<p>এ দেশের বয়সের চেয়েও পুরনো এবং এখনো সক্রিয় এমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হাতে গোনা। আর উদীচীর মতো দিকনির্দেশনার ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠান তো নিতান্ত বিরল। সেই সংগঠনের ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী তাই উদযাপনের মতোই বিষয়। গতকাল ২৯ অক্টোবর ছিল সেই দিন।</p> <p>‘উদীচী’ শব্দের অর্থ উত্তর দিক। প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যিক, সাংবাদিক সত্যেন সেনের স্বপ্ন ছিল, সব সময় উত্তরের আকাশে থাকা ধ্রুবতারার মতোই অবিচল থেকে জাতিকে পথ দেখিয়ে যাবে এই সংগঠন। দেশ ও সমাজের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছে উদীচী। জাতীয় জীবনে অবদানের জন্য সংগঠন হিসেবে পেয়েছে একুশে পদক। বিশিষ্ট সংস্কৃতিজনরা তারই স্বীকৃতি দিলেন গতকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে। তাঁরা বলেছেন, সংস্কৃতি মানুষকে নির্মাণ করে। তাই সংস্কৃতিকে এগিয়ে না নিলে দেশ ও মানুষের সত্যিকারের মুক্তি হয় না। রাজনীতিসচেতন সুস্থ সংস্কৃতি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রশংসা করেন তাঁরা। অন্যদিকে নিজেদের কথা বলতে গিয়ে ৫৬তম বর্ষে পা রেখে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও প্রগতির পথে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটির নেতারা।</p> <p>দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রায় শেষ পর্বে, ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেছিল উদীচী। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল উদীচীর।</p> <p>৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘সংস্কৃতির সংগ্রামে দ্রোহের দীপ্তি, মুক্তির লড়াইয়ে অজেয় শক্তি’। গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা পরিণত হয়েছিল উদীচীর নতুন-পুরনো শিল্পী ও সংগঠকদের মিলনমেলায়। আলোচনা, গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটকসহ নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আয়োজন মাতিয়ে রাখেন তাঁরা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই আয়োজন ঢাকাসহ সারা দেশের সব জেলাতেই একই সঙ্গে উদযাপিত হয়েছে।</p> <p>চারুকলার বকুলতলায় রাজধানীর অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী অধ্যাপক আবুল বারক আলভী। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উদীচীর পতাকার রূপকার শিল্পী আনোয়ার হোসেন এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক কাজী মদিনা। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়ে মূল ফটক হয়ে ফিরে আসে অনুষ্ঠানস্থলে। পরে সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পী আনোয়ার হোসেন এবং অধ্যাপক কাজী মদিনাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।</p> <p>উদ্বোধনী পর্বের পর অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবুল বারক আলভী, ডা. কাজী তামান্না, শিল্পী আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক কাজী মদিনা ও উদীচীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে উদীচীর জন্ম হয়েছিল। এখন যখন আমরা উদীচীর ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছি তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। কথা বলা থেকে শুরু করে মানুষের প্রতিটি অধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে।’ অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সবাই উদীচীকে সহযোগিতা করবেন—এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।</p> <p>উদীচীর ওপর বারবার হামলা হয়েছে। সংগঠনটি তবু তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে জানিয়ে সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম বলেন, ‘সংস্কৃতির শক্তি অপরিসীম। সংস্কৃতি মানুষকে নির্মাণ করে।’ সংস্কৃতি খাতে ‘সর্বনিম্ন বাজেট থাকার ধারা’ পরিবর্তন করতে হবে বলে তিনি দাবি করেন।</p> <p>কাজী তামান্না বলেন, গত শতকের ষাটের দশকে বৈরী পরিবেশে ছায়ানট ও উদীচীর জন্ম হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই আজ পর্যন্ত স্বমহিমায় টিকে আছে। রাজনীতিতে সুস্থ সংস্কৃতি না থাকলে এবং রাজনীতিবিদরা সংস্কৃতিবান না হলে সেই রাজনীতি কখনো মানুষের হয় না। এখন দেখা যায় স্বার্থপরতার রাজনীতি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন বা দেশ গঠনে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা এমনটা চাননি।</p> <p>সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বদিউর রহমান আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘অন্ধকারের মাঝে উদীচী আলো হাতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাবে।’</p> <p>আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে ছিল উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের শিল্পীদের পরিবেশনায় দুর্নীতিবিরোধী গীতি-কাব্য-নাট্যালেখ্য ‘ধর ধর, চোর চোর’। এ পর্বে আরো ছিল একক সংগীত, দলীয় নৃত্য ও আবৃত্তি।</p> <p> </p> <p> </p>