতরে রয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। এই লাইনে জড়িয়ে অনেক বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
২০২২ সালেরই মৌলভীবাজার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ঘটনা এটি। ওই বছর মার্চের ১৩ তারিখে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে গত দুই সপ্তাহেই সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে চারটি চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু ঘটেছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০২১ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমানসহ ৯টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্টের কাছে একটি লজ্জাবতী বানর মারা যায় বিদ্যুতায়িত হয়ে। একই বছরের ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের কাছে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনায় সেখানে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে খোলা তারের পরিবর্তে আবরণযুক্ত তার প্রতিস্থাপনের চিঠি দেয়।
একটি পত্রিকার তথ্য মতে, মৌলভীবাজারের পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রায় ১১টি প্রাণী মারা গেছে। চারটি লজ্জাবতী বানর মৃত পাওয়া যায় জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলায়, তিনটি চশমাপরা বানরও মৃত পাওয়া যায় সেখানে। এ ছাড়া বড়লেখা রেঞ্জের মাধবকুণ্ড ইকোপার্কেও চারটি লজ্জাবতী বানর মারা যায়। এসব ক্ষেত্রেও আবরণহীন বৈদ্যুতিক তারের কারণে এমন ঘটছে বলে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন দাবি করছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দায় এড়াতে কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়েছে। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, বনের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে বৈদ্যুতিক তারের কোনো আবরণ নেই।
এভাবে বিদ্যুতায়িত হয়ে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ভারতেও ঘটে। সেখানকার ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ২২টি। ২০২০ সালে একইভাবে বন্যপ্রাণী মারা গেছে ১০টি এবং ২০২১ সালে ১৬টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এভাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আমরাও প্রয়োগ করতে পারি। তারা বন্যপ্রাণী চিকিৎসা পরিকাঠামো গঠন করেছে। উদ্ধার হওয়া বন্যপ্রাণীদের জন্য বিশেষ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। বৈদ্যুতিক তারগুলো ভূমি থেকে বিশেষ উচ্চতায় স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে।
প্রতিটি বন্যপ্রাণীই আমাদের দেশের জন্য একেকটি সম্পদ। এসব সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার-আপনার সবার। এ ক্ষেত্রে কেউই আমাদের দায় এড়াতে পারি না। তা বন বিভাগই হোক বা বিদ্যুৎ বিভাগ হোক বা হোক স্থানীয় জনগণ। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এসব বন্যপ্রাণীকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

সেলাই করা খোলা মুখ
নেতার নাম নেতানিয়াহু
- মোফাজ্জল করিম

আমাদের শৈশবে (উনিশ শ পঞ্চাশের দশক) যেসব বিশ্বনেতার নাম ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছি, জার্মানির একনায়ক অ্যাডল্ফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) ছিলেন তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে। তাঁর মতো আর কেউ বোধ করি মানবজাতির ইতিহাসে এত ধ্বংস ও অকল্যাণের জন্ম দেয়নি। ইহুদিদের প্রতি ছিল তাঁর এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। তিনি মনে করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) জার্মানরা ইহুদিদের কারণেই পরাজয় বরণ করেছিল।
একই ভূমিকায় মুসলিম নিধনে অবতীর্ণ হয়েছেন হাল আমলের হিটলার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই ভদ্রলোক (?) বোধ হয় রোজ কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হত্যার সংবাদ না পেলে পানিটুকুও পান করেন না! বিশেষ করে খাদ্য-পানীয়ের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনের গাজা নামক মুসলিম জনপদে অসহায় নারী ও শিশুদের মৃত্যুবরণ তাঁকে বোধ হয় এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দান করে। তাঁর এই চরম মানবতাবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর মর্মমূলে আঘাত হানছে। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা এক শ ভাগ আশীর্বাদপুষ্ট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে না।
প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র না হয় বোধগম্য কারণে ইসরায়েলকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত বড় যে মুসলিম বিশ্ব তার ভূমিকা কী? তার সদস্যরা কি কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন? তাঁদের সংগঠন ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব মুসলিম কনফারেন্স) কি অদ্যাবধি ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, যা দেখে ইসরায়েল তার হত্যাযজ্ঞ চালানোর আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে? উত্তর নিশ্চয়ই ‘না’। অথচ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই মুসলিম দেশ। তাদের এক ভ্রুকুটিতে ইসরায়েলের ঘাম ছুটে যাওয়ার কথা।
এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের অন্দরমহলে একটু ঢু মারার চেষ্টা করা যাক।
নেতানিয়াহু যে কেবল একজন হৃদয়হীন যুদ্ধবাজ নেতা তা-ই নয়, তাঁর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর একজন, যিনি দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আসামির কাঠগড়ায় নিয়মিত দাঁড়াচ্ছেন। বিজ্ঞজনদের অভিমত, নিজ দেশের মানুষের দৃষ্টি তাঁর পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি থেকে অন্যদিকে ফেরানোর মতলবেই তিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সে যা-ই হোক, তিনি দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানান আর পর্বত বানান, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, আমাদের প্রাণ কাঁদে ওই সব মৃত্যুপথযাত্রী ক্ষুিপপাসায় কাতর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জন্য, বিশেষ করে কুসুমকলি অবুঝ শিশুদের জন্য, যাদের উদ্দেশে প্রেরিত ত্রাণটুকুও ইসরায়েলি পাশব বাহিনী গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে যেতে দেয় না। হায়! একদিকে গাজায় হয় বোমার আঘাতে, না হয় খাদ্যাভাবে প্রতিদিন অকালে ঝরে পড়ছে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু আর অন্যদিকে এই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো শান্তির ললিত বাণী গেয়ে শোনায় বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত।...ঠাট্টা আর কা’কে বলে!
ভালো কথা, শেষ করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে দেখে নিই। সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের এই দেশের। এ দেশের মানুষ যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশে অন্যায়-অত্যাচার করে কেউই পার পেতে পারেনি। বিশ্বের কোথাও ‘অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ’ উত্তোলিত হতে দেখলে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আশ্বর্য, সেই বাংলাদেশ ইসরায়েলের ব্যাপারে কেমন জানি উদাসীন। এই যে প্রতিনিয়ত শত শত অবোধ শিশু ও অসহায় নারী-পুরুষ বলি হচ্ছে ইসরায়েলি যূপকাষ্ঠে, তারা মুসলমান না ইহুদি, খ্রিস্টান না হিন্দু, আস্তিক না নাস্তিক, সেটা বড় কথা নয়, তাদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয় তারা মানুষ। তারা অসহায় নিরপরাধ মানুষ। এই পৃথিবীতে আপনার, আমার এবং ওই নরখাদক নেতানিয়াহুর যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তাদেরও আছে সেই সমান অধিকার। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে সদা সোচ্চার বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে এই নির্লিপ্ত আচরণ নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। ইসরায়েলের, বিশেষ করে তার খুনি নেতা নেতানিয়াহুর, এই নরমেধযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও তেমন সোচ্চার হতে দেখি না। কেসটা কী? তাহলে এখানেও কি সেই ‘বড় মিয়া ফ্যাক্টর’ কাজ করছে? কী জানি! বলতেই হয়, ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি!’
অগত্যা অগতির গতি দয়ামত আল্লাহপাকের দরবারে অসহায় ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য প্রার্থনা জানিয়ে শেষ করছি। আমিন। সুম্মা আমিন। সুধী পাঠক-পাঠিকা, আশা করি, আপনারাও নিশ্চয়ই এই প্রার্থনায় শরিক হবেন। আমিন।
লেখক : সাবেক সচিব ও কবি
mkarim06@yahoo.com

স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরা মৌসুমি ফল ও তার বাজার
- ড. জাহাঙ্গীর আলম

আম, লিচু, আনারস ও কলা প্রচুর পরিমাণে বাজারজাতকরণ হচ্ছে। কাঁঠালও প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করেছে বাজারে। কৃষি অর্থনীতিতে এই ফলগুলোর গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গরমে অতিষ্ঠ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মনে এ সময় শান্তির পরশ বোলায় বিভিন্ন রসালো ফলের বিপুল জোগান।
এ দেশে ফলের উৎপাদন হয় প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টন। এর ৫০ শতাংশই উৎপাদিত হয় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে। বাকি ৫০ শতাংশ উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ৯ মাসে। কয়েকটি ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০ বছর ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ১২.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আম। ১৫ মে থেকে শুরু হয়েছে আম পাড়া। প্রথমেই গুটি, হিমসাগর, গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, মিশ্রিভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া ইত্যাদি আগাম জাতের আম পেড়ে নেওয়া হয়। এরপর বাজারে আসে হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও ফজলি আম সামনে বাজারে আসছে। বারি আম-৪, আশ্বিনা ও গৌরমতি আসবে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। কাটিমন ও বারি ১১ জাতের আম সরবরাহ হয় বছরব্যাপী। ক্ষীরশাপাতি আম বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই আম শ্বাস ও আঁশবিহীন, রসালো। গন্ধে বেশ আকর্ষণীয় এবং স্বাদে মিষ্টি। হাঁড়িভাঙ্গা আমও অত্যন্ত সুস্বাদু ও আঁশবিহীন। জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্যান্য আমের মধ্যে আছে ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ফজলি ও নাক ফজলি। এগুলোর বিশেষত্ব আলাদা। আগে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরেই ভালো জাত ও মানের আম হতো বেশি। এখন নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেশেই ভালো জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দুই বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে। গত বছর আম রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩২১ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের মাত্র ০.০৫৫ শতাংশ। এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ হাজার টন। বিশ্বে আম রপ্তানি হয় প্রায় এক বিলিয়ন মেট্রিক টন। এতে বাংলাদেশের শরিকানা ১.৫ শতাংশ। বৈশ্বিক আমের বাজারের আকার প্রায় ৬৭.৪ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশের হিস্যা অনুল্লেখযোগ্য।
মোট উৎপাদনের দিক থেকে আমের পর কাঁঠালের অবস্থান। উৎপাদন প্রায় ২০ লাখ টন। আরো আছে কলা, যার উৎপাদন প্রায় ১৯ লাখ টন। পেঁপে, পেয়ারা ও আনারসের উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় ১১ লাখ, পাঁচ লাখ ও ছয় লাখ টন। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে আমরা দ্বিতীয় এবং আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছি। স্বাদে ও জনপ্রিয়তায় আমাদের দেশে লিচুর অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মোট উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। তবে আম সবার প্রিয় ও সুস্বাদু। এবার আমের উৎপাদন ভালো। লক্ষ্যমাত্রা ২৭ লাখ টন।
আম উৎপাদনকারীরা এখন খুবই দুশ্চিন্তায়। উৎপাদিত ফল উপযুক্ত দামে বিক্রি করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, বাগানের খরচ উঠে আসবে কি না—এসবই দুশ্চিন্তার কারণ। মৌসুমি ফল পাকা ও পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করতে হয়। নতুবা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সাধারণত মৌসুমি ফল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অপচয় হয়। অনেক সময় বাজারজাতকরণের ধীরগতির কারণে তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের বর্তমান ভরা মৌসুমে আমাদের কৃষি বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে খামারপ্রান্ত থেকে আম, কাঁঠাল ও আনারস কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে তা বাজারজাত করা যেতে পারে। গরিব মানুষের মাঝে ত্রাণ হিসেবেও আম-কাঁঠাল বিতরণ করা যেতে পারে। তা ছাড়া আম, কাঁঠাল ও আনারস পরিবহনের জন্য বিআরটিসির উদ্যোগে ট্রাক চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ইদানীং অনলাইনেও ফল বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের গাফিলতির জন্য তা সুনাম হারাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সড়কপথে বাধাহীন ফল পরিবহনকে উৎসাহিত করা উচিত। তদুপরি আম ও অন্যান্য মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত বৃহৎ কম্পানিগুলো এ সময় তাদের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়ে ফলের দরপতন ও অপচয় থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে পারে। তা ছাড়া দেশের ফল চাষিদের সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে ফল রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমাদের মৌসুমি ফল এরই মধ্যে চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি করা ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, জড়ালেবু, এলাচি লেবু, কুল, সাতকরা, আমড়া, সুপারি, জলপাই, পেয়ারা ও কলা। বিদেশে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি ফল রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সাত বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের আম রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহী ও সাতক্ষীরার চাষিরা অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন এবং উত্তম কৃষি কার্যক্রম অনুসরণ করে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করছেন। এর উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্য বেশি। দেশের সুপারমার্কেটগুলো উন্নতমানের আম বাজারজাতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশ থেকে ফল রপ্তানির আয় হ্রাস পেয়েছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি প্রণোদনা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করায় সম্প্রতি ফল রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়নি। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশি ফলের আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বগামী হবে বলে আশা করা যায়।
এখন একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আম কূটনীতি। গত বছর জুন মাসে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের রাজশাহীর কিছু আমবাগান পরিদর্শন করানো হয়েছে। এতে তাঁরা বাংলাদেশের আম উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। উৎপাদন এলাকায় গিয়ে আমের স্বাদ অনুভব করতে পেরেছেন। এরপর চীনসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। এবার চীন থেকে ৫০ হাজার টন আম নেওয়ার কার্যাদেশ এসেছে। অন্যান্য দেশও আমদানির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া অতীতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে পাকা আম। এতে আমাদের আম রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে কর্মরত। আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই রেমিট্যান্স হিসেবে আসে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ওই সব দেশে আমাদের আম উপহার ভ্রাতৃত্ব ও আত্মার সম্পর্ক জোরদার করবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের আম কূটনীতি আরো জোরদার ও অর্থবহ হোক, এই কামনা সবার।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ
সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য
ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ