হুট করে বৃষ্টি নামল। একটা টং দোকানে ঢুকে পড়লাম। চায়ে চুমুক দিচ্ছি, কানে এলো দুজনের কথা। ৫০ টাকার একটা নোট দেখিয়ে এক তরুণ বললেন, ‘বাংলাদেশে আর কোনো নোটে এমন চিত্রকর্ম নেই।
অন্য জীবন
টাকার নকশা করেন যিনি
পিন্টু রঞ্জন অর্ক, গাজীপুর থেকে ফিরে

সায় দিয়ে পাশের জন বললেন, ‘বাজারে নাকি নতুন নোট আসবে। আজও জানলাম না আমাদের নোটগুলোর ডিজাইনার কে!’
এমন সময় পাশে বসা এক ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, ‘এই নোটটার নকশা আমার করা।’
ভদ্রলোক মাঝবয়সী।
শুনে অবাক দুই তরুণ। বেশ কৌতূহল হলো। পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমালাম। সদালাপী মানুষটির নাম মুছলিম মিয়া। থাকেন গাজীপুরে।
ইচ্ছামতো আঁকতেন : কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর ধুলদিয়া গ্রামের সন্তান মুছলিম মিয়া। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মেজো। শৈশবে ইচ্ছামতো আঁকতেন। খাতাপত্র তো বটেই, বাড়ির দেয়াল, আশপাশের ভবন—সবই তাঁর ক্যানভাস। আঁকার উপাদান বলতে কয়লা, ইটের গুঁড়া আর সবুজ রং। দেখে প্রশংসা করত অন্যরা।
তাঁর বড় ভাই পড়তেন মোহাম্মদপুরের গ্রাফিকআর্ট কলেজে। এসএসসি পাসের পর তিনি মুছলিম মিয়াকে বললেন, ‘এখানে একটা আর্ট কলেজ আছে। ভর্তি হবি?’ পরে দুই ভাই মিলে গেলেন আর্ট কলেজে (এখনকার চারুকলা অনুষদ)। সেখানেই দেখা শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে। তিনি একটা মাটির পট এবং কয়েকটা পাতার চিত্র দিয়ে বললেন, ‘এগুলো আঁকার চর্চা করো।’ দিন কুড়ি পর উনাকে আবার দেখালেন। পরে লিখিত ও অঙ্কন পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলেন মুছলিম মিয়া। ১৯৭৮ সালে প্রি-ডিগ্রিতে ভর্তি হলেন চারুকলায়। ছাপচিত্র বিভাগ থেকে স্নাতক হলেন ১৯৮৪ সালে।
এক নামে চিনত তাঁকে : তখন তিনি প্রথম বর্ষে। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। কাঠের ওপর করা মুছলিম মিয়ার একটা শিল্পকর্ম ঠাঁই পেল প্রদর্শনীতে। এর পর থেকে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালেসহ ঢাকায় আয়োজিত প্রদর্শনীগুলোতে থাকত মুছলিম মিয়ার ছবি। সেই সুবাদে চারুকলায় সবাই এক নামে চিনত তাঁকে।
স্নাতকের পর একটা অ্যাড ফার্মে যোগ দিলেও ফরমায়েশি কাজে মন বসছিল না। এনগ্রেভার পদে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি আবেদন করেন। ভাইভা বোর্ডে এক পরীক্ষক কাগজ, পেনসিল ও রাবার দিয়ে বললেন, ‘১০ মিনিট সময়। আমার একটা পোর্ট্রেট আঁকেন।’ মুছলিম মিয়ার আঁকা দেখে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ। পরে জেনেছেন সেই ভদ্রলোক ছিলেন টাঁকশালের প্রধান প্রকৌশলী।
অনেক দূর যাবে : ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে শিক্ষানবিশ এনগ্রেভার পদে যোগ দিলেন। তখন গাজীপুরে টাঁকশাল ভবন নির্মাণ হচ্ছিল। সিনিয়ররা যেসব নকশা করতেন, সেগুলো নিজের মতো করে আঁকতেন। ১৯৮৬ সালে দুই টাকার নতুন নোট ছাড়ার উদ্যোগ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নকশা করেন শিল্পী রফিউদ্দিন। ট্রেসিং পেপারে দোয়েল পাখির স্কেচটা করে দিলেন মুছলিম মিয়া।
১৯৮৭ সালে প্রশিক্ষণের জন্য শিল্পী মাহমুদা খাতুন আর মুছলিম মিয়াকে পাঠানো হলো সুইজারল্যান্ড। সেখানে টাকা, মুদ্রা নকশা ও অবয়ব খোদাই (এনগ্রেভিং) বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিলেন। ইতালিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের একজন এনগ্রেভার ছিলেন তাঁদের প্রশিক্ষক। মুছলিম মিয়ার আঁকা দেখে সেই প্রশিক্ষক বলেছিলেন, ‘তোমার কাজের যে গতি, লেগে থাকলে অনেক দূর যেতে পারবে।’
উৎপাদনে গেল টাঁকশাল : ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরলেন মুছলিম মিয়া। তত দিনে টাঁকশাল ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, এস এম সুলতানসহ ব্যাংক নোটে ব্যবহার উপযোগী অনেকে পোর্ট্রেট করতে লাগলেন। ১৯৮৯ সালে উৎপাদনে গেল টাঁকশাল। দেশেই শুরু হলো টাকা ছাপানো। প্রথমে এক ও ১০ টাকার নোট ছেপেছিল। তখনো দেশে লেটার এনগ্রেভিং মেশিন ছিল না। তাই বিদেশ থেকে করিয়ে আনা হয়েছিল।
প্রথমে এখানে ছাপানো এক টাকার নোটের নকশা করাই ছিল। নোটটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। নকশাকার ফজলুল করিম। চাকরি করতেন পাকিস্তান সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ে। গাজীপুরে আর যোগ দেননি। টাঁকশাল চালুর পর মুছলিম মিয়ারা নকশা শুরু করলেন। অনেক ডিজাইন করা হয়েছিল। শিল্পী মাহমুদা খাতুন স্মৃতিসৌধের ছবিযুক্ত ৫০ টাকার নোটের ডিজাইন করলেন। শিল্পী রফিউদ্দিন আহমেদ দোয়েল পাখিওয়ালা দুই টাকার নোটের নকশা করলেন ১৯৮৮ সালে। তাঁরা আরো কিছু নোটের নকশা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেগুলো পছন্দ করেনি। তারা নতুনত্ব চাইছিল।
মুছলিম মিয়ার নকশা : ১৯৯৫ সালের দিকে প্লেট খোদাইয়ের কাজ করতেন মুছলিম মিয়া। একদিন টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ ডেকে বলল, ‘আমাদের যে দুজন ডিজাইনার আছেন, তাঁরা কিছুদিন পর অবসরে যাবেন। আপনিই নকশা করেন, দেখি কেমন হয়।’
১০, ৫০ আর ৫০০ টাকার নোটের ডিজাইন বদলাতে চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মুছলিম মিয়া পরীক্ষামূলকভাবে নোটগুলোর নকশা করলেন। অন্যরাও করল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পছন্দ করল মুছলিম মিয়ারটা। প্রথমে তারা পছন্দ করল বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত একটি নীল রঙের ১০ টাকার নোট। উল্টো পাশে ছিল লালবাগকেল্লা মসজিদ। একটা ৫০০ টাকার নোটের রং ছিল লালচে হলুদ। সামনে স্মৃতিসৌধ, পেছনে হাইকোর্ট ভবন। ৫০ টাকার নোটের সামনে সংসদ ভবন, পেছনে রাজশাহীর বাঘা মসজিদ। ১৯৯৬ সালে তিনটি নোটই অনুমোদন পেল। নোটগুলো প্রসেসিংয়ের জন্য ১৯৯৭ সালে আবার সুইজারল্যান্ড গেলেন মুছলিম মিয়া। কালার সেপারেশন ও প্লেট করে সেগুলো দেশে এনে ছাপানো হলো। এরপর দুই টাকা, ২০ টাকার নোটও মডিফাই করলেন। মানে নোটগুলো বেশ বড় ছিল। পরে সেগুলো স্ট্যান্ডার্ড সাইজ করা হয়েছে। আবার ১০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোটও ডিজাইন করলেন। হাঙ্গেরিতে গিয়ে সেগুলো প্রসেস করলেন মুছলিম মিয়া। বাংলাদেশের প্রথম ১০০০ টাকার লাল রঙের নোটটাও (শহীদ মিনারের ছবিযুক্ত) তাঁর নকশায় করা।
কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হলো : ২০০০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পলিমারে করা ১০ টাকার নোট চালু হলো। নকশাকার এক অস্ট্রেলিয়ান। কিন্তু আমাদের টাঁকশালে এ ধরনের নোটের কাজ করার মতো উপযুক্ত কম্পিউটার ছিল না। মুছলিম মিয়া নিজের বাসার কম্পিউটার সেট নিয়ে গিয়েছিলেন টাঁকশালে। সেখানেই নোটটার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন সেই ডিজাইনার। সেই সুবাদে মুছলিম মিয়াও শিখলেন পলিমারে নকশার কলাকৌশল। নতুন সরকার এসে নোটটা আবার কাগজে ছাপতে চাইল। পরে বঙ্গবন্ধুর ছবির জায়গায় সরকারি মনোগ্রাম এবং বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ছবি দিয়ে ১০ টাকার নোটের নতুন ডিজাইন করলেন। এ ধরনের নোটের প্লেট এবং প্রসেসের জন্য যেতে হতো সুইজারল্যান্ড বা হাঙ্গেরিতে। কিন্তু টাঁকশালে বসেই মুছলিম মিয়া প্লেট করলেন, প্রসেসও। এতে সরকারের কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছিল।
২০১১ সালে দুই টাকা থেকে শুরু ১০০০ হাজার টাকার নতুন ৯টি নোটের ডিজাইন করলেন।
জয়নুল এলেন নোটে : ১৯৯৬-৯৭ সালের নোটের নকশা বাছাই কমিটিতে শিল্পী রফিকুন নবী, মুস্তাফা মনোয়ার ও কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন। তাঁরা মত দিয়েছিলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি চিত্রকর্ম টাকায় ব্যবহার করলে ভালো হয়। কিন্তু কাজটি আলোর মুখ দেখেনি। পরে যখন নোটের সিরিজ নকশা শুরু করেন মুছলিম মিয়া, তখন আবার শিল্পাচার্যের প্রসঙ্গ এলো। তখন ‘মই দেওয়া’ চিত্রকর্মটি নির্বাচন করা হয়। কর্তৃপক্ষ বলেছিল, চিত্রকর্মটি যেন হুবহু থাকে। হাঙ্গেরিতে এই নোটের কালার সেপারেশন করা হয়েছিল। লাইন ডিরেকশনও দেখিয়ে দিয়েছিলেন মুছলিম মিয়া।
যেভাবে হয় নোটের নকশা : নোটের নকশা বদলের দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক টাঁকশাল কর্তৃপক্ষকে এ ধারণা দেয়। সে অনুযায়ী কিছু খসড়া করেন ডিজাইনাররা। বাংলাদেশ ব্যাংক মনোনীত নকশা প্রণয়ন কমিটি আছে। চারুকলার শিক্ষক, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই কমিটি। তাঁরাই নকশার চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। পরে টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ সেটা মুদ্রণপ্রক্রিয়া শুরু করে। এ জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করা হয়। ডিজাইনাররা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে নোটের নকশা তত্ত্বাবধান করেন। প্রয়োজনীয় প্লেট প্রিন্ট করে ডিজাইনারকে একটা কালার চার্ট দিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। টাঁকশালে আরো কিছু প্রক্রিয়া শেষে কালার ম্যাচিং করে লিথোগ্রাফ ও ইন্টাগ্লিও পদ্ধতিতে ছাপা হয় নোটগুলো, যা হাতে খসখসে অনুভূত হয়।
মুছলিম মিয়া জানালেন, জলছাপ এবং সিকিউরিটি থ্রেডযুক্ত শতভাগ কটন কাগজে বাংলাদেশি নোটগুলো করা হয়। বাছাই কমিটির অনুমোদনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদামতো টাঁকশালে নতুন টাকা ছাপা হয়।
টাঁকশালের জেনারেল ম্যানেজারের (প্রডাকশন অ্যান্ড কন্ট্রোল, ডিজাইন অ্যান্ড এনগ্রেভিং) পদ থেকে মুছলিম মিয়া অবসর নিয়েছেন ২০২০ সালে। এখন নিজের স্টুডিওতে আঁকাআঁকিতেই সময় কাটছে প্রচারের আড়ালে থাকা মানুষটির।
সম্পর্কিত খবর

মিরপুরে প্রথম টি-টোয়েন্টি আজ
লাহোরের ‘বদলা’ ঢাকায়
তরিকুল ইসলাম সজল

একটু পরপরই ভেসে আসছে ‘ওয়াচ ইট ওয়াচ ইট’ শব্দ। মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের মূল মাঠে সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। গতকাল সন্ধ্যায় কৃত্রিম আলোর নিচে সেন্ট্রাল উইকেটের দুই পাশের নেটে ব্যাট হাতে রীতিমতো তাণ্ডব চালালেন তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলীরা। বড় বড় ছক্কা হজমে এ দুই ব্যাটারের সামনে যেন বল ফেলার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না রিশাদ হোসেন, নাসুম আহমেদরা।
গতকাল সিরিজ-পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে মিরপুরের উইকেট নিয়ে একাধিকবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন দাসকে। সেসব কথার জবাব দেওয়ার আগে অবশ্য প্রথম ম্যাচের উইকেট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন লিটন। এরপর মিরপুরের কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করতেও দেখা গেল তাঁকে।
পরিসংখ্যান অবশ্য বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা বলছে। এশিয়ান কাপের ম্যাচ বাদ দিলে টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি ২১ লড়াইয়ে মাত্র ২ জয় লিটনদের। এই দুটি জয় অবশ্য মিরপুরেই পেয়েছে বাংলাদেশ দল। তবে ২০১৬ সালের পর পাকিস্তানকে আর হারাতে পারেনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা, এই সময়ে হারে টানা ১২ ম্যাচ। সর্বশেষ সফরেও ৩-০ ব্যবধানে হারেন লিটনরা। এবার আক্ষেপ ঘোচাতে পারবে বাংলাদেশ? অধিনায়ক বললেন, যেকোনো দলকে হারানোর মতো মানসিকতা আমাদের আছে এবং আমরা সেই চেষ্টাই করব। কিন্তু নির্দিষ্ট এই দিনটাতে আপনাকে ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। তার মানে এই না যে ঘরের মাঠ বলেই আপনি ভালো খেলে জিতিয়ে দেবেন।’ তবে এসব ভেবে নিজেদের ওপর চাপ বাড়াতে চাচ্ছেন না লিটন, ‘না, কোনো অতিরিক্ত চাপ নেই। আমরা এসব রেকর্ডের দিকে মনোযোগ দিই না। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো ভালো ক্রিকেট খেলা এবং আমরা যে ধরনের ক্রিকেট খেলতে চাই, সেটাই খেলা। এই সিরিজেও আমরা একই বিষয়ে মনোযোগ দেব। আমরা প্রতিটি ম্যাচে ভালো ক্রিকেট খেলতে চাই এবং প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।’
মিরপুরের উঠান লিটনদের যেমন হাতের তালুর মতো চেনা, তেমনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলার সুবাদে পাকিস্তান দলের বেশ কয়েকজনও এখানকার কন্ডিশন সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছেন পাকিস্তানি অধিনায়ক, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই বিপিএলে খেলেছে, যা অবশ্যই একটি বড় সুবিধা। তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ আমাদের জন্য মূল্যবান। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছি।’ তবে বাংলাদেশও সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন লিটন, ‘দুই পক্ষই সুবিধা পাবে। ওরাও জানে আমাদের শক্তি, দুর্বলতার জায়গাও জানে। আমরাও তাদের সঙ্গে খেলি, শক্তি, দুর্বল জায়গাগুলো সম্পর্কে জানি। তো, আমার মনে হয় না এটা খুব সমস্যা হবে।’

গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৩০৬
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

ধীরে ধীরে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। কারফিউ শিথিল থাকায় আগের দিনের চেয়ে জন ও যান চলাচল বেশি ছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বুধবারের হামলা-সংঘর্ষে পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল পর্যন্ত চারটি মামলা করেছে। গতকাল শহরজুড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছিল।
এদিকে গত বুধবার থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩০৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নতুন গ্রেপ্তার করা হয় ১১৯ জনকে।
জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে আরো একটি মামলা করেছে পুলিশ।
এর আগে সন্ত্রাস দমন আইনে গোপালগঞ্জ সদর থানায় ৫৭৫ জন, কাশিয়ানী থানায় ৩৭০ জন এবং কোটালীপাড়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে এক হাজার ৬৫৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। সব মিলিয়ে আসামির সংখ্যা তিন হাজার চারজন।
পুলিশ জানায়, গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে চারটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা করা হয় সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায়। চারটি মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৩৫৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় দুই হাজার ৬৫০ জনকে।
গোপালগঞ্জে গতকাল সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকে। এ অবস্থায় গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের সময়সীমা বাড়ায় জেলা প্রশাসন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ কামরুজ্জামান জানান, গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। তাই গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
গত বুধবার গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ভণ্ডুল করতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন। দিনভর সংঘর্ষে প্রথমে চারজন এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেকজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে পাঁচজন নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

সালাহউদ্দিনকে নিয়ে এনসিপি নেতার বক্তব্যে উত্তাল কক্সবাজার
বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজার ও চকরিয়া প্রতিনিধি

কক্সবাজার জেলা শহরের শহীদ দৌলত ময়দানে এনসিপির জুলাই পদযাত্রার পথসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং কক্সবাজারের সন্তান সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর এক আপত্তিকর বক্তব্যে ফুঁসে উঠেছে কক্সবাজার। পাটওয়ারীর বক্তব্যের পরপরই শহরজুড়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। অবরোধ করা হয় সড়ক।
আকস্মিক এমন পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের কবল থেকে রেহাই পেতে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের পাহারায় পর্যটন শহর ছেড়ে বান্দরবানের পথে চকরিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় এনসিপির পদযাত্রা।
এর আগে দুপুর দেড়টার দিকে কক্সবাজার জেলা শহরের শহীদ দৌলত ময়দানের মঞ্চে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত গডফাদার ছিল শামীম ওসমান। এখন শুনছি, কক্সবাজারের নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে, মানুষের জায়গাজমি দখল করছে। আবার সে নাকি সংস্কার বোঝে না।
এমন বক্তব্য প্রদানের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে। তখনই বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঘর থেকে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। এনসিপির নেতারা সমাবেশস্থল ত্যাগ করার পরপরই ক্ষুব্ধ বিএনপির নেতাকর্মীরা এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।
ওদিকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়াসহ সব উপজেলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এনসিপি নেতার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কক্সবাজার জেলা শহরে বিকেল থেকে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জাসাস, মহিলা দলসহ প্রায় সব সংগঠন একের পর এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল চলছিল।
এনসিপি আগেই কক্সবাজার থেকে পাঁচ জেলার উদ্দেশে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে কক্সবাজার শহরের দৌলত ময়দানমুখী পদযাত্রা শুরুর কথা থাকলেও তাদের কর্মসূচি শুরু হয় দুপুর ১টার পর। পথসভার মঞ্চে এনসিপি সভাপতি নাহিদ ইসলাম বলেন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষভাবে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিটি তৈরি করাসহ এই দুটি সংস্কারে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে জুলাই সনদ তৈরি সম্ভব।

ফিরে দেখা ২০ জুলাই ’২৪
কারফিউয়ের মধ্যেও সংঘর্ষ, নিহত ৩৭
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানির জেরে আগের দিন ১৯ জুলাই রাত ১২টায় দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। প্রথম দফায় এই কারফিউ ২০ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে। এরপর দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ফের কারফিউ শুরু হয়ে পরদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানানো হয়।
এর মধ্যে থমথমে পরিবেশ আরো বাড়তে থাকে।
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে সরকার।
রাজধানীতে সহিংসতা ঠেকাতে এদিনও র্যাবের হেলিকপ্টার টহল অব্যাহত ছিল। বঙ্গভবন, গণভবন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, থানা, সারা দেশের কারাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল দেখা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে কারফিউ পাস নিয়ে জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বাইরে বের হন।
কারফিউয়ের মধ্যে রাজধানীর অলিগলিতে মানুষের আনাগোনা থাকলেও এদিন বেশির ভাগ প্রধান সড়ক ছিল প্রায় জনশূন্য। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকি ছিল। তবে এদিনও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, বনশ্রী, রামপুরা, মালিবাগ, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় সংঘর্ষ বেশি হয়।
সকাল থেকে রাজধানীর বাড্ডা, বনশ্রী, উত্তর ও মধ্য বাড্ডা এলাকায় অবস্থান নেয় কয়েক শ মানুষ। এর মধ্যে বনশ্রীতে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল বেশি। বিক্ষোভকারীরা সড়কে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ও আহত হন।
সংঘর্ষের মধ্যে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বিভিন্ন দোকানের মালপত্র লুট হওয়ার খবরও পাওয়া যায় এদিন। মেরুল বাড্ডার হাতিরঝিল এলাকায় দোকানের লুট করা মালপত্র নিয়ে বিরোধে এক কিশোরের ছুরিকাঘাতে আরেক কিশোর নিহত হয়। এ ছাড়া আরেক কিশোর ছুরিকাঘাতে আহত হয়।
এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ওই ভবনে থাকা হাইওয়ে পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক মানুষ আটকা পড়ে। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ গিয়ে হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে। হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়াও ওই ভবনে থাকা হাসপাতাল, ব্যাংক, চায়নিজ রেস্টুরেন্টসহ অর্ধশতাধিক দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এদিন দুপুরে কারফিউ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্র ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্যই কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে কারফিউ শিথিল করা হবে।
আগের দিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মন্ত্রিসভার তিন সদস্যের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সরকার এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সব দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে, যা আদালতে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং রায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিষয়টির একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা হবে।’
রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক
দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এদিন রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকের পরই অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউয়ের ঘোষণা আসে।
দুই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা
২০ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নির্বাহী আদেশে ২১ ও ২২ জুলাই সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ওই দুই দিন স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয় মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে। তবে জরুরি পরিষেবা কাজে নিয়োজিত কর্মীরা ছুটির আওতার বাইরে থাকবেন। সুপ্রিম কোর্টও বিচারিক আদালতগুলোতে দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করে।