<p>অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত বছর পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে বেড়াতে গিয়েছিলেন বন্ধু সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের কালজয়ী কথাসাহিত্যিক সমরেশ তাঁর প্রিয় ‘আনিস দা’র মৃত্যুতে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত আলাপে সেই জঙ্গল ভ্রমণের স্মৃতিচারণা করলেন—</p> <p>আমার জন্ম চা বাগানে এবং তাই আমাদের আড্ডায় আমি মাঝে মাঝে আনিস দাকে চা বাগানের গল্প শোনাতাম। উনি বলতেন উনি একবার চা বাগান যাবেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তারপর উনার শরীর খারাপ হলো। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যেতে হলো। এরপর গত বছর যখন কলকাতায় এলেন, আমায় বললেন উনি এবার যাবেন চা বাগানে আমার সঙ্গে। উনার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। আমরা তিনজন গেলাম উত্তরবঙ্গের একটা চা বাগানে। চা বাগানে আমাদের খুব ভালো সময় কাটছিল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো আমরা পাশে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ঘুরতে যাব। চা বাগানের ম্যানেজার আমাদের গাইড হলেন। আর উনি বললেন কপাল ভালো থাকলে দু-তিনটা হরিণ দেখা যেতে পারে। কারণ গাড়ির আওয়াজে জন্তু-জানোয়ার জঙ্গলের ভেতরে পালিয়ে যায়। দুটো গাড়ি করে বেরোলাম আমরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আমরা চললাম; যাওয়ার পথে আনিস দা আমায় বললেন, আমার কপালে কোনো দিন এসব জিনিস দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে তোমার জন্য জঙ্গলে আসা তো হলো।</p> <p>এসব কথা হচ্ছে, এমন সময় কিছু বাইসন দৌড়ে এলো। ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন আর আমাদের বললেন, আপনারা কোনো কথা বলবেন না; কারণ বাইসনরা  খুব হিংস্র হয়। আমরা ভয়ে গাড়িতে বসে রইলাম, বাইসনরা আমাদের কিছুক্ষণ দেখল, তারপর পাশ কেটে চলে গেল।</p> <p>আমি আনিস দাকে বললাম, আপনার পাণ্ডিত্বের জন্য আমাদের আক্রমণ করল না। আনিস দা বললেন, ইয়ার্কি মেরো না, আমার কিন্তু খুব ভয় করছিল। তারপর এলো একটা গণ্ডার। তারপর একদল বুনো হাতি। একের পর এক জন্তু আসছে, আনিস দাকে দেখছে আর চলে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম।</p> <p>সেই ম্যানেজার আমাদের বললেন, তাঁর এত দিনের চা বাগানের জীবনে উনি কোনো দিন এত জন্তু-জানোয়ার দেখেননি। আমি বললাম, সব জন্তু-জানোয়ার যেন আনিস দাকে দেখতে এসেছিল। তারপর সন্ধ্যাবেলার দিকে আমরা যখন ফিরছি, গাড়ির পাশ দিয়ে দুটো হরিণ দৌড়াতে শুরু করল। সেই ম্যানেজার আনিস দাকে বললেন, দেখেছেন স্যার, আপনি এসেছেন বলে জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার একে একে এসে আপনাকে গার্ড অব অনার দিয়ে গেল।</p> <p>জলদাপাড়া থেকে ফেরার পর আনিস দা আমায় বললেন, সমরেশ বিশ্বের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু তোমার জন্য জঙ্গলে এত সুন্দর ঘোরা হলো। আমার হাত ধরে উনি ধন্যবাদ বলছিলেন। আজ একটু আগে আনিস দা চলে যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর আমার জলদাপাড়ায় ঘুরতে যাওয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল। উনার সঙ্গে ২৫ বছরের বন্ধুত্ব। উনার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না।</p>