সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ‘এখতিয়ার’ নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন ও তার উত্তর এখন জনপরিসরে ব্যাপক আলোচিত। প্রশ্নগুলো হচ্ছে—গণ-অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্টে কার ভাষণ শোনার জন্য দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল? জাতির উদ্দেশে সেদিন কে ভাষণ দিয়েছিলেন? কার ডাকে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও শক্তির প্রতিনিধিরা সেনানিবাসে উপস্থিত হয়েছিলেন? জাতির উদ্দেশে কে বলেছিলেন, ‘আমার ওপর ভরসা রাখেন?’ উত্তরটি সবার জানা, ‘জেনারেল ওয়াকার’। তখন কি কেউ এই প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কে? কেন আপনার ওপর ভরসা রাখব? এসব কথা বলার এখতিয়ার কি আপনার আছে? এর সর্বজন স্বীকৃত উত্তর হচ্ছে, ‘না’। বরং প্রশংসায় ভেসেছিলেন জেনারেল ওয়াকার।
বিশেষ লেখা
সেনাপ্রধানের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন কাদের, কোন মতলবে
- সেনাপ্রধানের মত প্রকাশের ভালো-মন্দ মূল্যায়নের মাপকাঠি বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই -ড. শাহদীন মালিক
- ৫ আগস্ট তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন -অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী
- জেনারেল ওয়াকার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ -ড. খান সুবায়েল বিন রফিক
কাজী হাফিজ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও গণ-অভ্যুত্থান ও তার পরে দেশবাসীর কল্যাণে জেনারেল ওয়াকারের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেন।
গত ৬ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে ‘সেনা সদর নির্বাচনী পর্ষদ ২০২৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের বন্যা পরিস্থিতি মেকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, মানবিকতার প্রশংসাতেও প্রধান উপদেষ্টার কার্পণ্য ছিল না। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া দ্বিতীয় ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বিশেষ করে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের সব দুর্যোগকালে তারা সব সময় আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে বন্যা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে তাদের সৈনিক এবং অফিসাররা দিনের পর দিন যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেদিন সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে আরো বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়সহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপনারা সবার শেষ ভরসার স্থান। দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে আপনারা দেশের মানুষের পাশে থেকেছেন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে, সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। দেশ গঠনেও আপনারা সবার আগে এগিয়ে এসেছেন।
কিন্তু তার পরও সেনাপ্রধানের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে কারা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে—এই প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টক শোতে বলা হয়, ‘এখন যখন কারো মতলব পূরণের জন্য ওই ভদ্রলোক (সেনাপ্রধান) বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তখন বলা হচ্ছে, এটা উনি করতে পারেন না।’
অনেকের মূল্যায়ন, সেনাপ্রধান মনে করেন, দেশে বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে সেনানিবাসের বাইরে রাখলে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও সুনাম ক্ষুণ্নের আশঙ্কা থাকে। এই প্রয়োজনবোধ ও আশঙ্কা থেকেই তিনি আট মাস আগেই ১৮ মাসের মধ্যে বা ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন। সেনাপ্রধান হিসেবে নিজ বাহিনীর স্বার্থে এবং একই সঙ্গে দেশের কল্যাণের জন্য তিনি এ কথা বলেছেন। তাঁর এই বক্তব্য দেশের গণতন্ত্রকামী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিধ্বনী বলেই মনে করেন অনেকে। অনেকে বলেছেন, ১৮ মাস সংস্কার সম্পন্ন করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট সময়। কিন্তু ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সংস্কার এখন বাস্তবায়ন যোগ্য-অযোগ্য শত শত সুপারিশ আর এসব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর এসিরুম সংলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা আড়াল করার চেষ্টা প্রবল। প্রথমদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে সেনাপ্রধানের মনোভাব প্রকাশ ‘এখতিয়ারবহির্ভূত’ মনে না হলেও নির্বাচন ও গণতন্ত্র যাদের প্রত্যাশা পূরণের অন্তরায় তারা এখন নাখোশ। তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া অনেকেই বলছেন, জুলাই-আগস্টের সফল গণ-অভ্যুত্থানে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এর সুফল ভোগকারীদের তালিকায় তিনি নেই। বরং তাঁকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চলমান। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টাও তাঁকে বিতর্কিত করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। তাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। বরং গত ২৪ মে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক শেষে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে যে বিবৃতি এসেছে তাতে ‘এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য’ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানানো হয়।
প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, গত ২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান সেনা কর্মকর্তাদের কাছে এই মত প্রকাশ করেন যে জাতীয় নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত। ওই অনুষ্ঠানে তিনি মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডরসংক্রান্ত প্রশ্নেরও জবাব দেন। সেনা কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা কিভাবে নিচ্ছে সে বিষয়ে দেশবাসীর পাশাপাশি তিনি এবং সেনাবাহিনী অবগত নয়। এ ছাড়া তিনি মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা জানান এবং বলেন, আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু মহল তাঁকে ও সেনাবাহিনীকে অন্যায্যভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো যুক্ত হবে না। কাউকে তা করতেও দেওয়া হবে না। এই বাস্তবতায় সব পর্যায়ের সেনা সদস্যকে তিনি নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া কিছুদিন ধরে প্রচার হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরোধ তৈরি হয়েছে। সংবাদপত্রে বিশিষ্টজনদের লেখায় এমন বক্তব্যও আসে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার মানেই যহেতু অস্থায়ী সরকার, তার জন্য ১০ মাস মোটেই কম সময় নয়। এই কাজের জন্য প্রধান উপদেষ্টা অনভিজ্ঞদের নিয়ে (যদিও সবাই নয়) একটি টিম গঠন করেছেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তিনি দক্ষতার সঙ্গে সেই টিম পরিচালনা করতে পারেননি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁর কয়েকজন উপদেষ্টা ক্ষমতার প্রতি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন যে তাঁরা তাঁদের মূল দায়িত্ব পালনের চেয়ে সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর দিকেই মনোযোগী হয়ে পড়েন। জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে সশস্ত্র বাহিনীকে সম্পৃক্ত না করার বিষয়ে সেনাপ্রধানের অভিযোগের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে মীমাংসা করতে পারেন। কারণ আমাদের সেনাবাহিনীও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
২১ মে সেনাপ্রধানের বক্তব্য বিষয়ে আইএসপিআর থেকে গণমাধ্যমকে কিছু জানানো হয়নি। আইএসপিআর থেকে বলা হয়েছিল, এ ধরনের ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের কাজের একটি অংশ; এ ধরনের অনুষ্ঠানের সংবাদ গণমাধ্যমকে জানানো হয় না। তবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমের উপস্থিতিতেই সেনাপ্রধান ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই দিন ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের) দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার এদিকে হেল্প করবে।’
সেদিন তিনি আরো বলেন, ‘ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে। কাজ করে যাচ্ছেন উনি, তাঁকে আমাদের সাহায্য করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন। সেদিকে আমরা সবাই চেষ্টা করব। আমরা একসঙ্গে ইনশাআল্লাহ কাজ করে যাব।’
গত ২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেসের পর গত ২৬ মে সেনা সদর আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মিডিয়াতে বিষয়টি যেভাবে আসছে—এ রকম আসলেই কিছু হয়নি। সরকার ও সেনাবাহিনী খুব সুন্দরভাবে একে অপরের সহযোগিতায় কাজ করছে। এটা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই।’
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রত্যাশা শুধু সেনাপ্রধানের না। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ আরো অনেক দল। দেশের আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরাও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। গত মঙ্গলবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘স্থিতিশীলতা ও নির্বাচন প্রশ্নে বলতে হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের এরই মধ্যে ৯ মাস চলে গেছে। এখন নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে।
বিশিষ্টজনরা যা বলছেন : সার্বিক এই পরিস্থিতির মধ্যে সেনাপ্রধানের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সেনাবাহিনীর কাজ না। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন জাতীয় প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য তাদের ডাকা হয়। তবে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য না। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রায় দুই বছর সেনাবাহিনীকে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। তারা তখন ভালো অভিজ্ঞতা নিয়ে সেনানিবাসে ফিরতে পারেনি। সেনাবাহিনীর মধ্যে হয়তো এই চিন্তা আছে, দ্রুত তাদের দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ শেষ হোক। আবার নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার না এলেও তাদের এই কাজের সমাপ্তি ঘটবে না। সেনাপ্রধান হয়তো এই চিন্তা থেকেই ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই মত প্রকাশের এখতিয়ার আছে কি না—এর ভালো-মন্দ মূল্যায়ন করার মাপকাঠি তো বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই। কারণ, আইনি কাঠামোতে তো এখন দেশ চলছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধানের অবদান সম্পর্কে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘৫ আগস্ট তিনি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। জেনেছি, সেদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ফরজের নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াতের পর মোনাজাতে বসে সেনাপ্রধানকে কাঁদতে দেখা গেছে। তিনি আল্লাহর কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তৌফিক কামনা করেছিলেন। সেদিন সেনাপ্রধান ছাত্র-জনতার পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত না নিলে প্রচুর মানুষ হতাহত হতো, দেশে রক্তের স্রোত বয়ে যেত।’
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ড. খান সুবায়েল বিন রফিক ২০০৯ সালে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে শেখ হাসিনার রোষানলে পড়েন এবং চাকরি হারান। অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জেনারেল ওয়াকার ক্ষমতা নিতে চাইলে গত বছর আগস্টেই নিতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। আজ যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের এই সত্য মনে রাখতে হবে, জেনারেল ওয়াকার ৫ আগস্টের এক কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।’
সম্পর্কিত খবর

স্থায়ী কমিটির বৈঠক
ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে নয় বিএনপি। এটিকে রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে মত দিয়েছে দলটি। গত বুধবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এরই আলোকে ঘোষণাপত্রের ওপর বিএনপির মতামতে এই দলিলকে আর্কাইভে (সংরক্ষণ) রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বিএনপির কাছে পাঠানো জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত চূড়ান্ত করতে বুধবার রাতে স্থায়ী কমিটির এ বৈঠক হয়। ওই রাতেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এনে তাতে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে বিএনপি। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংবিধানে স্থান দেওয়া হলে তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার দাবি তোলে।
স্থায়ী কমিটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, খসড়া ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলা হলেও বিএনপি তাতে দ্বিমত জানিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতাযুদ্ধকেই প্রধান অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণাপত্র শুরু হওয়া উচিত।
খসড়া ঘোষণাপত্রে আছে, ‘যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ত ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি’—বিএনপি এ ক্ষেত্রে ‘বিভিন্ন শাসনামলের জায়গায়’ ‘আওয়ামী শাসনামলের’ কথা উল্লেখ করেছে।
এ ছাড়া দলটি ১৯৭২ সালের ‘সংবিধান পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায়’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়া থেকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তুত করা ঘোষণাপত্রের খসড়ার শেষ অংশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি উল্লেখ ছিল। জানা গেছে, এর বাইরেও খসড়ায় আরো কিছু শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। এনসিপি সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তাদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। আর এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা তার ওপর মতামত গতকাল (বুধবার) দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব কার্যক্রম চালিয়েছে। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ’২৪-এর মহত্ত্ব ও গুরুত্বের প্রতি বিএনপি যথাযথ মর্যাদা দেয়। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও বর্তমান সরকারকে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস স্থাপনের খসড়া অনুমোদন
বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়’-এর মিশন স্থাপনসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ জুন ওই খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হলে তাতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনি ক্লোজারের নকশা চূড়ান্তকরণ, ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্তকরণ এবং নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও মহেশখালী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাস হয়।
বৈঠকে ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়, যা লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিংয়ের পর কার্যকর হবে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘অপশনাল প্রোটোকল টু দ্য কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারে (ওপি-ক্যাট)’ পক্ষভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে বাংলাদেশের একটি নতুন কনস্যুলেট জেনারেল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
বৈঠকে মহেশখালীকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনতে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, তাহলে কেন হবে না?
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে কেন নির্বাচন হবে না? দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। নির্বাচিত প্রতিনিধি চায়। এ জন্য তারা জীবন দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
অনুষ্ঠানে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধীসহ জুলাই আন্দোলনে শহীদ ৬৪ জন সাংবাদিকের ওপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডিইউজের সহসভাপতি রাশেদুল হক। বিএফইউজের প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর পরিবার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছয় সাংবাদিকের পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।
তাঁর এই বক্তব্যের জবাবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি খুব আশাবাদী মানুষ। অনেকে বলেছেন যে, হবে না। কেন হবে না? নির্বাচন তো এ দেশের মানুষ চায়, নির্বাচনের জন্য তো এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে ফেলতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন এই কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবেন। আমরা দাবি করছি, যেন এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় দেশে নির্বাচন হবে? অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করে, নির্বাচন কি হবে? গতকাল প্রেস সেক্রেটারি যে বক্তব্য রাখলেন, তাতে কি মনে হয় নির্বাচন হবে? বেশির ভাগ মানুষ মনে করে নির্বাচন হবে না। তাহলে কী হবে? আমাদের ভাবনার দরকার আছে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো নেই, দুঃশাসন কি বিদায় নিয়েছে? না। আমাদের আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। আমাদের সামনে এখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিরাজমান। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা, দিল্লির আধিপত্যের কালো থাবা চতুর্দিকে ছেয়ে বসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি-আন্তর্জাতিক নীতি-কূটনীতি ইভেন সামনের নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া যায় তার চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতা বিরাজমান। আজকেও যদি দেখেন, এটা যদি না হতে পারে, ওটা হতে পারবে না। এ রকম বক্তব্য দিচ্ছেন আমাদের তরুণ নেতৃত্বের কতিপয় নেতা। আপনি আপনার চাহিদা বলতেই পারেন, এটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারেন না যে, এটা না হলে, ওইটাও হবে না। এই অধিকার আপনার নেই। এই মানসিকতা আর স্বৈরাচারের মানসিকতা একই।’
তিনি বলেন, ‘৬৪ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। সংগ্রামের সম্পাদক আসাদ ভাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু লেখনীর কারণে। এখনো তো আপনাদের কণ্ঠে একই ধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এটি কি ঠিক?’
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৭ বছরে সাংবাদিকদের ভূমিকা বর্তমান সরকার স্বীকার করতে চায় না। এই সরকারের যারা সুবিধাভোগী, তারা এক-দেড় মাস লড়াই করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা ১৭টি বছর ঢাকার রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, অনেকে খুন হয়েছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকারের চূড়ান্ত পতনের জুলাই বিপ্লব এসেছে। সেখানে শুধু পেশাজীবী নয়, সাংবাদিকদেরও অবদান রয়েছে। আজকে মাঝে মাঝে কিছু শিশুকে দেখি সাংবাদিকদের হুমকি দিতে। তোমরা দেড় মাসের নেতা। আমরা ১৭ বছর লড়াই করে ফ্যাসিবাদের তক্ততাউস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম। দেড় মাস নেতৃত্ব দিয়ে, ১৭ বছরের সংগ্রামকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমরা সাংবাদিকদের হুমকি দাও, এটা মেনে নেব না।’
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘একটা ফ্যাসিবাদের ভাষা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটার নিন্দা করছি। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ, হুমকি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করছি, সেটা খুবই অমঙ্গলসূচক। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনোভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, হুমকি দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায় না।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলমের সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইলিয়াস খান, এ কে এম মহসিন, ইরফানুল হক জাহিদ, সাঈদ খান, দিদারুল আলম, খন্দকার আলমগীর হোসেন ও প্রবাসী সাংবাদিক ইমরান আনসারী প্রমুখ।

‘ক্ষমা’ পেতে পারেন সাবেক আইজিপি
মেহেদী হাসান পিয়াস

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। এ মামলায় অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে আবেদন করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি মঞ্জুর করে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করে সাক্ষ্য উপস্থাপনের অনুমতি দেন। এর পরই প্রশ্ন উঠেছে, মামুন কি রাজসাক্ষী হয়েছেন? হয়ে থাকলে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে কী প্রতিকার পাবেন বা পেতে পারেন?
মামুনের দোষ স্বীকার
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে থেকে অপরাধ করায় শেখ হাসিনাকে এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে।
রাজসাক্ষী নিয়ে যা বলা আছে ট্রাইব্যুনাল আইনে?
এই মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে। আইনটির ১৫ ধারায় ‘একজন রাজসাক্ষীর ক্ষমা’ বিষয়ে বলা আছে। ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল, অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করার শর্তে, এই ক্ষমা প্রদান করতে পারে।’
২ উপধারায় বলা আছে, ‘এই ধারার অধীনে অভিযোগ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ আর ৩ উপধারায় ‘বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে’ বলা আছে।
রাজসাক্ষী হলে আইনের শর্ত পূরণ করতে হবে : রাজসাক্ষী হতে চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলায় আদালত তাঁকে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষ্য-জেরার পর আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে তিনি সব সত্যি বলেছেন, কোনো কিছু গোপন করেননি বা তাঁর সাক্ষ্যের পর প্রকৃত সত্য উদঘাটন হয়েছে, তখন আদালত তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় যেসব শর্তের কথা বলা আছে, সেই সব শর্ত তাঁকে পূরণ করতে হবে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করবেন। রাজসাক্ষী হতে পারলে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার আছে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করার।’
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করেছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। তিনি বলেছেন, এই মামলার সম্পূর্ণ সত্যি এবং সব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এই মর্মে একটি আবেদনও দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন।’
ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হওয়ার এটিই প্রথম নজির : প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ফৌজদারি অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে আর কোনো আসামি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেননি। মামুনকে কারাগারে আলাদা সেলে রাখা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং যেসব আসামির বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারেন বা তাঁর বক্তব্যে যেসব আসামির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেসব আসামি তাঁকে বায়াস (পক্ষে আনার) করার চেষ্টা করতে পারেন, তাঁর নিরাপত্তার ঘাটতি হতে পারে, এই জন্য কারাগারে তিনি যেন আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) থাকেন অর্থাৎ আলাদা সেলে রাখা হয়, সেই আবেদন করেছেন। আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ কারাগারে আলাদা সেলে থাকলেও সাবেক আইজিপি হিসেবে মামুন যে ডিভিশন সুবিধা পেয়ে আসছিলেন, তার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধা তিনি পাবেন না বলেও জানান প্রসিকিউটর তামিম।