এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নারী আসন ১০০ করার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে নীতিগতভাবে আমরা সবাই একমত। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কমিশনসহ বিভিন্ন দলের পক্ষে একটি বাছাই কমিটির কথা হয়েছে। এখানেও সমাধান না হলে র্যাংক পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। আমরা এ জায়গায় একমত হতে পারিনি। আমরা চাই, এটি সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সংসদে আলোচনা হবে। এ নিয়ে নাগরিকরা মতামত দিতে পারবেন। সভা-সেমিনার হবে। সেখানেও সমাধান না হলে আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকবে না।’
সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘আমরা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ আইনের মাধ্যমে করতে চাই। এতে আইনি ত্রুটি থাকলে সংশোধন সহজ হবে। কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সক্রিয় নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন। তবে সেই নির্বাহী বিভাগকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখতে হবে। যত বেশি কিছু সংবিধানে যুক্ত করা হবে, তত বেশি সংশোধন জটিল হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হোক এবং সেই আইনে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন আনা সহজ হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু এখন পর্যন্ত ন্যায়পাল কোনো দিন ফাংশন করেনি, তাই আমরা প্রথমে চাই এটি প্রতিষ্ঠিত হোক। আইন যুগোপযোগী করে, দায়িত্ব ও ক্ষমতা স্পষ্ট করে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হোক। ন্যায়পালকে শুধু তদন্তের ক্ষমতা না দিয়ে তার প্রতিবেদনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য আইন তৈরি করতে হবে।’
নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে বিএনপির অবস্থান প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রথম ধাপে প্রস্তাব করেছি, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫টি আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। পরবর্তী নির্বাচনে তা ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি হবে। আমরা চাই নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই।’
সংস্কার কমিশনের সাত শর বেশি সুপারিশ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা ৬৫০টির মতো প্রস্তাবে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি বা সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছি। সব প্রস্তাব সনদে আসবে না। তবে যেগুলো মৌলিক, যেমন—সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত, সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে। এখানে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবে দুজন বিচারপতি যুক্ত করা হয়েছে, যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি, বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির বক্তব্য, যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল মনে করে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছবে না। সংসদে পাঁচ-ছয়টি দল থাকে, অথচ এখানে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’
নারী আসন বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, পিআর হলে সরাসরি নারী ১০০ আসনের পক্ষে জামায়াত। আর আগের নিয়মে হলে সংরক্ষিত ৫০ আসন ঠিক আছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে বেশির ভাগ দল একমত। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল দ্বিমত জানিয়েছে। বিএনপি চায়, সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদে সমাধান করতে হবে। আমরা এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বিএনপিকে আহবান জানাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে জুলাই সনদে আমরা স্বাক্ষর করব না। এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে; যেন পরবর্তী সরকার এর মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত না হতে পারে।’ ন্যায়পাল নিয়োগে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তিনি বলেন, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকী বলেন, ‘জুলাই সনদের এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু, উচ্চকক্ষ, পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা ঐকমত্য হতে পারিনি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি। আশা করছি, আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি, কমিশন জুলাই সনদে সেই বিষয়গুলো যুক্ত করবে।’ তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে চার দিন আলোচনা হলেও এখনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। প্রথম জায়গাটি ছিল বাছাই কমিটি করা। বাছাই কমিটি যদি সর্বসম্মত হতে না পারে র্যাংক চয়েস পদ্ধতি করা। সেখানে গণসংহতি আন্দোলনের নতুন প্রস্তাব, পাঁচ সদস্যের যে বাছাই হবে, সেখানে বিচার বিভাগ থেকে একজন প্রতিনিধি রাখা।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্র্যাকটিস করতে না পারলে গণতন্ত্র আবারও হুমকিতে পড়বে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে কমিশনের প্রস্তাবে বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রত্যাবর্তনের প্রাথমিক ধাপ আকারে রূপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতির প্রবর্তন হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটি সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। এটি পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠালে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার যে ঐকান্তিক প্রয়াস চলছে, তা অর্থহীন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে পাঁচ সদস্যের কমিটি হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের ঐকমত্য আছে। কিন্তু বাছাই কমিটি যে নাম সংগ্রহ করবে বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে, সেখানে আমাদের আপত্তি। অনেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই, আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের কোনো অবদান নেই। তাই এখানে শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আর চলমান নারী ৫০ আসনে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। সরাসরি নির্বাচনে নারী ১০০ আসনে নির্বাচন করা বিষয়ে বেশির ভাগ দলই একমত।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ‘নারী ১০০ আসন চাই এবং সরাসরি নির্বাচন চাই। ইউপি বা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো তিনটা ওয়ার্ড মিলে সরাসরি নির্বাচন দেওয়া হোক।’