রাজাধিরাজ আবদুল হামিদ রসবোধে ঠাসা। রাষ্ট্রপতির পদে থেকেও সরল কথার মারপ্যাঁচে মোহমুগ্ধ করে রাখতেন সবাইকে। অথচ তাঁর রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা ও মন-ভোলানো গল্পগাথায় গড়ে ওঠা ভাবমূর্তি সামনে রেখে, পেছনে লাইন দিয়ে ‘রামরাজত্ব’ কায়েম করেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে পরিবারের একেক সদস্য রীতিমতো হাওরাঞ্চলের দানবে পরিণত হয়েছিলেন।
হাওরে হামিদ পরিবারের রাজত্ব
নাসরুল আনোয়ার, মিঠামইন থেকে ফিরে

কখনো সাবেক রাষ্ট্রপতির ভাই-ভাতিজা, মামা, চাচা কখনো বা ‘লতায়-পাতায়’ আত্মীয় পরিচয় দেওয়া একেকজন স্বজন স্থানীয় মানুষের জমিজমা দখল, লুটপাট, দুর্নীতি আর সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতে অপ্রতিরোধ্য লাঠিয়ালে পরিণত হন। নিজের ভাই-ভাতিজারা যখন তাঁকে ‘বেচে’ দিয়ে হাওরাঞ্চলকে নিজস্ব তালুকে পরিণত করেছিলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তখনো ছিলেন নির্বিকার, ভূমিকাহীন। কাউকেই ডাকদোহাই দেননি।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এখন অবসরে।
পরিবারে একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর নামে সেনানিবাসসহ কত কিছু হলো। এত সব সুনাম ও খ্যাতিতে মন ভরেনি ভাই-ভাতিজাদের। ক্ষমতা আর টাকার নেশা পেয়ে বসে সবাইকে। তাই তাঁরা সাবেক রাষ্ট্রপতির সব সুনাম, ক্ষমতা আর প্রভাবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাতারাতি বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের জলমহাল, ঠিকাদারি ব্যবসা, সরকারের উন্নয়নসহ প্রতিটি অফিস থেকেই তাঁরা দুই হাতে টাকা কামান।
স্থানীয়রা জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতির ভাই, মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হক নূরু নিয়োগ, বদলি ও তদবির বাণিজ্য করে গড়েছেন টাকার পাহাড়। সাবেক রাষ্ট্রপতির সত্ভাইয়ের তিন ছেলে শরীফ কামাল, তারেক ও হানিফ, ভাগ্নে সোয়েব আহমেদ রুলেন, নাতি রিগান আহমেদসহ এ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই এখন ‘কোটিপতি’।
আব্দুল হক নূরু ও মো. শরীফ কামালের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্যাতন চালিয়ে জমিজমা বাগিয়ে নেওয়া, দখল ও খাসজমি আত্মসাতের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। নূরুর বিরুদ্ধে হাওরের জিরাতিদের (অস্থায়ী কৃষক) দুই শতাধিক একর বোরো জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রভাবেই তাঁর পরিবার এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলে বলছে সবাই। পরিবারের সদস্যরা এত বছর এলাকায় দুঃশাসন জারি রাখলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি এদের দমাননি। তাঁর ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি রেজওয়ান আহমেদ তৌফিকও পরিবারের অপরাধীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন।
নূরুর ‘চাকরির কারবার’ ও দখলবাজি
আব্দুল হক নূরু নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে উজান এলাকার কিশোরগঞ্জ, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া, ভৈরব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কৃষক ও জিরাতিদের শত শত একর জমি দখল করে বছরের পর বছর চাষাবাদ করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানায়, সরকারি নিয়োগের জন্য নূরুর এজেন্টরা চাকরিপ্রার্থীদের প্রলুব্ধ করে টাকা নিতেন। এঁরা ১০ থেকে ২০-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাঁকিয়ে দরদাম ঠিক করতেন। একটি পদের জন্য একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। তবে অনেকেই ঘুষের টাকা ফেরত পাননি।
পনের-ষোলো বছরে মিঠামইন বেড়িবাঁধের ভেতরের কোনো জমি নূরু ও শরীফের ‘অনুমতি’ ছাড়া কেনাবেচা হয়নি। নূরু ও তাঁর পরিবার বেড়িবাঁধের দুই পাশের বেশির ভাগ জমির মালিকানা কবজা করেছেন। ভূমি ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন ক্রীড়নকের ভূমিকায়। তবে আব্দুল হক নূরুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁর মোবাইল ফোনে কল করেও এসব বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শরীফ কামালের লুটপাট
মিঠামইন সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফ কামাল উপজেলা পরিষদের রাস্তা দখল করে পাঁচতলা ভবন করেছেন। হ্যালিপেড এলাকায় মার্কেট, হাসপাতাল রোডে হোটেল ও বেড়িবাঁধে ‘হাওর রিসোর্ট’ নির্মাণ করেছেন। শরীফের ভাই হানিফ কামালেরও ‘ভাটিবাংলা’ নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
হাওরবাসী জানায়, তিন উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের নির্মাণকাজের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল শরীফের হাতেই। বেশির ভাগ কাজের ঠিকাদার তাঁর ভাইপো রিগান আহমেদ। তিন উপজেলার সব জলমহাল ও বালুমহাল নিয়ন্ত্রণকারী শরীফ টাকা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের বিনা মূল্যের নাগরিকত্ব ও ওয়ারিশান সনদপত্র সরবরাহ করতেন।
তাঁদের মাছের আড়ত ছাড়া জেলেরা অন্য কোথাও মাছ বেচতে পারতেন না। হাটবাজার থেকে শুরু করে হাওরের বেশির ভাগ সেচ প্রকল্প, হাটবাজারের ইজারা ও খেয়াঘাটের একক কর্তৃত্ব, বোরো মৌসুমে হাওরের ফসল পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও ছিল শরীফের কাছেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পদক সবই তাঁদের
উপজেলা সদরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই পরিবারের কবজায়। মিঠামইন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পাল্টে সাবেক রাষ্ট্রপতির বাবা হাজি তায়েব উদ্দিনের নামে এবং মিঠামইন মহাবিদ্যালয়ের নাম পাল্টে ভাই আব্দুল হক নূরুর নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৬৮ সালে এলাকাবাসীর চাঁদার টাকায় গড়া মিঠামইন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পাল্টানোর ঘটনায় স্থানীয় জনমনে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির রেজুলেশন ছাড়াই ২০১২ সালে নাম পাল্টাতে এই পরিবার অনুদান দেয় ১০ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে বিদ্যালয়ে নূরুর প্রয়াত ভাইয়ের নামে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই একাডেমিক ভবন’ নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালের পর জনগণের চাঁদার টাকায় গড়া কলেজটির নাম রাখা হয় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক কলেজ’। মিঠামইন মহাবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে গড়া কলেজের অধ্যক্ষ পদেও নিয়োগ পান আব্দুল হক নূরু।
নূরুর নিজের লাঙল-জোয়াল না থাকলেও দখল করা জমির চাষাবাদ করে বাগিয়ে নেন ‘শ্রেষ্ঠ কৃষক’ পুরস্কার। হন ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী’। শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের পুরস্কার পান তাঁর স্ত্রী, তমিজা খাতুন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবেদা জাহান। ‘শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান’ ও ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পদক’ পান তাঁর বোন আছিয়া আলম।
জলা-মাছ-ঠিকাদারির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ
শরীফ কামালের নেতৃত্বে আছিয়া আলমের ছেলে সোয়েব আহমেদ রুলেন ও আব্দুর রাজ্জাকের নাতি রিগান আহমেদ নিয়ন্ত্রণ করেছেন ঠিকাদারি ব্যবসা। অভিযোগ রয়েছে, হাওরের নদী খনন ও নদীভাঙন রোধে পাউবোর শত শত কোটি টাকার প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ ছিল রুলেনের হাতে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অল ওয়েদার রোডের ঠিকাদারের বালুর কাজ বাগিয়ে নেন শরীফ কামাল।
ডিবি হারুনের ‘শেল্টারদাতা’ এ পরিবার
এলাকাবাসী জানায়, সাবেক বিতর্কিত ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় মিঠামইনের হাওরে ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নির্মাণ করেছেন। হারুন অবৈধ পথে অর্জিত শত শত কোটি টাকা রিসোর্ট ও অ্যাগ্রো ফার্মে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি নিরীহ কৃষকদের শতাধিক একর জমিও দখল করেছেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ভাই এ বি এম শাহরিয়ারের মাধ্যমে হারুন হাওরে এসব অনাচার করেছেন বলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন।
স্থানীয়রা জানায়, ৫ আগস্টের পর বেপরোয়া লুটপাট ও দখলবাজিতে লিপ্ত সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গাঢাকা দিয়েছেন। তাঁদের লাঠিয়াল ও দালালরাও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। মুক্ত পরিবেশে সাধারণ মানুষ এখন প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদক সরেজমিন এলাকায় গেলে তাঁদের দখলবাজি, সন্ত্রাস ও নির্যাতনের শিকার অগণিত ভুক্তভোগী মুখ খুলেছেন। সরবরাহ করেছেন জাল-জালিয়াতির নথিপত্রও।
শূন্য থেকে কোটিপতি
দুই যুগ আগেও সাবেক রাষ্ট্রপতি হামিদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। স্থানীয়রা জানায়, শরীফ কামালের বাবা ও সাবেক রাষ্ট্রপতির সত্ভাই প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেকেরই নির্দিষ্ট পেশা না থাকায় কায়ক্লেশে চলতেন। সে সময় সাবেক রাষ্ট্রপতির ভগ্নিপতি খুরশিদ আলম মিঠামইন সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে রিলিফের কার্ডে খাদ্যসামগ্রী পাঠাতেন। মিঠামইনের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যাদের ঋণকর্জ করে ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তারা শত শত কোটি টাকার মালিক!’ তিনি দুদকের কাছে এই পরিবারের অবৈধ সম্পদ ও টাকার হিসাব চাওয়ারও দাবি করেন।
‘নূরু বাহিনী’র সদস্যদের অপকর্ম
আব্দুল হক নূরুর বাহিনীতে হাই স্কুলের শিক্ষক, লাঠিয়াল, ভূমি অফিসের কর্মচারী, জমির দালাল, দলিল লেখক, গ্রাম্য টাউট-বাটপার সবাই ছিলেন। জমি কেনাবেচা ও শ্রেণি পরিবর্তন, জোর করে দখল করা, অবাধ্যদের প্রহার থেকে শুরু করে সব রকম অপরাধ করেছে তারা। জানা যায়, নূরু বাহিনীর সদস্য কামালপুরের ইউনুস মিয়া কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেছেন। অথচ তাঁর বাবা রাজমিস্ত্রির সহযোগীর পেশায় জড়িত ছিলেন। কামালপুরের প্রয়াত আব্দুল মন্নাফ, সাইদুর রহমান, খিদিরপুরের শামসু মিয়া, হোসেনপুরের ফয়সাল আহমেদরা নূরু বাহিনীর সদস্য। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সমীর কুমার বৈষ্ণব ছিলেন সহযোগী।
তমিজা খাতুন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাসেল আহমেদ ছিলেন বাহিনীর ‘মাস্টারমাইন্ড’। সরকারহাটির অনীল চৌধুরী ও ইসলামপুরের নাদিম মিয়া ছিলেন দলিলের দায়িত্বে। উপজেলা ভূমি অফিসের পিয়ন ঢাকী গ্রামের রিপন চন্দ্র দাস তাঁদের প্রয়োজনে জমির কাগজপত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে ফাইল পর্যন্ত গায়েব করতেন।
যা ভাবছে এলাকাবাসী
হাওর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘মিঠামইনের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির সর্বনাশ করেছে এই পরিবার। সাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রভাবে এরা এত বছর নির্বিচারে লুটপাট করেছে। কায়েম করেছে রামরাজত্ব। সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাটের তদন্ত ও বিচার না হলে পরবর্তী সময়ে অন্যরাও অপকর্ম করতে দ্বিধা করবে না।’
সম্পর্কিত খবর

স্থায়ী কমিটির বৈঠক
ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক নয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায় বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে নয় বিএনপি। এটিকে রাজনৈতিক দলিল হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে মত দিয়েছে দলটি। গত বুধবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এরই আলোকে ঘোষণাপত্রের ওপর বিএনপির মতামতে এই দলিলকে আর্কাইভে (সংরক্ষণ) রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে বিএনপির কাছে পাঠানো জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত চূড়ান্ত করতে বুধবার রাতে স্থায়ী কমিটির এ বৈঠক হয়। ওই রাতেই খসড়ায় প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন এনে তাতে চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে বিএনপি। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংবিধানে স্থান দেওয়া হলে তাতে ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার দাবি তোলে।
স্থায়ী কমিটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, খসড়া ঘোষণাপত্র ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর বলা হলেও বিএনপি তাতে দ্বিমত জানিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্বাধীনতাযুদ্ধকেই প্রধান অর্জন হিসেবে উল্লেখ করে ঘোষণাপত্র শুরু হওয়া উচিত।
খসড়া ঘোষণাপত্রে আছে, ‘যেহেতু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণের ব্যর্থতা ও অপর্যাপ্ত ছিল এবং এ কারণে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি’—বিএনপি এ ক্ষেত্রে ‘বিভিন্ন শাসনামলের জায়গায়’ ‘আওয়ামী শাসনামলের’ কথা উল্লেখ করেছে।
এ ছাড়া দলটি ১৯৭২ সালের ‘সংবিধান পুনর্লিখন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায়’ বাদ দিয়ে ‘সংবিধানের বিদ্যমান সংস্কার উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংশোধন’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের খসড়া থেকে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রস্তুত করা ঘোষণাপত্রের খসড়ার শেষ অংশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি উল্লেখ ছিল। জানা গেছে, এর বাইরেও খসড়ায় আরো কিছু শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। এনসিপি সম্প্রতি সরকারকে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। অন্যথায় তাদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়।
সরকার ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। আর এটি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা তার ওপর মতামত গতকাল (বুধবার) দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার একটা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব কার্যক্রম চালিয়েছে। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ’২৪-এর মহত্ত্ব ও গুরুত্বের প্রতি বিএনপি যথাযথ মর্যাদা দেয়। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও বর্তমান সরকারকে বৈধতা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস স্থাপনের খসড়া অনুমোদন
বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের একটি মিশন স্থাপনের বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়’-এর মিশন স্থাপনসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ জুন ওই খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হলে তাতে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনি ক্লোজারের নকশা চূড়ান্তকরণ, ফেনীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্তকরণ এবং নোয়াখালীর খাল ও ড্রেনেজ অবমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও মহেশখালী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাস হয়।
বৈঠকে ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়, যা লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিংয়ের পর কার্যকর হবে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘অপশনাল প্রোটোকল টু দ্য কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারে (ওপি-ক্যাট)’ পক্ষভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মালয়েশিয়ার জোহর বাহরুতে বাংলাদেশের একটি নতুন কনস্যুলেট জেনারেল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
বৈঠকে মহেশখালীকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনতে ‘মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

মির্জা ফখরুল
দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, তাহলে কেন হবে না?
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে কেন নির্বাচন হবে না? দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। নির্বাচিত প্রতিনিধি চায়। এ জন্য তারা জীবন দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনাসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
অনুষ্ঠানে গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধীসহ জুলাই আন্দোলনে শহীদ ৬৪ জন সাংবাদিকের ওপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন ডিইউজের সহসভাপতি রাশেদুল হক। বিএফইউজের প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর পরিবার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছয় সাংবাদিকের পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব।
তাঁর এই বক্তব্যের জবাবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি খুব আশাবাদী মানুষ। অনেকে বলেছেন যে, হবে না। কেন হবে না? নির্বাচন তো এ দেশের মানুষ চায়, নির্বাচনের জন্য তো এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ গুছিয়ে ফেলতে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন এই কাজ খুব দ্রুততার সঙ্গে শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবেন। আমরা দাবি করছি, যেন এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয় দেশে নির্বাচন হবে? অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করে, নির্বাচন কি হবে? গতকাল প্রেস সেক্রেটারি যে বক্তব্য রাখলেন, তাতে কি মনে হয় নির্বাচন হবে? বেশির ভাগ মানুষ মনে করে নির্বাচন হবে না। তাহলে কী হবে? আমাদের ভাবনার দরকার আছে।’
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো নেই, দুঃশাসন কি বিদায় নিয়েছে? না। আমাদের আত্মতৃপ্তির কিছু নেই। আমাদের সামনে এখনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিরাজমান। রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা, দিল্লির আধিপত্যের কালো থাবা চতুর্দিকে ছেয়ে বসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি-আন্তর্জাতিক নীতি-কূটনীতি ইভেন সামনের নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া যায় তার চক্রান্ত এখনো বিদ্যমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতা বিরাজমান। আজকেও যদি দেখেন, এটা যদি না হতে পারে, ওটা হতে পারবে না। এ রকম বক্তব্য দিচ্ছেন আমাদের তরুণ নেতৃত্বের কতিপয় নেতা। আপনি আপনার চাহিদা বলতেই পারেন, এটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু আপনি এটা বলতে পারেন না যে, এটা না হলে, ওইটাও হবে না। এই অধিকার আপনার নেই। এই মানসিকতা আর স্বৈরাচারের মানসিকতা একই।’
তিনি বলেন, ‘৬৪ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। সংগ্রামের সম্পাদক আসাদ ভাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু লেখনীর কারণে। এখনো তো আপনাদের কণ্ঠে একই ধরনের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এটি কি ঠিক?’
বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘গত ১৭ বছরে সাংবাদিকদের ভূমিকা বর্তমান সরকার স্বীকার করতে চায় না। এই সরকারের যারা সুবিধাভোগী, তারা এক-দেড় মাস লড়াই করেছেন। আমরা সাংবাদিকরা ১৭টি বছর ঢাকার রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, অনেকে খুন হয়েছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকারের চূড়ান্ত পতনের জুলাই বিপ্লব এসেছে। সেখানে শুধু পেশাজীবী নয়, সাংবাদিকদেরও অবদান রয়েছে। আজকে মাঝে মাঝে কিছু শিশুকে দেখি সাংবাদিকদের হুমকি দিতে। তোমরা দেড় মাসের নেতা। আমরা ১৭ বছর লড়াই করে ফ্যাসিবাদের তক্ততাউস কাঁপিয়ে তুলেছিলাম। দেড় মাস নেতৃত্ব দিয়ে, ১৭ বছরের সংগ্রামকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমরা সাংবাদিকদের হুমকি দাও, এটা মেনে নেব না।’
অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘একটা ফ্যাসিবাদের ভাষা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটার নিন্দা করছি। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ, হুমকি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করছি, সেটা খুবই অমঙ্গলসূচক। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনোভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, হুমকি দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায় না।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলমের সঞ্চালনায় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইলিয়াস খান, এ কে এম মহসিন, ইরফানুল হক জাহিদ, সাঈদ খান, দিদারুল আলম, খন্দকার আলমগীর হোসেন ও প্রবাসী সাংবাদিক ইমরান আনসারী প্রমুখ।

‘ক্ষমা’ পেতে পারেন সাবেক আইজিপি
মেহেদী হাসান পিয়াস

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। এ মামলায় অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হতে আবেদন করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি মঞ্জুর করে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করে সাক্ষ্য উপস্থাপনের অনুমতি দেন। এর পরই প্রশ্ন উঠেছে, মামুন কি রাজসাক্ষী হয়েছেন? হয়ে থাকলে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে কী প্রতিকার পাবেন বা পেতে পারেন?
মামুনের দোষ স্বীকার
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে থেকে অপরাধ করায় শেখ হাসিনাকে এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে।
রাজসাক্ষী নিয়ে যা বলা আছে ট্রাইব্যুনাল আইনে?
এই মামলায় তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব অপরাধের বিচার হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে। আইনটির ১৫ ধারায় ‘একজন রাজসাক্ষীর ক্ষমা’ বিষয়ে বলা আছে। ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল, অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, প্রধান বা সহায়তাকারী হিসেবে সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করার শর্তে, এই ক্ষমা প্রদান করতে পারে।’
২ উপধারায় বলা আছে, ‘এই ধারার অধীনে অভিযোগ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ আর ৩ উপধারায় ‘বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে’ বলা আছে।
রাজসাক্ষী হলে আইনের শর্ত পূরণ করতে হবে : রাজসাক্ষী হতে চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলায় আদালত তাঁকে সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সাক্ষ্য-জেরার পর আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে তিনি সব সত্যি বলেছেন, কোনো কিছু গোপন করেননি বা তাঁর সাক্ষ্যের পর প্রকৃত সত্য উদঘাটন হয়েছে, তখন আদালত তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় যেসব শর্তের কথা বলা আছে, সেই সব শর্ত তাঁকে পূরণ করতে হবে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করবেন। রাজসাক্ষী হতে পারলে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার আছে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করার।’
প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করেছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। তিনি বলেছেন, এই মামলার সম্পূর্ণ সত্যি এবং সব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এই মর্মে একটি আবেদনও দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁর আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন।’
ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হওয়ার এটিই প্রথম নজির : প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ফৌজদারি অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে আর কোনো আসামি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেননি। মামুনকে কারাগারে আলাদা সেলে রাখা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছেন এবং যেসব আসামির বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারেন বা তাঁর বক্তব্যে যেসব আসামির সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেসব আসামি তাঁকে বায়াস (পক্ষে আনার) করার চেষ্টা করতে পারেন, তাঁর নিরাপত্তার ঘাটতি হতে পারে, এই জন্য কারাগারে তিনি যেন আইসোলেটেড (বিচ্ছিন্ন) থাকেন অর্থাৎ আলাদা সেলে রাখা হয়, সেই আবেদন করেছেন। আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ কারাগারে আলাদা সেলে থাকলেও সাবেক আইজিপি হিসেবে মামুন যে ডিভিশন সুবিধা পেয়ে আসছিলেন, তার বাইরে বাড়তি কোনো সুবিধা তিনি পাবেন না বলেও জানান প্রসিকিউটর তামিম।