<p>পুরান ঢাকায় বসবাসের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসছে ভবন মালিকদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার বিকল্প হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত, যা সেখানে মর্টগেজ নামে পরিচিত। শুরুতে এ ব্যবস্থা উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হলেও পরে প্রতারণার বিষয়টি জেঁকে বসে। দেখা গেছে, ভবন বা ফ্ল্যাটের মালিক একই ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বন্দোবস্ত দিয়ে সটকে পড়েছেন। আবার বন্দোবস্ত নিয়ে অনেকে ওই ফ্ল্যাট পুনরায় বন্দোবস্ত দিয়েছেন একাধিক ব্যক্তিকে। এতে এখন মাথা খুঁড়ছেন ভুক্তভোগীরা। </p> <p>পুরান ঢাকায় প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এই বন্দোবস্ত বা মর্টগেজ পদ্ধতিতে দেখা যায়, এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে কয়েক বছরের জন্য মালিকের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি বসবাসের জন্য নেয় দ্বিতীয় পক্ষ। এ নিয়ে দলিল করা হয়। শর্ত থাকে, চুক্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ও গ্যাস বিল প্রদান ছাড়া কোনো অর্থ ফ্ল্যাট ব্যবহারকারীকে দিতে হবে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে মালিক এককালীন পাওয়া ওই পুরো অর্থ ব্যবহারকারীকে ফেরত দেবেন। এভাবে মালিক যেমন একসঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থ পান, তেমনি বন্দোবস্ত নেওয়া ব্যক্তি পরিষেবা বিল দেওয়া ছাড়া বিনা ভাড়ায় লম্বা সময় ফ্ল্যাটে বসবাস করার সুযোগ পান। মালিক অর্থ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবহারকারীরা ফ্ল্যাটটি ছাড়েন না। সে ক্ষেত্রে নতুন চুক্তিও করা হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে।</p> <p>কিন্তু বর্তমানে একই ফ্ল্যাট একাধিক ব্যক্তির কাছে বন্দোবস্ত দেওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, শহীদনগর, কামরাঙ্গীর চর, আজিমপুরের একটি অংশ, চকবাজার, বাবুবাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এ কারণে প্রতারণার শিকার হচ্ছে অনেকে। জানা যায়, একই ফ্ল্যাট বন্দোবস্তের জন্য একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে মালিক লাপাত্তা হয়ে যায়। ভুক্তভোগীরা বলছে, লাভের আশায় কয়েক বছরের জন্য ফ্ল্যাট বন্দোবস্ত নিয়ে এখন সমস্যার শেষ নেই। দলিল ঠিক থাকলেও একই রকম কাগজ রয়েছে একাধিক পরিবারের কাছে।</p> <p>গত রবিবার লালবাগের কিছু এলাকা ঘুরে এমন ভোগান্তিতে পড়া কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। লালবাগ কেল্লার মোড় থেকে চকবাজারের দিকে যেতে কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডের ১২ তলা বিশিষ্ট ২৭ নম্বর ভবনটির ২৪টি ইউনিট মর্টগেজ নিয়েছে প্রায় ৪০টি পরিবার। কোনো কোনো ফ্ল্যাট তিন থেকে চারটি পরিবারের কাছেও মর্টগেজ দেওয়া হয়েছে বলে জানান বাসিন্দারা। ভবনের তৃতীয় তলায় থাকতেন ওই ভবনের মালিক মো. জিয়াউল্লাহ জনী। কিন্তু চুক্তিমাফিক নিজেদের জন্য বরাদ্দ ফ্ল্যাট না পেয়ে কয়েকটি পরিবার তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠে। তিন রুমের ফ্ল্যাটটিতে বর্তমানে থাকছে তিনটি পরিবার। যাদের সদস্যসংখ্যা ১২ জন।</p> <p>পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চার বছর আগে এই ফ্ল্যাটটি জলিল আহমেদ পাঁচ বছরের চুক্তিতে আট লাখ টাকায় বন্দোবস্ত নেন; এক বছর আগে চার বছরের চুক্তিতে সাত লাখ টাকায় নেন ইয়াসমিন বেগম। আর মোহাম্মদ মাসুম মুন্না দেড় বছর আগে তিন লাখ টাকায় তিন বছরের জন্য বন্দোবস্ত নেন। মুন্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তিনতলার ফ্ল্যাট নিতে গেলে আমাকে দেখানো হয়েছিল নিচতলা। মালিক বলেছিল, ওপরে পরিবার আছে তাই দেখানো যাচ্ছে না। তারা সামনের মাসে চলে যাবে। কিন্তু ফ্ল্যাটে উঠতে গিয়ে দেখি অন্য পরিবার রয়েছে সেখানে। যাদের প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে মর্টগেজ নেওয়ার দলিল।</p> <p>ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘আমি নিয়েছি তিন রুমের ফ্ল্যাট। পরে উঠতে গিয়ে দেখি একরুমও পাচ্ছি না। আমাদের এই ফ্ল্যাটটির মর্টগেজের জন্য ছয় থেকে সাতজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মালিক উধাও হয়ে গেছে।’ চুক্তি করার আগে কাগজপত্র দেখেছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে ইয়াসমিন বলেন, ‘শুরুতে কাগজ চাইনি। পরে চেয়েছিলাম। তখন যে দলিল দেখিয়েছিল সেটি যে ভুয়া জানতাম না।’</p> <p>বন্দোবস্ত নেওয়া জলিল আহমেদের স্ত্রী পলি আক্তার বলেন, ‘কষ্টের টাকায় এমন ঝামেলায় পড়ব ভাবিনি, এখন না পারি ছাড়তে আর না পারি থাকতে। একটা মাত্র টয়লেট আর রান্নাঘর। ১২ জন মানুষ কিভাবে থাকা যায়? বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, সবাইকে নিয়ে একরুমে থাকতে হচ্ছে।’</p> <p>বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জনীর মোবাইল ফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কিছু বলতে রাজি হয়নি। জনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় ২৫ নম্বর কাউন্সিল অফিসে জমা পড়া অভিযোগে দেখা যায়, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার গ্রান্ড কমার্স ব্যাংকসহ চারটি ব্যাংক থেকে বাড়ির দলিল জমা দিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। আর মর্টগেজ (বন্দোবস্ত) বাবদ নিয়েছেন আরো প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। অথচ পুরো ভবনটির বর্তমান মূল্য সব মিলিয়ে সাড়ে তিন কোটির মতো।</p> <p>জানা যায়, ওই ভবনে বুয়েটের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৪৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মর্টগেজ বাবদ দেওয়া এক কোটি ৩০ লাখ টাকাও এখন অনিশ্চতায়। পাওনা আদায়ের জন্য ব্যাংক বাড়িটি নিলামে তুললে কিছুই করার থাকবে না বন্দোবস্ত নেওয়া পরিবারগুলোর। খালি হাতেই ছেড়ে যেতে হবে বন্দোবস্ত নেওয়া ফ্ল্যাট।</p> <p>জানা গেছে, বন্দোবস্তের নামে এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত রয়েছে লালবাগের বালুঘাটের ১৮২/১ চারতলা ভবনের মালিক জন্টু ও মন্টু নামের দুই ভাই; ১৮৯ আমলীগোলা মিষ্টির গলির সেলিমসহ এলাকার অধিকাংশ বাড়ির মালিক। এই মালিকদের অনেকেই এখন পলাতক।</p> <p>বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি আর এ বিষয়ের সমাধান করতে যাই না। মানুষ লোভে পড়ে এই কাজটির সঙ্গে জড়াচ্ছে। আর কিছু অসাধু মানুষ এর ফায়দা লুটছে।’ ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোসাদ্দেক হোসেন জাহিদ বলেন, ‘আমার এলাকার ৬০ শতাংশ বাড়ির এই অবস্থা। মর্টগেজ দিয়ে মালিক উধাও হয়ে যায়। তারপর মানুষের কষ্টের আর শেষ থাকে না।’</p> <p>বিষয়টি নিয়ে থানায় কোনো ধরনের অভিযোগ আসে কি না জানতে চাইলে লালবাগ থানার ওসি সুবাস কুমার পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মর্টগেজ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে। কিন্তু ওইভাবে কেউ মামলা করেনি।’</p> <p> </p>