গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বনির্ধারিত পদযাত্রা ও সমাবেশে হামলার ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে পতিত হলেও স্বৈরাচারের চরিত্র পাল্টায়নি। তাদের হামলায় বুধবার গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলা হামলা-সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন।
জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করুন
- গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা

গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বুধবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর গোপালগঞ্জে পৌঁছার আগেই সকাল সাড়ে ৯টায় সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চরপাড়ায় ছাত্রলীগের কর্মীরা পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন তিন পুলিশ সদস্য হামলার শিকার হন। সকাল ১১টায় টেকেরহাট সড়কের কংশুরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতেও হামলা চালালে গাড়িচালক মো. মইন আহত হন। কেন্দ্রীয় নেতারা দুপুর ২টার পর সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শুরু হয়। বিকেল পৌনে ৩টায় সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় আবারও প্রমাণ হলো দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কতটা জরুরি। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনী গোপালগঞ্জের সহিংসতাকে যেভাবে মোকাবেলা করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাদের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে এনসিপির নেতাকর্মীরা রক্ষা পেয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
নিকট অতীতে দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মতপ্রকাশের অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। দেশের সম্পদ লুটপাট করা হয়েছিল। আর এসব কারণে গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের মানুষ একযোগে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল। তারা আবারও নানাভাবে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এসব অপচেষ্টা প্রতিরোধে দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সম্পর্কিত খবর

গ্রাহকদের সঞ্চয় নিশ্চিত করুন
- ব্যাংক একীভূতকরণ

দেশের দুর্বল কিছু ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করে সারা দেশে হাজার হাজার আমানতকারী চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিপদে-আপদেও তাঁরা সঞ্চিত অর্থ তুলতে পারছেন না অথবা তাঁদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন দুর্বল পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক—এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্বল পরিচালনা ও ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক অবস্থার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ রাখা হবে—এ প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা পুনর্গঠনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় কর্মীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দুর্বল এই ব্যাংকগুলো কেন এমন অবস্থায় পৌঁছাল? অনিয়ম ও অদক্ষ পরিচালনার কারণে যদি ব্যাংকগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে থাকে, তবে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
তিন থেকে পাঁচ বছর সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ধীরে ধীরে নতুন ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, স্বচ্ছ নীতি ছাড়া বেসরকারীকরণ নতুন করে দুর্বলতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো নির্ধারণে স্বচ্ছ রোডম্যাপ প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত ব্যাংক একীভূতকরণের এই পদক্ষেপ সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর। আমানতকারীদের আস্থা পুনর্গঠন এবং আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করতে হলে কেবল নতুন নাম বা কাঠামো নয়, কার্যকর সংস্কারই হতে হবে মূল চালিকাশক্তি। আর এ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ যেন শতভাগ সংরক্ষিত হয় তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

আসন্ন নির্বাচন হোক প্রশ্নহীন
- দায়িত্ব ফিরে পাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে তিনটি জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু স্থানীয় নির্বাচনে যে লাগামহীন দুর্নীতি ও ভোট চুরির ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, তা আজ দিনের মতোই স্পষ্ট। আর এসব অনিয়ম রোধে সশস্ত্র বাহিনী যাতে কোনো ভূমিকা না রাখতে পারে, সে জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে নির্বাচনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে একজন আনসার সদস্যের যে ক্ষমতা ছিল, একজন সেনা সদস্যের তা-ও ছিল না। আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশবাসী বিশ্বাস করে, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই বিশ্বাস থেকেই ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলোতেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলোকে বাদ দেয়।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশন গত ১১ আগস্ট আরপিও সংশোধনের জন্য যেসব প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, তাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবটিও রয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুসারে এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়নের পথে। এর ফলে নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পুলিশ কর্মকর্তাদের মতোই নির্বাচনী অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
আমাদের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি এখানে কালো টাকা ও পেশিশক্তি অনিয়মে বড় ভূমিকা পালন করে। সেসব নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা এবং ভূমিকাও থাকে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই মানুষ জাতীয় নির্বাচনসহ বড় পরিসরের স্থানীয় নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কামনা করে।
আমরা আশাবাদী, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অত্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং তা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে
- সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা

রাজধানী ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় অবস্থান করছে। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ভয়াবহ বাস্তবতায় পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করেছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এটি নিঃসন্দেহে একটি যুগোপযোগী উদ্যোগ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাভারের বাতাসে দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি।
আমরা মনে করি, সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে এই ঘোষণা শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।
তাই ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণাকে সফল করতে হলে প্রথমেই অবৈধ ভাটা উচ্ছেদ, নির্ধারিত প্রযুক্তির বাইরে ইট পোড়ানো বন্ধ এবং কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া জনগণকে সচেতন করতে হবে। নীরব এলাকা বাস্তবায়নে যেমন প্রচার-প্রচারণার ঘাটতি ছিল, সাভারের ক্ষেত্রে সেই ভুল করা যাবে না। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই পরিবেশদূষণের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এই কলঙ্ক মুক্ত হতে হলে ঘোষণাকে বাস্তব পদক্ষেপে রূপ দিতে হবে। সাভারে পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হলে এটি হবে দেশের জন্য একটি নজির, যা অন্য দূষণকবলিত অঞ্চলেও প্রয়োগ করা যাবে। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার স্বার্থে এবার সরকারের ঘোষণাকে কথায় নয়, কাজে পরিণত করতেই হবে।

শিল্প-বাণিজ্যের ধস ঠেকান
- কমেছে উপকরণ আমদানি ও উৎপাদন

অর্থনীতির দুরবস্থা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না, উল্টো শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে।
উৎপাদন খাতে স্থবিরতার কারণে সরকারও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাচ্ছে না।
এসব উপকরণ কম আসার অর্থ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উৎপাদন কমে যাওয়া। এসব উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে শ্রমশক্তি জড়িত তাদের কর্মসংস্থান কমে যাওয়া। আর তা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিই কমিয়ে দিচ্ছে। এসবের সঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়ও জড়িত। আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজস্ব কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। শুধু আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক আদায়ের লক্ষ্য ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে শুল্ক আদায় হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। অর্থসংকটে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে অর্থনীতিতে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় জনকল্যাণে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কম হওয়ার অর্থ হচ্ছে জনকল্যাণ ব্যাহত হওয়া এবং উন্নয়নে পিছিয়ে যাওয়া।
আমরা আশা করি, দেশে শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগে গতি আনার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। সব কিছু ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।