<p>রোজা বা সিয়াম সাধনা পৃথিবীর প্রাচীনতম ইবাদত। মানবেতিহাসের প্রাচীন সভ্যতা ও ধর্মগুলোতে নানাভাবে সিয়াম সাধনার বিবরণ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৩)</p> <p>উল্লিখিত আয়াত থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ইসলাম আগমনের আগেও পৃথিবীর অপরাপর ধর্ম ও সভ্যতায় সিয়াম সাধনা ছিল।</p> <p> </p> <p><strong>প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে রোজা</strong></p> <p>প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবিয়া, ম্যানিকেইজম, বৌদ্ধ, সনাতন ধর্মে এবং প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মিসরীয়, গ্রিক, রোমান ও ভারতীয় সভ্যতায় সিয়াম সাধনার ধারণা পাওয়া যায়। যদিও সব ধর্মের সিয়াম সাধনার ধরন ও প্রকৃতি এক ছিল না। প্রাচীন মিসরীয়রা ইবাদত-উপাসনার অংশ হিসেবেই সিয়াম সাধনা করত। গ্রিকরা ফসলের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখতে রোজা রাখত। রোজার আধিক্য ছিল রোমান সভ্যতায়। তারা উপাস্যদের সন্তুষ্টির জন্য নির্ধারিত দিনে রোজা রাখত। বিপদ-আপদে পতিত হলেও রোমানরা রোজা রাখত। ভারতীয়রা তুলনামূলক কঠোর সিয়াম (উপবাস) সাধনা করত। তারা দীর্ঘদিন কোনো ধরনের খাবার ও পানীয় গ্রহণ না করে উপবাস পালন করত।</p> <p> </p> <p>বিভিন্ন ধর্মে যেভাবে রোজা পালিত হতো</p> <p>ধর্মগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে বিভিন্ন ধর্মে পালিত উপবাসের বর্ণনা তুলে ধরা হলো—</p> <p>নক্ষত্র পূজারি : ঐতিহাসিক ইবনে নাদিম লেখেন, নক্ষত্র পূজারি হাররানিন জাতি, যারা ইতিহাসে সাবিয়া বা সাবিয়িন নামে পরিচিত ছিল, তাদের ধর্মে ৩০ দিন রোজা ফরজ ছিল। তারা চাঁদের সম্মানে এক মাস রোজা রাখত। এর মধ্যে ৯টি রোজা ভাগ্যদেবতা এবং সাতটি রোজা কল্যাণের দেবতা সূর্যের জন্য বিশেষায়িত ছিল। রোজা রাখার সময় তারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ত্যাগ করত। (আল-ফিহরিস্ত)</p> <p> </p> <p>ম্যানিকেইজম ধর্মাদর্শ : ম্যানিকেইজম খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে পারস্যে বিস্তার লাভ করে। ইবনে নাদিম বলেন, ম্যানিকেইজম ধর্মাদর্শে কয়েক ধরনের রোজা প্রচলিত ছিল। নির্ধারিত সময় সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তা পালন করা হতো। সূর্য ধনুকাকৃতি ধারণ করার পর (তাদের বিশ্বাস অনুসারে) নতুন চাঁদ ওঠার পর তারা দুই দিন ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখত এবং চাঁদ পূর্ণতা পেলেও ধারাবাহিকভাবে দুই দিন রোজা রাখত। আর সূর্য বালতির আকৃতি নেওয়ার পর মাসের ৮ তারিখ থেকে ৩০ দিন রোজা পালন করত। তাদের রোজা ছিল সাবিয়াদের মতোই। (আল-ফিহরিস্ত)</p> <p> </p> <p>সনাতন ধর্ম : সনাতন ধর্ম, যা হিন্দু ধর্ম নামেও পরিচিত, তাতে চার সময়ে রোজা (উপবাস) পালন করা হয়। দুটি স্থিতিশীল সময়ে এবং তা হলো বসন্ত ও শরৎকালের শুরুতে; দুটি পরিবর্তনশীল সময়ে এবং তা হলো শীত ও গ্রীষ্মের শুরুতে। প্রতি চান্দ্রমাসের প্রথম দশকের প্রথম ও চতুর্থ দিন। এ ছাড়া সনাতন ধর্মে নানা ধরনের উপবাস রয়েছে। অঞ্চল ও দেবতার অনুসারী ভেদে সনাতন ধর্মের অনুসারীরা বছরের বিভিন্ন সময়ে উপবাস পালন করেন। (তারিখুস-সওম)</p> <p> </p> <p>বৌদ্ধ ধর্ম : বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা (বিনয় নীতি মতে) সূর্য ঢলে যাওয়া থেকে ডুবে যাওয়া পর্যন্ত উপবাস পালন করেন। প্রতি চান্দ্রমাসে চার দিন তথা ১, ৯, ১৫ ও ২২ তারিখ তা পালন করেন। এ সময় তাঁরা পূর্ণ বিশ্রামে থাকেন এবং সব ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সপ্তাহের এক দিনে অষ্টবিধান অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, যাতে দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত উপবাসের বিধান রয়েছে। (তারিখুস-সওম ও উইকিপিডিয়া)</p> <p> </p> <p>জৈন ধর্ম : জৈন ধর্মে বিভিন্ন ধরনের উপবাস প্রথা প্রচলিত আছে। এর একটি হচ্ছে চৌবিহার উপবাস, যাতে পরবর্তী দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো প্রকার খাবার বা জল গ্রহণ করা যায় না। আরেকটি উপবাস ব্রত হচ্ছে ত্রিবিহার উপবাস, যেখানে কোনো খাবার খাওয়া যায় না, কিন্তু ফুটানো পানি পান করা যায়। জৈন ধর্ম মতে যেকোনো উপবাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অহিংসা অর্জন। সাধারণত পাজ্জ্যশনে উপবাস পালন করা হয়। কোনো ব্যক্তি যদি পাজ্জ্যশনে আট দিন উপবাস পালন করলে তাকে বলা হয় আত্থাই এবং ১০ দিন উপবাস করলে বলা হয় দশলক্ষণ। আর মাসব্যাপী উপবাস পালন করলে বলা</p> <p>হয় মশখমন। (উইকিপিডিয়া)</p> <p> </p> <p>গ্রিক ও পার্সি ধর্ম : মাওলানা সাইয়েদ সোলাইমান নদভি (রহ.) সিরাতুন নবীর পঞ্চম খণ্ডে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সূত্রে লিখেছেন, প্রাচীন মিসরের উৎসবগুলোর মধ্যে রোজাসহ অন্যান্য ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন গ্রিকের নারীরা কেবল ‘থেসমোফেরিয়া’র তৃতীয় দিনে রোজা রাখত। পার্সি ধর্মে সাধারণভাবে রোজা ফরজ নয়, তবে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের একটি ‘উদ্ধৃতি’ থেকে বোঝা যায় পার্সি ধর্মে রোজা ছিল। বিশেষত ধর্মীয় নেতাদের জন্য পঞ্চবর্ষীয় রোজা আবশ্যক ছিল। (সিরাতুন নবী : ৫/২১২)</p> <p> </p> <p>ইহুদি ধর্ম : ইহুদি ধর্মে প্রাচীনকাল থেকে রোজার দিন নির্ধারিত। কেউ ক্ষতির আশঙ্কা করলে এবং কোনো গণক নতুন কোনো প্রত্যাদেশের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলে তারা অবশ্যই রোজা রাখত। যখন তারা বুঝত আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট, যখন দেশে কোনো মহামারি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিত অথবা যখন শাসক কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হতেন, তখনও রোজা রাখত। এ ছাড়া ইহুদিরা ঐতিহাসিক ও বেদনাদায়ক বিভিন্ন ঘটনার স্মরণে রোজা পালন করে। ইহুদি ধর্মে সাধারণত ইশরাকের সময় থেকে রাতের প্রথম তারা উদিত হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখা হয়। (তথ্যসূত্র : জিউস এনসাইক্লোপিডিয়া)</p> <p> </p> <p>খ্রিস্ট ধর্ম : ঈসা (আ.) তাঁর নবুয়তের সূচনায় ৪০ দিন রোজা রাখতেন—তা ছিল কাফফারার সেই রোজা, যা মুসা (আ.)-এর শরিয়তে ফরজের পর্যায়ে ছিল। খ্রিস্ট ধর্মের গ্রন্থ ও উৎসগুলোতে ‘পলস’-এর রোজার বর্ণনা পাওয়া যায়। পাদ্রি লুকও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু খ্রিস্টানরা তাদের অন্যান্য যেসব মূলনীতির কথা বলে তা উল্লেখ করেননি। পলের মৃত্যুর দেড় শ বছর পর খ্রিস্টসমাজে রোজার সুনিয়ন্ত্রিত বিধান প্রণয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ফ্রাইডে অব সোরজ বা দুঃখের শুক্রবারের রোজা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত তা বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল। খ্রিস্ট ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের চার্চ অব ইংল্যান্ড রোজার দিন নির্ধারণ করে দিলেও রোজার বিধান ও শিষ্টাচার, সীমা ও রীতি রোজাদারের আবেগ-অনুভূতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। (প্রবন্ধ : ফাস্টিং ক্রিশ্চিয়ান এবং এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড ইথিকস)</p> <p>তথ্যঋণ : বই : আরকানে আরবাআ; প্রবন্ধ : তারিখুস-সওম, সাইয়েদ হুসাইন আস-সদর; প্রবন্ধ : বিভিন্ন ধর্মে উপবাস</p>