<p>স্থানটির নাম ময়লাপোতা। বোঝাই যায়, ময়লা ফেলার স্থান হতে এমন নামকরণের উৎপত্তি। জনবসতি বাড়তে থাকে, ময়লা ফেলার স্থান পরিবর্তিত হয়; এলাকাবাসীও উৎসাহের সঙ্গে সেই এলাকায় একটি স্কুল গড়ে তোলেন। নাম দেন সোনাপোতা বিদ্যালয়। মানে এলাকাটির নাম সোনাপোতা। বর্তমানে এর নাম বঙ্গবন্ধু চত্বর; যদিও নামটি এখনো খুব পরিচিত হয়নি। তবে এলাকাটির জৌলুস ও গুরুত্ব দুই-ই বেড়েছে। সময়ের ব্যবধানে এলাকাটির গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে যুগের চাহিদা মেটাতে বিশাল বিশাল উঁচু ভবনও এখানে গড়ে উঠছে। খুলনা শহরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন (১৬ তলা) এখন ওই এলাকায়। এখনো পর্যন্ত উঁচু ভবনটি ২২ তলার সোনাডাঙ্গা-গল্লামারী রোডের পাশে। </p> <p>হ্যাঁ, বলছি; প্রিয় শহর খুলনার কথা। শহরবাসী মাত্রই ময়লাপোতা চেনেন, নতুন কেউ এলেও চিনতে কষ্ট হয় না। কারণ, এলাকাটি এখন শহরের অন্যতম একটি ব্যস্ততম এলাকা। আগে যেখানে ভবন ছিল না বললেই চলে, এখন সেখানে অনেকগুলো উঁচু ভবন। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ব্যস্ততা বাড়ে। সেখানে মধ্যরাতেও মানুষের শোরগোল থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালে, ১৯৭১-এ এলাকাটি ছিল বেশ নির্জন। তবে সড়কটি ছিল অপেক্ষাকৃত সরু। যেটি মিশেছিল ময়ূর নদের ওপর কাঠের সেতু পার হয়ে ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে বিলের মধ্যের একটি একতলা ভবনে। চারিদিকে বিল, ধানের ক্ষেত; ডোবা, নিচু ভূমি। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছিল খুলনা রেডিও সেন্টার।</p> <p>ময়লাপোতা মোড় থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটারের এই প্রায় নির্জন সড়ক ধরেই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় জেগে ওঠা মানুষদের গাড়ি ভরে নিয়ে গিয়ে নির্জনতর ময়ুর নদ ও তার আশেপাশের এলাকায় হত্যা করতো এবং তাদের নিথর দেহ ফেলে দিত। রেডিও সেন্টারটি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের দখলে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যবহৃত হয়েছে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে। আরো একটি ভয়াবহ নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সার্কিট হাউসের পেছনের হেলিপোর্টের বিশ্রামাগার। ওই নির্যাতন কেন্দ্র হতে নির্যাতিত মৃতপ্রায় মানুষদের কয়েক পা দূরত্বের ফরেস্ট ঘাটে নিয়ে গিয়ে জবাই করা হতো। আর দলে দলে ধরে আনা, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতিতদের নিয়ে যাওয়া হতো গল্লামারীতে। </p> <p>হেলিপোর্টের সেই আটচলা টিনের ঘরের বিশ্রামাগারটি আজ আর নেই। সেখানে এখন সার্কিট হাউসের সুউচ্চ ভবন। মুক্তিযুদ্ধকালের সেই মর্মন্তুদ ঘটনাবলির কথা ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’-এর পক্ষ হতে সার্কিট হাউসের প্রবেশমুখের বামপাশে স্থাপিত একটি ফলকে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালের গল্লামারীর চেহারায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেই নির্যাতন কেন্দ্রটি এখন দ্বিতল ভবন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে ওই ভবনেই উপাচার্য বসতেন। আর রেডিও সেন্টারের পুরো জায়গাটি, একাত্তরের গণহত্যাস্থলের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।  </p> <p>আজকের খুলনা শহরে নতুনত্বের ছোঁয়া চারিদিকে। ময়লাপোতা মোড় থেকে পশ্চিমমুখো সোজা তাকালে দুই পাশে সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবনের সারি। যা দশ বছর আগেও ছিল না। দশককাল আগেও খুলনা ছিল ভৈরব-রূপসা নদীর তীর ঘেঁষা লম্বাকৃতির (লিনিয়ার) একটি ছোট্ট শহর। সাতচল্লিশোত্তর কালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকে খালিশপুরের ঘনবসতি এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়। ভৈরবের তীর ঘেঁষে জুট মিল, কাগজ কল, হার্ডবোর্ড মিল গড়ে ওঠে। অদূরে দৌলতপুরে পাটের মোকাম। </p> <p>দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নির্মিত নৌযান ভেড়ার জেটিকে ঘিরে পণ্য ওঠানো-নামানোর কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে ৪নং, ৫নং, ৬নং ঘাট। ভৈরব-রূপসা-কাজীবাছার ভাটিতে চালনার বন্দরটিকে আরো একটি দক্ষিণে নিয়ে পশুর-মংলার সঙ্গমস্থলের মংলা নালার (নদী) দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠে মংলা বন্দর। বন্দরের প্রশাসনিক ভবন গড়ে ওঠে ১৯৮০-এর দশকে মংলা নদীর উত্তর পাড়ে। ওই এলাকাটিও ছিল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। খুলনা পরিচিত হয়ে ওঠে শিল্প ও বন্দর নগর হিসেবে।  </p> <p>ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে খুলনা জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা ছিল বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত। আলিপুর বোমা মামলার আসামি ছিল এই খুলনার ছেলেরা। আবার ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী, ধৃত জেলবন্দি এবং পরবর্তীতে রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত আনোয়ার হোসেন এই জিলা স্কুলের ছাত্র। ভাষা সংগ্রামের দায়ে ধৃত এবং প্রথম শহীদ আশাশুনির বুধহাটার এক গবিব বিধবার সন্তান এই আনোয়ার। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর এই খুলনা আশ্রয়স্থল হয়েছে মর্মান্তিক যাতনা নিয়ে উদ্বাস্তু, হিন্দু সন্তান ত্যাগে বাধ্য হওয়া হাজার হাজার উর্দুভাষী। আর খুলনা ছেড়েছে প্রধানত: নিরাপত্তাহীনতা এবং রাজনৈতিক কূটচালের শিকার হয়ে হাজার হাজার হিন্দুরা। একবার ৪৭-এ গেছে। আবার ৬৪-র দাঙ্গার জেরে গেছে। দেশত্যাগের ধারা চলেছে, মুক্তিযুদ্ধকালের আগে ও পরে।</p> <p>খুলনা তখন যশোর জেলার মহকুমা শহর। সুন্দরবন কেটে আবাদ গড়ে তোলা ভূমিতে কৃষক নেতা রহিমউল্লাহকে ইংরেজ লীজগ্রহীতা মোরেল নৃশংসভাবে হত্যা করে। যদিও দুঃখজনকভাবে সেই এলাকার নাম ওই মোরেলদের নামানুসারে আজও মোড়েলগঞ্জ। ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আসেন তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট, পরবর্তীকালের সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়। পরবর্তীতে তিনি খুলনার এসডিও হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। গড়ে তোলেন ভৈরবের পূর্বপাড়ে তাঁর অফিস তথা বাংলো। যা আজও জেলা প্রশাসকের বাংলো। অধুনা খুলনার দামী ও সমৃদ্ধ এলাকা নিরালা ও সোনাডাঙ্গা তখন জলাভূমি। নিরালা পাড়ে সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকতো। মানুষ নৌকায় যাতায়াত করতেন। পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকার নাজিরদের ঘাটটিও ছিল নৌকায় যাত্রী ওঠানামার ঘাট। যা আজও নাজিরঘাট বলে মানুষ জানে। অদূরের ময়ূর নদে গলদা চিংড়ি ধরার ধূম চলতো। তা থেকে কবে যেন এই এলাকার নাম হয় গল্লামারী।</p> <p>তবে স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় খুলনা এগোয়নি। সময়কে ধারণ করে পুঁজি বিনিয়োগ হয়নি, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাও তেমন ছিল না। আইযুবী উন্নয়ন দশকের কালে খুলনা-মংলা রেলের জন্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল; তখন খুলনা-মংলা রেল লাইন হয়নি। এখন খুলনা-মংলা রেল লাইন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে কল-কারখানা ব্যক্তি মালিকের কাছে ছেড়ে দিলেও পুঁজি প্রবাহ বাড়েনি। শ্রমিকদের স্পন্দন থিতিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়া, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র পরামর্শ হুবহু অনুসরণ করায় সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত পাটকলগুলো একে একে বন্ধ হয়েছে। </p> <p>বর্তমানে খুলনায় উঁচু উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে। আবাসন খাতে পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে। রাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে এখন বেশ কিছু খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। পদ্মা নদীর ওপর সেতু হয়েছে। আন্তঃদেশীয় ও আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির মহাপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু শহর খুলনার জেগে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অবশ্য, ব্যবসায়ী রূপচাঁদ সাহার উদ্যোগে ভৈরব ও কাজীবাছার সংযোগ সৃষ্টিকারী খনন করা খালটি, যা আজ বিশাল রূপসা নদী, তার উপর বেশ আগেই সেতু হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে রূপায়িত হলে অর্ধশতক বা শতককাল পরে এই খুলনা শহর হয়ে উঠবে শুধুমাত্র দেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা শহর। </p> <p>এই অঞ্চলটি ছিল সুন্দরবনের অংশ। বন কেটে আবাদ করে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। আইন-ই-আকবরীতে এই অঞ্চলটি ভাটি এলাকা বলে বর্ণিত হয়েছে। খাজা খান জাহান আলীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই এলাকাটিতে বসতির বিস্তার ঘটে। অবশ্য, তাঁর সময়ে বিকশিত এলাকাটি প্রধানত: বাগেরহাট এলাকা। ওই সময়ে এলাকাটির নাম ছিল খলিফাতাবাদ। ইংরেজ আমলে ১৮৪২ সালে যশোর জেলার প্রথম বিভাগ সৃষ্টি হয় খুলনা নামে। যেটি বাংলারও প্রথম মহকুমা। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমার সৃষ্টি। এর দু’বছর আগে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরা মহকুমার সৃষ্টি। যা ছিল ২৪ পরগণা জেলাভুক্ত। ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট এবং ২৪ পরগণা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলার সৃষ্টির নোটিশ জারি হয়। যার কাজ শুরু হয় ১ জুন। জেলা সদর হয় খুলনা। তখন মধুমতি নদীর ওপারেও খুলনা জেলার বিস্তৃতি ছিল।</p> <p>১৯১৩ সালে মধুমতি নদীকে সীমানা বিভাজনকারী নদী হিসেবে চিহ্নিত করে খুলনা জেলার এলাকা পুন:নির্ধারণ করা হয়। খুলনা পৌরসভা হয় ১৮৮৪ সালে। এক শ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশনে (কেসিসি) উন্নীত হয়। বলাইবাহুল্য, আগামী শত বছরের মাথায় এই খুলনা হয়ে উঠবে আরো জনবহুল, নন্দিত এক শহর; যেখানে কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মমুখরতায় সকলেই হবে উদ্দীপ্ত। এগিয়ে যাক খুলনা! জয়তু খুলনা!!</p>