<p>মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। ‘তাহজিব’, ‘তামাদ্দুন’ শব্দ মুসলিম সংস্কৃতির ধারণা দেয়। ইসলামী সংস্কৃতি তাওহিদ, রিসালাতের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত।</p> <p>ইফতারি তেমনি এক ধর্মীয় আভিজাত্যপূর্ণ পবিত্র খাবার। ইউনেসকো ইফতারকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ৬ ডিসেম্বর ২০২৩। বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির ধারা অত্যন্ত গতিশীল এবং বাঙালির অভিযোজন ক্ষমতা ও আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়া খুবই উদার। ফলে বাঙালি ইফতার তালিকা দৈর্ঘ্য ছকে বাধা বা সংখ্যায় সীমিত করা দুরূহ। আফ্রো-অ্যারাবিয়ান ধারা, মোগল রসনাবিলাস, ভারতীয় রন্ধনশৈলী—সব কিছুর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, বাঙালি ইফতার সংস্কৃতি। ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু বাঙালির ইফতারের ঐতিহ্য হওয়ার নেপথ্য অনুষঙ্গ এখানে প্রাসঙ্গিক। শহর কি গ্রাম, ধনী অথবা গরিব—সবার ইফতারের তালিকায় স্থায়ী পত্তনি করে যাচ্ছে ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু!</p> <p>মুড়ি (চঁভভবফ ত্রপব) বাংলাদেশের মানুষের জনপ্রিয় খাবার। চাল, চাল ভাজা, ভাত, খই-চিড়ার জায়গায়, মাখানো ছোলা-মুড়ি কিভাবে বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ হলো, সে ইতিহাস হয়তো অনেকের অজানা।</p> <p>ছোলা আফগানদের প্রিয় খাবার, তাদের কাছ থেকে বাঙালি মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। আফগানরা কাবুলি চানা বা কাবুলি ছোলা খেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ওই কাবলি বুট, বুট আর মসলা, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে গোশতের সাদে মুখরোচক করে রান্না করা হয়ে থাকে। পিঁয়াজু, আলুর চপ—এসব ভাজাপোড়া এসেছে উত্তর ভারত থেকে। বাঙালি নিজের কৌশল খাটিয়ে বানিয়েছে বেগুনি। এ ছাড়া চালের তৈরি নানা পদ, যেমন—খই, মুড়ি, চিড়া বাঙালির খাদ্যতালিকায় বহু যুগ ধরেই আছে। ছোলা-মুড়ি একত্রে খাওয়ার রীতি বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবন। ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু ইত্যাদি, এমনকি জিলাপি ভেঙে মাখিয়ে খাওয়ার প্রবণতা দেড়-দুই শ বছর ধরে চলছে এবং তা পুরান ঢাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এ রীতি তৈরি হয়েছে মূলত অল্প খাবার সবাই একত্রে মিলেমিশে ভাগাভাগি করে খাওয়ার গরিবি চেতনা থেকে।</p> <p>উনিশ শতকে ইফতার করাকে বলা হতো ‘রোজা খোলাই’, অর্থাৎ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা ভাঙা। একসময় একটু সামর্থ্যবানরা ঘরে বানানো মুড়ির বিভিন্ন পদ, মিষ্টি ও নোনতা সমুচা, কাঁচা ও ভাজা ডাল, ফল-ফলাদি, পিঁয়াজু, ফুলুরি ইত্যাদি ইফতারিতে রাখত। ছিল ‘গোলাপি ঊখরা’ নামের মিষ্টি মেশানো বিশেষ খাবার। এ ছাড়া ভুনা চিড়া, দোভাজা, টেপি ফুলুরি, মাষকলাইয়ের বড় ডাল-বুট, বাকরখানি, নানা রকম জিলাপি, বিভিন্ন পদের কাবাব ইত্যাদি হাজির থাকত দস্তরখানায়।</p> <p>মোগলদের ইফতারে জনপ্রিয় পদ ছিল ‘নান তাফখান’ বা বাদাম দেওয়া একরকম গমের রুটি, সুজি দিয়ে তৈরি রুটি শিরমাল, আকবরী নানখাতাই—এসবও ছিল। মোগলরা মাংস, মসলা, লেবুর রস ও গম দিয়ে তৈরি হালিমজাতীয় বিশেষ খাবার তৈরি করত। তবে কাবাব, হালিম, বিরিয়ানি—এগুলো মূলত পারস্যের খাবার। জিলাপিও তুর্কিধারার খাবার, জনপ্রিয় হয় মোগলদের দ্বারা। কালের বিবর্তনে বিরিয়ানি, পোলাও, ভুনা খিচুড়ি, লাচ্ছা, ফালুদা কোনো কিছুই বাদ যায়নি বাঙালির ইফতার তালিকা হতে।</p> <p>শাহজালাল (রহ.) ইফতারে গরুর দুধ পান করতেন। প্রিয়নবী (সা.) ইফতারি হিসেবে খেজুর ও পানি খেতেন। খেজুর, পানি দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। খেজুর, পানি খাওয়ার বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রীতিকে বাঙালি গ্রহণ করেছে আন্তরিক আগ্রহ ও ইবাদতের আবহে, অন্যদিকে ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু এখন বাঙালির খাবার হিসেবে বিবর্তিত হয়ে নিজস্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু ছাড়া ইফতারি এখন কল্পনাই করা যায় না।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান</p> <p>ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ,</p> <p>কাপাসিয়া, গাজীপুর</p> <p> </p>