<p>মানবকাননের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও সুরভিত পুষ্প হচ্ছে শিশু। সংসারজীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ—সব কিছু আবর্তিত হয় শিশুকে কেন্দ্র করে। শিশুর হাসি যেমন মায়ের যাবতীয় দুঃখ দূর করে দেয়, তেমনি অনুপ্রাণিত করে বাবাকে সংসারযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। প্রতিটি শিশুই ছোট্ট চারাগাছের মতো, ফুলের কলির মতো। তার মধ্যে রয়েছে বিশাল বৃক্ষ হয়ে বিকশিত হওয়ার যোগ্যতা। সুন্দর ফুল হয়ে ফুটে ওঠার সক্ষমতা। ঘ্রাণে ঘ্রাণে পৃথিবীকে সুবাসিত করার সুপ্ত প্রতিভা।</p> <p>শেখালেই শিশুরা শেখে : শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা দেখে দেখে শেখে। শুনে শুনে শেখে। প্রয়োজন শুধু বড়দের সচেতনতা। শিশু তার বাবার কাছ থেকে শেখে। মায়ের কাছ থেকে শেখে। শিক্ষকের কাছ থেকে শেখে। তার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে সে শিখতে থাকে। ফলে সবাইকে শিশুর সামনে সচেতনভাবে চলাফেরা করতে হবে। শিশুকে বলা হয় ‘কাদামাটি’। আপনি যেভাবে তাকে গড়তে চাইবেন, সেভাবে সে গড়ে উঠবে। যা শেখাবেন তা-ই শিখবে।</p> <p>শিশুকে অহেতুক বিষয় শেখানো উচিত নয় : অনেক মা-ই শিশুর মূল্যবান সময়কে অহেতুক কাজের মধ্যেই পার করে দেন। যখন তাকে কালিমা শেখানো দরকার, তখন শিক্ষা দেওয়া হয় ‘ডগ, ক্যাট, হাট্টি মাটিম টিম...।’ আর এসব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যেন শিশুর প্রতি এগুলোই তাদের কর্তব্য। ফলে সেই শিশু ঈমানি শিক্ষা আর পায় না। আল্লাহর প্রতি তার আস্থা পয়দা হয় না। এমনকি নবীর পরিচয়ও সে জানতে পারে না। আফসোস! মায়েরা আজ কোথায় ঠেলে দিচ্ছেন তাঁদের কলিজার টুকরা সন্তানকে।</p> <p>ছোটদের প্রতি কোমল হতে হবে : বড়দের কাছ থেকে আমরা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করি। তাহলে ছোটদের প্রতি কেন আমরা তা করি না? আমরা যদি আমাদের ছোটদের সঙ্গে ভালো ও কোমল ব্যবহার করি, তাহলে  বড়রাও আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন। নবীজির শিক্ষা হলো, কোমলতা অবলম্বন করো। কঠোরতা পরিহার করো। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৩২) বাস্তবেও কোমলতায় যে ফায়দা হয়, কঠোরতার দ্বারা তা হয় না। সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে ছোটরা সব কথাই শোনে। আর ধমক দিয়ে কিছু বললে তারা আরো বেঁকে বসে।</p> <p>রাগান্বিত অবস্থায় প্রহার করা যাবে না : হজরত থানভি (রহ.) বলেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কখনো শিশুকে প্রহার করবে না। শাস্তির প্রয়োজন হলে রাগ প্রশমিত হওয়ার পর চিন্তাভাবনা করে শাস্তি দেবে। মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলতেন, অন্যান্য গুনাহ তো তাওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের ওপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তাওবার দ্বারা মাফ হয় না। আগে যার হক নষ্ট করা হয়েছে, তার কাছে মাফ চাইতে হয়। শিশুর কাছ থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ নাবালেগের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি শিশু যদি মুখে বলেও যে আমি মাফ করলাম, তবু তা গ্রহণযোগ্য নয়।</p> <p>শিশুর ত্রুটি ছোট থেকেই সংশোধন করতে হবে : শিশুদের ছোট ছোট ত্রুটি, অহংবোধ, অন্যকে কষ্ট দেওয়ার প্রবণতা শৈশবেই সংশোধন করা উচিত। কাউকে গালি দিলে কিংবা কোনো আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে মাফ চাইয়ে নেওয়াতে হবে। যাতে সে অন্যায়টা বুঝতে পারে এবং তার ভেতরে মাফ চাওয়ার গুণ তৈরি হয়।</p> <p>মাকে হতে হবে সজাগ ও দায়িত্ববান : শিশুর মনমানসিকতা, ধ্যান-ধারণা, বোধ-বিশ্বাস, রুচি-শিক্ষা, স্বভাব-সভ্যতা, ভদ্রতা তথা ভালো গুণগুলো একজন মা-ই সহজে তাঁর সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করাতে পারেন। ইতিহাসের পাতায় আমরা যত মহান ব্যক্তিকে দেখতে পাই, তাঁদের সফলতার পেছনে দেখা যায়, মায়ের অবদান বেশি। মা হলেন সন্তানের জন্য প্রথম পাঠশালার প্রথম শিক্ষক। তাই মাকে হতে হবে সন্তানের প্রতিটি ক্ষেত্রে সজাগ ও দায়িত্ববান।</p> <p>মহাকবি আল্লামা ইকবাল বলতেন যে বিলাত থেকে ফেরত আসার পরও যখন আল্লাহকে ভুলিনি, তখন আশা করা যায় আর ভুলব না। যখন লোকেরা বলত, ইকবাল! বিলাতের ওই চাকচিক্য দেখেও তুমি কী করে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে পারলে? উত্তরে বলতেন, সেই ছোটকালে আমার মা আমার চোখে যে মুহাম্মদি সুরমা-ইসলামী শিক্ষা লাগিয়ে দিয়েছেন, তার বরকতে এত কিছু সত্ত্বেও আমি আল্লাহকে ভুলিনি।</p> <p>মা-বাবার কাজের প্রভাব : মা-বাবার সব কাজের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। সন্তান যদি বাবাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে দেখে, তাহলে সন্তানও মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে। তেমনিভাবে সন্তান যদি মাকে জায়নামাজে দেখে, তাহলে অবুঝ বয়সেও সে মায়ের সঙ্গে নামাজ পড়বে, সেজদা দেবে। মূলত সন্তান শিশুকাল থেকে মা-বাবাকে যেমন দেখবে, নিজের জীবনকে তেমনভাবেই সাজাবে।</p> <p>গর্ভবতী মায়ের কর্মের প্রভাব : গর্ভকালীন মায়ের সব কর্মের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। মায়ের একটু সচেতনতা দ্বারা সন্তান সুস্থ, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, নেককার ও দ্বিনদার হতে পারে। আবার সামান্য একটু অসচেতনতা দ্বারা সন্তান অসুস্থ, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল, নির্বোধ ও বেদ্বিন হতে পারে। তাই এ অবস্থায় মাকে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজও পড়তে হবে। ঠিকমতো খাবারদাবার খেতে হবে। রাত্রি জাগরণ বর্জন করতে হবে। সব সময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে। সুযোগ পেলেই কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, হাফেজা ও কোরআন তিলাওয়াতকারী মায়ের সন্তান অতিমাত্রায় মেধাবী হয়। একজন নিষ্ঠাবান ‘মা’ দ্বারা একটি নিষ্ঠাবান জাতিরও জন্ম হয়। </p> <p>কান্না থামানোর জন্য মিথ্যা বলা : শিশুর কান্না থামানোর জন্য বা তার কাছ থেকে কোনো কাজ আদায় করার জন্য মিথ্যা বলা জায়েজ নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.)-এর বর্ণনা, একবার আমার আম্মা কিছু একটা দেবেন বলে আমাকে কাছে ডাকলেন। নবীজি (সা.) তখন আমাদের বাড়িতে বসা ছিলেন। তিনি আমার আম্মাকে বললেন, তুমি কি সত্যিই তাকে কিছু দেবে? আম্মা বললেন, হ্যাঁ! তাকে খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। নবীজি বললেন, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার এ কথাটি মিথ্যা বলে গণ্য হতো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯১)</p> <p>শিশুর মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা : শিশুর কচি অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে দিতে হবে। মা-বাবা যদি শিশুকে শাসনের ভয় দেখিয়ে বা অন্যরা খারাপ বলবে এই ভয় দেখিয়ে মন্দ অভ্যাস থেকে নিবৃত্ত করতে চান, তবে এটা হবে সাময়িক। মা-বাবা বা অন্য সবার অগোচরে, যেখানে শাসন কিংবা লোকলজ্জার ভয় থাকবে না, সেখানে শিশু দ্বিতীয়বার এ ধরনের কাজে উৎসাহী হতে পারে। কিন্তু যদি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এটা পাপ। এমন করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ সব সময় সবাইকে দেখছেন। কোনো কিছুই তার দৃষ্টির আড়ালে নয়। এবং তার অন্তরেও আল্লাহর ভয় বসে যায়, তাহলে শিশুর সব বদ-অভ্যাস স্থায়ীভাবে ঠিক হয়ে যাবে।</p> <p>মা-বাবার কর্তব্য : শিশু যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন তাকে সর্বপ্রথম ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মদ’; এরপর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া। কোরআন শিক্ষা দেওয়া। দ্বিনের অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়া। মাঝেমধ্যে তাকে নবী-সাহাবা ও মহামনীষীদের উপদেশমূলক ঘটনা শোনানো। শিশুর কোনো সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে, তার প্রশংসা করা, পুরস্কার দেওয়া। অমার্জিত পোশাক থেকে বিমুখতা সৃষ্টি করা। বেশি দামি পোশাকে অভ্যস্ত না করা, যাতে সে অহংকারের ছোবল থেকে রক্ষা পায়। তাদের সব ইচ্ছা পূরণ না করা। পাঠশালায় যাওয়ার ব্যাপারে কখনো শিথিলতা প্রদর্শন না করা। সন্তানের সামনে উচ্চৈঃস্বরে কথা না বলা। যথাসম্ভব তাকে চোখে চোখে রাখা, যাতে কোনো খারাপ সঙ্গ গ্রহণ না করে বসে। তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাতে ফোন বা ট্যাবের মতো যন্ত্র ধরিয়ে দেওয়া তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।</p> <p>ছোট থেকেই যে বিষয়গুলো তাকে শেখাতে হবে : বিনয়। সঙ্গী-সাথিদের সম্মান করা। কথাবার্তায় কোমলতা। ত্যাগেই সম্মান; গ্রহণে নয়। মানুষের জিনিস নেওয়া নিন্দনীয়। অন্যদের দিকে পিঠ দিয়ে না বসা। কারো পায়ের ওপর নিজের পা না রাখা। বড়দের প্রশ্নের শুধু জবাব দেওয়া; যতটুকু জিজ্ঞেস করা হয় শুধু ততটুকু বলা। বড়দের কথা মনোযোগসহ শোনা। বড় কেউ এলে তার সম্মানে উঠে জায়গা খালি করে দেওয়া। কুসঙ্গ থেকে দূরে থাকা। মা-বাবা, শিক্ষক, গুরুজন এবং আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা সব মুরব্বিকে মান্য করা। যখন সে ভালো-মন্দ বোঝার বয়সে উপনীত হবে, তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। রমজান মাসে যে কয়দিন পারে, রোজা রাখতে বলতে হবে।</p> <p>শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে : শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমার সন্তানকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভালো।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭৩৩) তাই বৈধ পন্থায় তার জন্য কিছু সম্পদ রেখে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সে শিক্ষিত হলে সারা জীবনই সচ্ছল থাকবে, পরনির্ভরশীল হবে না।</p> <p>সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া : সন্তানকে সুন্দর আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেওয়ার প্রধান দায়িত্ব মা-বাবার ওপর। কিন্তু তারা আজকাল অফিস-আদালতের কাজকর্মে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে সন্তানকে সময়ই দিতে পারেন না। সকালে সন্তানকে ঘুমে রেখে অফিসে যান। আবার বাসায় এসে ঘুমে পান। ছুটির দিন না হলে সাধারণত দেখা-সাক্ষাৎই হয় না। সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব বাসার কাজের বুয়াদের ওপর ছেড়ে দেন। ফলে সে সারা দিন যার কাছে থাকছে, তার আচার-আচরণ শিখছে। শিক্ষিত বহুগুণের অধিকারী মা-বাবার অনেক কিছুই সন্তান শিখতে পারছে না।</p> <p>লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া</p> <p>কারওয়ান বাজার, ঢাকা।</p>