<p>একসময় বগুড়ার নাম এলে বগুড়ার দইয়ের কথাও উঠত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বগুড়ার চিকন সেমাই বা সাদা সেমাইয়ের নাম। বিশেষ করে রমজান মাসে চিকন সেমাইয়ের কদর যেমন থাকে, তেমনি তা বছরজুড়েও ভোজনরসিকদের কাছে বেশ পরিচিত একটি খাবার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। জেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশজুড়ে সমাদরের স্থান করে নেওয়া এই সেমাই তৈরিতে অবদান খুঁজতে গেলে নারীদের কথাই চলে আসে। কারণ এখানকার বিপুলসংখ্যক নারী সেমাই তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বগুড়ার সেমাইপল্লীতে ঈদকে সামনে রেখে এখন পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা।</p> <p>বগুড়া পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণাংশে অবস্থিত বেজোড়া গ্রামে প্রায় ৩৮ বছর আগে চিকন সেমাই তৈরি শুরু হয়। হাতে গোনা কজন এ কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে জেলার অন্যান্য এলাকাতেও এই শিল্প ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ওই গ্রামের পার্শ্ববর্তী কালসিমাটি, শ্যামলা কাথিপাড়া, রবিবাড়িয়া, নিশ্চিন্তপুর এবং সদর উপজেলার এরুলিয়া, কুমিড়া গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় চিকন সেমাই তৈরি হচ্ছে। ভোর থেকে শুরু হয় সেমাই তৈরির কাজ। শুকানো হয় বিকেল পর্যন্ত। এসব কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। যার বেশির ভাগই নারী। তাঁরা ময়দায় পানি মিশিয়ে খামির বানিয়ে মেশিনের সাহায্যে সেমাই তৈরি করেন। সেখান থেকে চাতাল বা খলায় নিতে হয় শুকানোর জন্য। পরিমাণমতো সেমাই হাতে ভাঁজ করে রোদে শুকিয়ে কখনো তা প্যাকেটজাত করে, কখনো বা খাঁচিতে ভরে শহরে নেওয়া হয় বিক্রির জন্য।</p> <p>কারখানার মালিকরা জানান, বগুড়া জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বগুড়া থেকে চিকন সেমাই সরবরাহ করা হয়।</p> <p>কারখানা মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাকে করে জেলার বাইরে সেমাই পাঠাতে হয়। কিন্তু পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে জেলার বাইরে সেমাই পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ মৌসুমের শুরু থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে সেমাই নিতে অর্ডার আসছে।’</p> <p>ফজলুর রহমান বলেন, ‘আগে হস্তচালিত মেশিনে সেমাই তৈরি করা হতো। সময়ের ব্যবধানে বিদ্যুত্চালিত মেশিনের সাহায্যে আধুনিক পদ্ধতিতে সেমাই তৈরি করা হচ্ছে। ফলে উৎপাদনের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। যদিও বিদ্যুতের লোড শেডিংয়ের কারণে অনেক সময় উৎপাদন ব্যাহত হয়।’</p> <p>বেশির ভাগ কারখানাতে গ্রামের নারী শ্রমিকরা কাজ করেন। এসব কারখানায় কাজ করে তাঁরা দিনে দুই শ থেকে আড়াই শ টাকা মজুরি পান। এতে করে যেমন তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, তেমনি পরিবারের বাড়তি উপার্জনের পথও তৈরি হয়েছে।</p> <p>কালসিমাটি গ্রামের নারী শ্রমিক রোকসানা বেগম জানান, পুরো রমজান মাসই কাজ চলে। বিদ্যুৎ থাকলে কারখানায় ১০ থেকে ১৫ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করা হয়।</p> <p>সাদা সেমাই তৈরির কারিগর সফুরা বানুসহ একাধিক শ্রমিক জানান, তাঁরা পাঁচ থেকে সাতজন করে দলবদ্ধভাবে কারখানাগুলোতে কাজ করেন। এক বস্তা (৫০ কেজি) ময়দার সেমাই বানিয়ে তাঁরা পারিশ্রমিক পান ১৭০ থেকে ২০০ টাকা। দিনে প্রতিটি দল ১০ থেকে ১৫ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি করতে পারেন। এতে যা টাকা পাওয়া যায়, সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেন তাঁরা।</p> <p>বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, ‘বগুড়ার গ্রামাঞ্চলেই মূলত এই শিল্প গড়ে উঠেছে। এ কারণে গ্রামীণ নারীরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি বগুড়ার বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। পরিবহন ব্যয় কমানো গেলে এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলে এই শিল্প অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।’</p> <p> </p> <p> </p>