প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগে পদপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৩১ জুলাই শোভন-রাব্বানীকে ছাত্রলীগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের মেয়াদ দুই বছর। এই সময় পার হওয়ার পর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের বিধান রয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি প্রায় এক বছরেও পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। তাগাদা দেওয়ার পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল হককে ছাত্রলীগকে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৩ মে ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এই কমিটি নিয়ে আরো বিস্তর অভিযোগ ওঠে। ত্যাগীদের বাদ দেওয়া, নিষ্ক্রিয়দের পদায়ন, বিতর্কিত, হত্যা মামলার আসামি ও ছাত্রদলের নেতাদের পদ দেওয়া, বিবাহিত, চাকরিজীবী ও সাংবাদিকদেরও পদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের সূত্র ধরে পদবঞ্চিতদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করে। পদবঞ্চিতদের মারধরের ঘটনাও ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন ও বিতর্কিতদের বাদ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও গোলাম রাব্বানী তা মান্য করেননি।
এ ছাড়া এই কমিটি দু-একটি জেলা কমিটির সম্মেলন করলেও কমিটি ঘোষণা করতে ব্যর্থ হন তাঁরা। এতে সারা দেশে ছাত্রলীগের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। তাঁদের বিরুদ্ধে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্মান না করা, মাদকে সম্পৃক্ততা ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের দুই কোটি টাকা চাঁদাবাজির মধ্যে এক কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভাগাভাগির বিষয়টি আলোচনায় আসে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ। গণভবনে প্রবেশের অনুমতিও বাতিল করে দেওয়া হয়।
গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগের কমিটি ঠিক থাকবে। শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী কমিটি দেওয়ায় শোভন-রাব্বানীর প্রতি আলাদা নজর ছিল আওয়ামী লীগের সব মহলের। তাঁরা ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগ সভাপতির প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘নতুন ধারায়’ ফিরিয়ে আনবেন—এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু দায়িত্ব পালনকালে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন শোভন-রাব্বানী।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মমতাময়ী নেত্রী’ সম্বোধন করে একটি চিঠি লেখেন গোলাম রাব্বানী। চিঠিতে সদ্য সাবেকদের অসহযোগিতা, নানা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন তিনি। এ ছাড়া নিজেদের অভিযোগের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতির ক্ষমা পেতে ব্যর্থ হন তিনি।
শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্য : গতকাল রাতে কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সূচনা বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা বিরোধী দলে থাকলেও দেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাঁর বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। অনেক দায়িত্ব আছে আমাদের। দলের প্রত্যেকটা নেতাকর্মীকে এটা মনে রাখতে হবে এবং সেভাবেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের শুরুতে তিনি এসব কথা বলেন।
এরপর শুরু হয় রুদ্ধদ্বার বৈঠক। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম
সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে দলের এক নেতা জানান, সব কিছু ঠিক থাকলে ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সবশেষ জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল।
সভা সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ৩১ ডিসেম্বর। গতকাল এ মেয়াদ দুই মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে।
সভায় শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের নিয়মিত সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনকে গতিশীল রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে প্রত্যেক কর্মীকে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য আহ্বান জানান।
ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বক্তব্য : ছাত্রলীগের নতুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে ছাত্রলীগের রাজনীতি সক্রিয় রয়েছি। নীতি-আদর্শের কোনো ক্ষেত্রেই আপস করিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সচেষ্ট থাকব। কোনো ক্ষেত্রেই নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করব না।’ তিনি বলেন, ‘অনেক জেলা কমিটি অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ করব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরকে অগ্রাধিকার দিয়েই কমিটি গঠন করা হবে।’
ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের আন্দোলনের মুখপাত্র এবং সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক রাকিব হোসেন বলেন, ‘নতুন নির্বাচিতদের অভিনন্দন। তাদের ওপর অনেক দায়িত্ব। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ছাত্রলীগ পরিচালিত হবে। বিতর্কিত কিংবা নীতি-আদর্শচ্যুতদের স্থান দেবে না।’