দেশের চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে মাঠে নামছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের ৬৪ জেলায় সমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে উত্তরণে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং রাষ্ট্রে পতিত ফ্যাসিবাদের নানা চক্রান্তের অপচেষ্টা মোকাবেলাসহ বিভিন্ন জনদাবিতে সারা দেশে জেলায় জেলায় সমাবেশের কর্মসূচি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
তিনি বলেন, ৬৪ জেলায় এই সমাবেশ হবে।
১১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়ে তা রমজান শুরু হওয়ার আগেই শেষ হবে। জেলায় জেলায় সভা-সমাবেশের পর পর্যায়ক্রমে মহানগর ও বিভাগীয় সদরে সভা-সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ নেতারা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
দলীয় সূত্র জানায়, কোন জেলা ও মহানগরে কবে সমাবেশ হবে, সংশ্লিষ্ট জেলায় কোন কেন্দ্রীয় নেতা সমন্বয় করবেন, তা দলের সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
আজকালের মধ্যে এই সাংগঠনিক সভা হবে। এই সাংগঠনিক সভায় ১০ বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক থাকবেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালে যুক্ত থাকবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গত জানুয়ারি মাসে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রাজপথে কর্মসূচি করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।
সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্টদের সহযোগীরা এখন প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছেন। যাঁরা ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি—এমন লোকদের চিহ্নিত করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সফল হওয়া কঠিন।
রুহুল কবীর রিজভী বলেন, সরকার নিজেদের সফল দেখতে চায় কি না, এটিও ভাববার বিষয়। সরকারের ‘কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপে’ কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বাদ দিয়ে জনগণের নিত্যদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন এবং ষড়যন্ত্রমূলক অডিও রেকর্ড প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক উসকানি প্রদান করছেন।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার উসকানিতে এরই মধ্যে গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা দেশে গুপ্ত হামলা, ঝটিকা মিছিল ও গণসংযোগ শুরু করেছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রক্তপিপাসু আওয়ামী দুর্বৃত্তরা গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর নারকীয় আক্রমণ চালিয়েছে। এতে ১৫ জনের বেশি গুরুতর জখম হয়েছেন।
রিজভী বলেন, পতিত সরকারের গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর ফ্যাসিস্টদের নিয়ে ভার্চুয়ালি মিটিং করে বলেছেন, ‘যে শহরে আমরা দিনের বেলা ঘুরতে পারি না, সে শহরের কাউকে আমরা ঘুমাইতে দেব না।’ লীগের নয়া প্রজেক্টের মাস্টারপ্ল্যানারদের একজন তিনি। এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে ষড়যন্ত্রমূলক সভা করছেন।
রিজভী বলেন, একটি সভায় অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসনের ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্ল্যান করা হচ্ছে।’
গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নজিরবিহীন দুর্নীতির মহানায়ক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদরা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেনজীর আহমেদের গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের খবর প্রকাশ্যে আসার পরও প্রশাসন নির্বিকার। বেনজীর আহমেদের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের ভার্চুয়াল কনফারেন্সে যাঁরা জড়িত, তাঁরা আইনের আওতার মধ্যে পড়েন। এরই মধ্যে হাসিনার নির্দেশে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা।
বিএনপির এই নেতা বলেন, পুলিশের গাড়ি থেকে পাবনার সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাবকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যাকারী আওয়ামী দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়ে যতটা কঠোর হওয়া দরকার ছিল, উল্টো বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে।
রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের ৫৭২ জন নেতা ও তাঁর দোসরদের জামিন হয়েছে। ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ডিবি অফিসে নিয়ে ছয় কোটি টাকা চাঁদা আদায় চেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তারের তিন দিনেই জামিনে মুক্ত হয়েছেন সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনের সিন্ডিকেটের প্রধান এসএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক। গণহত্যার মামলার আসামিরা কিভাবে জামিন পাচ্ছেন, আমরা সরকারের কাছে সেটির স্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চাই। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা-নাগরিকদের গণ-অভ্যুত্থানে বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালানো অপরাধীদের কতজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, সরকারের কাছে সেটি জানতে চাই।’
রিজভী বলেন, সহস্রাধিক মানুষ হত্যা, হাজার হাজার পঙ্গু ও আহত হওয়ার এই বর্বরোচিত ঘটনা ও ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার সঠিক বিচার না হলে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই গণহত্যার বিচার হতে হবে। কিন্তু আসামিদের গ্রেপ্তার, জেলে ও দেশের বাইরে রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সচিবালয়ে গিজগিজ করছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা। পুলিশ-প্রশাসন-আদালতে তারাই সব কিছু করছে। অবিলম্বে ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আবারও হাসিনার দোসরদের পরাস্ত করা কঠিন হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা আবদুস সালাম, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, কেন্দ্রীয় নেতা আসাদুল করীম শাহিন, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন প্রমুখ।