তিন দশক আগে পাবনার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আসামিদের সবাই বিএনপির নেতাকর্মী। প্রায় ছয় বছর আগে পাবনার আদালত ৯ জনের ফাঁসি, ২৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৩ জনকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল, জেল আপিল মঞ্জুর ও ডেথ রেফারেন্স মঞ্জুর করে গতকাল বুধবার বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম ও বিচারপতি মো. হামিদুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতের রায়টি বাতিল করা হয়েছে।
গত ৩০ জানুয়ারি এই মামলায় আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষ হয়। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী কায়সার কামাল, কামরুজ্জামান মামুন ও জামিল আক্তার এলাহী। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মাকসুদ উল্লাহ।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মজিবুর রহমান।
যে ঘটনায় মামলা ও বিচার : ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর খুলনা থেকে ট্রেনে ঈশ্বরদী হয়ে সৈয়দপুরের দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। তাঁকে বহনকারী ট্রেনটি ঈশ্বরদী স্টেশনে ঢোকার মুহূর্তে ট্রেন ও শেখ হাসিনার কামরা লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। পরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ট্রেনটিতে ফের হামলা চালানো হয়।
এ ঘটনায় দলীয় কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে শেখ হাসিনা ঈশ্বরদী ত্যাগ করেন। পরে ঈশ্বরদী রেলওয়ে (জিআরপি) থানার ওই সময়কার ওসি বাদী হয়ে ছাত্রদল নেতা ও ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টুসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলা করার পর ওই বছর কোনো সাক্ষী না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ।
বিচার শেষে ২০১৯ সালের ৩ জুলাই পাবনার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৩-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক ও অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রোস্তম আলী ৯ জনের ফাঁসির আদেশ দেন। এ ছাড়া ২৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১৩ জনকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সেই সঙ্গে যাবজ্জীবন সাজার আসামিদের তিন লাখ টাকা করে এবং ১০ বছরের সাজার আসামিদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। বিচারের সময় ৩২ জন আসামি আদালতে হাজির ছিলেন। রায়ের পর ১৪ জুলাই যাবজ্জীবন সাজার আরো সাত আসামি আত্মসমর্পণ করেন।
ফাঁসি থেকে খালাসপ্রাপ্তরা হলেন এ কে এম আক্তারুজ্জামান, মো. জাকারিয়া পিন্টু, মোখলেছুর রহমান বাবলু, রেজাউল করিম শাহীন, শহীদুল ইসলাম অটল, আজিজুর রহমান ফড়িং, শ্যামল, মাহাবুবুর রহমান পলাশ ও শামসুল আলম।
এই রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি আসামিরাও আপিল করেন। ওই বছর ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট দণ্ডিতদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। গত ৩০ জানুয়ারি সেসব আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের চূড়ান্ত শুনানির পর উচ্চ আদালত রায় ঘোষণা করলেন।
ভাষার মাসে বাংলায় রায়
রায় ঘোষণার আগে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, এই মামলার বিষয়বস্তু অনেক বিস্তৃত। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হবে। যেহেতু ফেব্রুয়ারি মাস মহান ভাষা আন্দোলনের মাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত রায়টি বাংলায় ঘোষণা করা হবে। এরপর রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ের পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিচারিক আদালত যে রায় দিয়েছেন, ‘তা পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিশেষ কোনো ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত। বিচারিক আদালতের রায়ে বিচারকের বিচারিক মননের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বিজ্ঞ বিচারক গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে এই রায় দিয়েছেন। এ যেন বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার মতো। মূলত এটি একটি বিদ্বেষপ্রসূত মামলা, যেখানে তিলকে তাল করা হয়েছে।’
পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে আপিলের সিদ্ধান্ত নেবে রাষ্ট্রপক্ষ
রায় নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অবস্থান জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে আদালতকে সহযোগিতা করে থাকি। আইন কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের ভূমিকা রাষ্ট্রের পারপাস সার্ভ করা। আমাদের কাজ হলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে আদালতের বিচারকাজে সহযোগিতা করা। এই মামলার নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে আমার মনে হয়েছে হাইকোর্ট উপযুক্ত রায় দিয়েছেন।’
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, জানতে চাইলে মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে এ রায়ের বিষয়ে নোট দেওয়া হবে। তা ছাড়া পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ওপর হামলা
এই মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকালে পাবনার ঈশ্বরদী থেকে বিএনপির কয়েক শ নেতাকর্মী সুপ্রিম কোর্টে এসে জড়ো হন। রায় ঘোষণার সময় তাঁদের অনেকে অদালতকক্ষে এবং আদালতের বারান্দায় অবস্থান নেন। রায় ঘোষণা শেষে তাঁরা এনেক্স ভবনের সামনে এসে অবস্থান নেন। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন মামলার রায় ও আদেশের বিষয়ে সংবাদকর্মীদের ব্রিফ করে থাকেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
গতকাল এই ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় শেষে ঈশ্বরদী বিএনপির কয়েক শ নেতাকর্মী সংবাদ মাধ্যমের ডায়েস ঘিরে অবস্থান নেন। তখন ডায়েসে দাঁড়ানো ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. হাবিবুর রহমান হাবিব। সাংবাদিকরা এই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ব্রিফ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীরা সাংবাদিকদের সেই সুযোগ না দিয়ে হট্টগোল শুরু করেন। এর প্রতিবাদ করলে এটিএন নিউজের প্রতিবেদক জাবেদ আখতারের ওপর চড়াও হন তাঁরা। উপর্যুপরি কিলঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন তাঁরা এই সাংবাদিককে। এই নেতাকর্মীদের হামলার হাত থেকে জাবেদকে রক্ষা করতে গেলে অন্য সংবাদিকরাও হামলার শিকার হন। পরে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকরা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ব্রিফ বর্জন করেন। পরে এনেক্স ভবনের সামনে ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম রেখে অবস্থান নিয়ে এই হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান সাংবাদিকরা।
এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে এবং তাঁদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দাবি করেছে সুপ্রিম কোর্ট বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট রিপোর্টার্স ফোরাম (এসআরএফ) ও ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)।